বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্ঘটনা: এ পরিণতির শেষ কোথায়?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ০৫ ২০২০, ২০:৫৭

ড.ইসমাইল আযহারি: মসজিদের পাশ দিয়ে কিংবা নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন গিয়েছে। মাঝে মাঝে মসজিদে গেলে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত বলে জানিয়েছেন এক মুসল্লি। গ্যাস লাইনের লিকেজ নিশ্চিত করে মসজিদ কমিটি তিতাস গ্যাসের কাছে লাইন ঠিক করার আবেদনও করেছিল।

খবরে প্রকাশ, তিতাস গ্যাস ৫০ হাজার টাকা ঘুষ না পাওয়াতে লাইন ঠিক করে দেয়নি।

এখানে দুইটা ব্যাপার সামনে চলে আসে।

১। আমাদের দেশের চিরন্তন দুর্নীতিবাজ সিস্টেম। গ্যাস লাইনে লিকেজ থাকলে কী ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আপনারা আমার চেয়ে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা অনেক ভালো জানে। তারা জানত মানুষ মারা যেতে পারে। গ্যাস বিষ্ফোরণে ঢাকা শহরে মানুষ মারা যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জেনে বুঝেও তিতাস ঘুষ চাইল। ৫০ হাজার টাকা না পেয়ে এতগুলো মানুষকে ঠেলে দিল মৃত্যুর দিকে।

একটা মসজিদ, মসজিদের মুসল্লি, নামাজ, ধর্ম কোনোটাই ঘুষ না চাওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়নি। তিতাস গ্যাসের সবাই নাস্তিক বা সবাই অমুসলিম এটা ভেবে কিছুটা সান্ত্বনা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হবার কথা। বাংলাদেশের সব সরকারি অফিসে নামাজের বিরতি থাকে এবং অধিকাংশ অফিসারই নামাজ পড়েন।

এই নামাজের খাতিরেও ৫০ হাজার টাকা মাফ করা গেল না? একটা বার কারোর মাথায় এলো না, মসজিদ সেভাবে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না। একটা মসজিদ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া প্রায় অসম্ভব।

এটা কোন দেশ? এটা কাদের দেশ?

২। তিতাসে অভিযোগ এবং একজন মুসল্লির বক্তব্য থেকে জানা যায়, গ্যাস লিকেজের কথা অনেকেই জানতেন। অন্তত মসজিদ কমিটি তো জানতেনই।

জানার পরে তিতাসে অভিযোগ করা দায়িত্বশীল আচরণ ছিল। কিন্তু এসি রুম করে মসজিদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটা আত্মঘাতী হয়ে গেল না?

গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটে বদ্ধ জায়গায়। ঢাকায় কিছু দিন পরপর শোনা যায় এমন ঘটনা। কোনো একটা চুলা অন করা ছিল। খোলা চুলা থেকে গ্যাস বের হতে হতে দরজা জানালা বন্ধ রান্নাঘর গ্যাসের সিলিণ্ডার হয়ে যায়। তারপর কেউ ম্যাচের কাঠি জ্বালালেই….বুম!

আমি বিশ্বাস করি যারা একটু চোখ কান খোলা রাখেন তারা সবাই এটা জানেন।

গ্যাস লিকেজ হবার পর আশেপাশে থাকাটাই রিস্কি। এসি রুমে দরজা জানালা বন্ধ থাকে। মানে একটা বৃহৎ গ্যাস সিলিণ্ডার তৈরি করা হয়ে অজান্তে।

মসজিটা সম্ভবত শহরের। এখানে কোনো সচেতন মানুষ জিনিসটা বুঝতে পারেননি? যে মসজিদ কমিটি তিতাসকে অভিযোগ করলেন, উনারাও এই জিনিসটা স্কিপ করে গেলেন। এটা জানার অভাব নাকি উদাসিনতা?

নাকি জানার পরেও ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের ভয়ে কোনো স্টেপ নেয়া যায়নি?

মসজিদ কমিটি বা সংশ্লিষ্ট কেউই চাইবেন না এমন দুর্ঘটনা ঘটুক। হয়তো ভাবতেই পারেননি এমন কিছু ঘটবে।

কেবল এসিগুলো অফ করে দরজা জানালা খোলা রাখলেই হয়তো এতগুলো প্রাণ বেঁচে যেত। এই কথাটা মনে হলেই কী যে দুঃখ লাগছে।

ঘুষ নিয়ে কোনো কথা বলে লাভ নাই। কোনো অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে ঘুষ বন্ধ হবে না। বাংলাদেশের শিরায় শিরায় ঘুষ আর দুর্নীতির বিস্তার।

তবুও চাই অভিযোগ সত্য হলে তিতাসের লোকগুলোর বিচার হোক। এদের সমত্তি ক্রোক করে নিহত প্রতিটা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হোক।

কে করবে বিচার সেটা অবশ্য একটা বড়ো প্রশ্ন।

আমরা যেটা করতে পারি, গ্যাস লিকেজসহ অসাবধানতার জন্য যে এক্সিডেন্টগুলো ঘটে সেগুলো নিয়ে কথা বলি। গ্যাস বোম্ব ব্যাপারটা সবাইকে বুঝিয়ে বলা উচিত। একটা চুলার চাবি খোলা রাখার ভুলে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই নাম্বার পয়েন্ট আলোচনায় না আনলেও চলত। আনলাম এ জন্যই যে ব্যাপারগুলো সবার জানা থাকুক।

গ্যাস বিস্ফোরণ আকস্মিক ঘটে। ভিক্টিম প্রস্তুতির কোনো সুযোগই পায় না। ন্যাচারাল ডিফেন্স রিফ্লেক্স এক্টিভ করার সময় থাকে না। অন্য অনেক ঘটনায় এক দু সেকেণ্ড পাওয়া যায় বলে অনেক প্রাণ বেঁচে যায়।

আমাদের মিডিয়ার উচিত ছিল এই দুইটা ঘটনাকে হাইলাইটস করা। পাশাপাশি নিহতদের পরিবার যেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পায় এবং আহতরা সর্বোচ্চ সুচিকিৎসা পায় এটাও নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের মিডিয়া অবশ্য অন্য কাজে বিজি। তারা এক দিকে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের সামনে মাইক ক্যামেরা ধরে চিকিৎসায় ব্যঘাত ঘটাচ্ছে। অন্য দিকে মসজিদের দেয়ালের ভেতরে থাকা সেইফ জোনে কোরআন অক্ষত থাকা নিয়ে নিউজ করছে।

সেই লকার বা তাকের নিচের তাকে একটা পুরাতন ফ্রুটিকার বোতলও অক্ষত ছিল। ভিউ পাওয়ার লোভে পবিত্র কোরআনকে যে ফ্রুটিকার পুরাতন বোতলের সমান মর্যাদা দেয়া হয়ে গেল সেদিকে খেয়ালই নেই।

আমাদের মহামান্য মিডিয়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে না এটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু ভিউয়ের জন্য ধর্মকে হেয়া করার মানে কী, কে জানে!

অবশ্য যে দেশের মানুষ যা খায় আর কী!

নারায়ণগঞ্জে নামাজরত অবস্থায় দগ্ধ হওয়া মুস্ললীদের জন্য সমবেদনা ও দোয়া রইল। খোদা তাদের কষ্ট উপশম করুক। এই ঘটনার পেছনে কেউ দায়ী থাকলে সে শাস্তি পাক।