বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আলেমদের উজ্জ্বল ভূমিকা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ২১ ২০২১, ০৬:২৮

মুজীব রাহমান: আমরা বাংলাদেশের পোশাকখাতসহ বিভিন্ন খাতসমূহের কথা জানি, যেসব খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল হয়েছে। শুধু তাই নয় এসব খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অর্থও লাভ হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের ওইসব ইমাম ও খতীবদের কথা জানি, যারা তাদের সুমধুর তেলাওয়াতের কারণে বহির্বিশ্বেও ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন এবং দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছেন?

ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মানসম্পন্ন ইমাম ও খতিব পেতে দক্ষ জনশক্তির জন্য আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ। অনারব হয়েও কাতারের আমিরের প্রাসাদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম। ২০১৫ সালে দুবাইয়ের শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের গৌরব বয়ে এনেছিলেন মাওলানা আবদুস সালাম। ব্রিটেনের অন্যতম বড় মসজিদ রিজেন্ট পার্ক মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের সন্তান মাওলানা কাজী লুৎফুর রহমান। দুবাইয়ের ৫০০ বছরের প্রাচীন আল বিদিয়া মসজিদে দীর্ঘদিন ধরে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের হাফেজ আহমাদ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে চার হাজার মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদের ৭০ শতাংশ মসজিদের মুয়াজ্জিনই বাংলাদেশি। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ও সুকণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে তাদের কদর অনেক বেশি। ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষক হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি ওয়াকফর মাধ্যমে নিয়োগ পেলে বাংলাদেশি মুদ্রায় মাসে দেড় লাখ টাকা বেতন পান।

শুধু আরব আমিরাত থেকেই প্রায় ৭০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন সংযুক্ত সেখানকার কর্মরত ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন ও ধর্মীয় শিক্ষকরা। কয়েক বছর আগের হিসাব অনুযায়ী কাতারে কর্মরত আছেন প্রায় এক হাজার ২০০ বাংলাদেশি ইমাম, মুয়াজ্জিন। কাতারে মসজিদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সেখানে ইমাম নিয়োগ হয় সরকারিভাবে। বাংলাদেশি আলেমদের মেধা, আচরণ, মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াত, শুদ্ধ আরবি ও অন্যান্য সাফল্যের কারণে কাতারিদের কাছে বাংলাদেশি ইমামদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

১৯৯০ সালে প্রথম বাংলাদেশ থেকে কাতার সরকার ইমাম নেয়। কাতারের আমিরের রাজকীয় প্রাসাদের খতিবের পদসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের খতিব পদে বাংলাদেশি আলেম কর্মরত আছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে কর্মরত খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় এক হাজার দুইশো।

খতিব ও শিক্ষক হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের বেতন সাত হাজার ৭০০ রিয়াল বা ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৫ টাকা। এর বাইরে রয়েছে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হাদিয়া (সম্মানী উপহার)। যারা শুধু সহকারী ইমাম ও শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, তারা পান ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪৫ টাকা বেতন। কাতারে খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য পানি, বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ মানসম্মত আবাসন একেবারেই ফ্রি। চিকিৎসার খরচও বহন করে কাতার সরকার। ইমামরা তাদের সন্তানদের কাতারের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালে তা-ও একদম ফ্রি। ফলে তারা বেতন ও হাদিয়া যা-ই পান, পুরোটাই দেশে পাঠাতে পারেন। গড়ে দুই লাখ টাকা দেশে পাঠালে প্রায় ২৫ কোটি টাকা প্রতি মাসে তারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে বাংলাদেশি ইমামদের চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন মসজিদে কর্মরত বাংলাদেশি ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন হিসেবে দুই হাজারেরও বেশি আলেম কর্মরত আছেন। তবে তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি কমিউনিটি পরিচালিত মসজিদগুলোতে কর্মরত।

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রায় ৫০০ মসজিদ আছে। মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি তারা সেখানে শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ইভিনিং মক্তব, সাপ্তাহিক ক্লাস ও ইমামতি মিলে সপ্তাহে প্রায় ৫০০ পাউন্ড, মাসে দুই হাজার পাউন্ড বেতন পান ইমামরা। বর্তমান রেট অনুযায়ী (১ পাউন্ড ১১০ টাকা) মাসে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশি ইমামরা প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার টাকা বেতন পান।

মসজিদ ছাড়াও সেখানে বিভিন্ন ইসলামি খেদমতের সঙ্গে জড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশি আলেমরা। মাদানি গার্লস স্কুল, লন্ডন ইসলামিক স্কুল ও বার্মিংহাম জামিয়া ইসলামিয়াসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা। ভালো ইংরেজি জানা কর্মঠ আলেমরা বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়া অন্যান্য কমিউনিটিতেও সম্মানের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মরত ইমামরা দেশের গৌরব বয়ে আনার পাশাপাশি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

সৌদি আরবের মদিনার তাবুক রোডের ‘মসজিদ নাসমা আল হারবীতে দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের মাওলানা শাহাদাত হোসাইন। পাশাপাশি বেসরকারী এক কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। তিনি প্রবাসে রয়েছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন প্রবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনে।

দেশের বাইরে ইমাম নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ খাতে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমঝোতা ও ভিসা প্রসেসিংয়ের জটিলতার অবসানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধার হাত প্রসারিত করলে এ খাতে দক্ষ লোকবল দেশে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশের বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে পৃথিবীবাসীর কাছে।