‘প্রথম আলো’র ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কি আ. লীগের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র চাইতে বেটার?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ০২ ২০২৩, ২১:২১

তুহিন খান

১.

কে আশল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ লালন করে? প্রথম আলো, না আওয়ামী লীগ? এই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ থেকেই কি প্রথম আলো ১/১১ আর শাহবাগ কায়েমে উস্কানি দিছিল? ‘প্রথম আলো’র ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ যে আওয়ামী লীগের চাইতে বেটার, তার প্রমাণ কী? ১/১১ আর শাহবাগ?

আপনারা ২০১৩ সালের মার্চ মাসের ‘প্রথম আলো’র কপিগুলা নিয়মিত দেখছেন কিনা জানি না। আমি দেখছি। সাইদির রায়ের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলিতে যে বহু মানুশ মারা গেছে, প্রথম আলো এইটারে কীভাবে জায়েজ করছে, এবং এই খুনের সম্মতি উৎপাদন করছে, তা নিয়া গবেষণা হওয়া জরুরি। আমি সামান্য দিশা দেব এই লেখায়।

প্রথম আলো এই খুনগুলারে লেখছে ‘রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত’। যেমন, ২ মার্চ, ২০১৩’র প্রথম আলো-র একটা হেডলাইন: ‘রাজনৈতিক সহিংসতায় ফেব্রুয়ারিতে নিহত ৬২’।

অনেকের মনে হইতে পারে, এই হেডলাইনে সমস্যা কী? সমস্যাটা সিম্পল। পুলিশ যে গুলি কইরা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মেরে ফেলতেছে, এবং এই মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে সে যে ওই বর্গটারে ‘হোমো স্যাকের’-এ পরিণত করছে, তাদের মানবাধিকার কাইড়া নিয়া তাদের ‘বেয়ার লাইফ’-এ পরিণত করছে, এই বাস্তবতাটারে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ শব্দবন্ধের মধ্যে চাপা দিয়ে দিছে প্রথম আলো।

যেমন ধরেন, ‘দাঙ্গা’ শব্দটা। ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে যেটা হইছে, সেটারে কিছুতেই ‘দাঙ্গা’ বলা যায় না; বা বার্মায় রোহিঙ্গাদের সাথে যেটা হইছে, সেটাও ‘দাঙ্গা’ না। এগুলা স্পষ্ট কিলিং; খুব পরিকল্পিত ও অর্গানাইজড মার্ডার। ২০১৩ সালের মার্চ মাসেও দেশে তাই হইছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একদিনে প্রায় ১০০ লোক মেরে ফেলছে গুলি করে; যাদের প্রায় সবাই একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক। কিন্তু ‘প্রথম আলো’ এইটারে বলতেছে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’।

২.

কিন্তু, ‘প্রথম আলো’ আশলে এইখানেই থাইমা থাকে নাই। সে এই ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’র পক্ষে সম্মতিও উৎপাদন করছে৷ কীভাবে?

প্রথমত, ‘সহিংসতা’ শব্দটারে প্রথম আলো এমনভাবে ব্যবহার করছে, যেন ‘সহিংসতা’ ও জামাত সমার্থক। যেমন, ৩ মার্চ, ২০১৩ তারিখের প্রথম আলো-র লিড হেডলাইন: ‘সহিংসতা বন্ধ হয়নি, মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত’। হেডলাইন পড়ে মনে হইতে পারে, পুলিশ/লীগ ও জামাত— দুই দলরেই বুঝি দোষারোপ করছে প্রথম আলো। আশলে তা না। ওই সময় প্রথম আলো-র সহিংসতা বিষয়ক নিউজগুলার প্যাটার্ন ছিল এমন যে, জামাত-বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচার থামানোর জন্য অন্যায়ভাবে সহিংসতা করতেছে; আর সরকার ও পুলিশ সেই সহিংসতা বন্ধের জন্য কঠোর হইতে বাধ্য হচ্ছে। এই নিউজেও সেই প্যাটার্নই ফলো করা হইছে৷

আরেকটা শিরোনাম দেখেন, পরদিনেরই লিড হেডিং: ‘সহিংসতা বাড়ছে, নিহত ২২’। মনে হইতে পারে, নির্দোষ হেডিং। এবার সাব হেডিং পড়েন ওই নিউজের: ‘থানা, ফাঁড়ি, সরকারি দপ্তরে জামায়াত-শিবিরের হামলা, আগুন’। অর্থাৎ, ‘সহিংসতা’ ব্যাপারটারে জামাতের সাথে নির্দিষ্ট করে দিছিল প্রথম আলো; ফলে এই যে পুলিশের গুলিতে যত লোক মারা গেল তখন, পুরা দায়টা যেন জামাতেরই— এমন একটা বাস্তবতা তৈরি হইছিল তাদের নিউজে।

তবে এর পরদিন, মানে ৫ মার্চের হেডলাইনে আর রাখঢাক রাখে নাই প্রথম আলো। ‘সহিংসতা’ শব্দটারে সরাসরি জামাতের সাথে জুইড়া দিয়া লিখছে: ‘থামছে না জামায়াতের সহিংসতা’: সাতক্ষীরা ও সিরাজগঞ্জে প্রাণ গেল আরো চারজনের’। দেখেন অবস্থাটা; এই চারজনের প্রায় সবাই জামাতের কর্মী, মারা গেছে পুলিশের গুলিতে, কিন্তু প্রথম আলো হেডিংয়ে লেখছে ‘থামছে না জামায়াতের সহিংসতা’।

সোজা ভাষায় বললে, পুলিশের গুলিতে মানুশের মরনরে ‘সহিংসতা’ শব্দের বস্তায় ভইরা, তারপর সেই বস্তাটা জামাতের কান্ধে তুইলা দিছে প্রথম আলো। কাজটা সে কীভাবে করছে, ৫ মার্চের প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া একটা জরিপ দিয়া তা ভাল বুঝতে পারবেন। জরিপটা এমন:

‘২৮ ফেব্রুয়ারি-৪ মার্চ: ১৮ জেলায় ‘সহিংসতা’য় (কোট-আনকোট মার্ক আমার) নিহত ৭৪; ‘৩৮’— সহিংসতায় জামায়াত-শিবির কর্মীর মৃত্যু; ‘৩০’— সাধারণ মানুষ ও ‘অন্য রাজনৈতিক কর্মী’র মৃত্যু; ‘৬’— জামায়াত-শিবিরের হামলায় পুলিশের মৃত্যু।’

এই জরিপের পাশে ১৪ জেলায় মন্দিরে হামলা, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ‘নাশকতা ও সহিংসতা’র কিছু উদাহরণ দেওয়া।

এখন বলেন, এই জরিপ পইড়া আপনার কী মনে হইল বা হবে? জামায়াতের কর্মী, ‘অন্য রাজনৈতিক দলে’র কর্মী আর সিভিলিয়ান মারা গেছে ‘সহিংসতা’য়। আবার, ওই সহিংসতাটা করছে মূলত জামাত; কারণ প্রথম আলো’র ওই জরিপে সহিংসতার যত উদাহরণ দেওয়া আছে, সবগুলাই জামাতরে টার্গেট করে দেওয়া। অন্যদিকে পুলিশ মারা গেছে জামাতের হামলায়। তার মানে, এই যে ৭৪ জন মারা গেল, এরা সবাই ‘সহিংসতা’ ওরফে ‘জামাতের সহিংসতা’য় মারা গেছে।

দ্বিতীয়ত, ওই সময় যত পুলিশ বা সিভিলিয়ান মারা গেছে, প্রথম আলো’র মতে তারা কেউই ‘সহিংসতা’য় মারা যায় নাই। সবগুলার দায় এক্সক্লুসিভলি জামাতরে দিছে প্রথম আলো। ‘জামাতের সহিংসতায় পুলিশ নিহত’ বা ‘জামাতের সহিংসতায় নিহত পথচারী’— এমন। পুলিশ ও সিভিলিয়ানদের মধ্যে কারো কারো ঠিকানা ও পরিবাররে খুঁজে বের করে তাদের মাধ্যমে ‘জামাতের সহিংসতাবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ উৎপাদনমূলক নিউজ করা হইছে। এমনকি, জামাত ও পুলিশের মধ্যে চলা সংঘর্ষে গাছের যে ক্ষতি হইছে, তার দায়ও প্রথম আলো এক্সক্লুসিভলি জামাতের উপর চাপায়ে হেডিং করছে: ‘জামায়াত-শিবিরের নির্মমতায় প্রাণ হারাল ১০ হাজার গাছ!’ (৫ মার্চ, ২০১৩) এই সব গাছ যে জামাতই কাটছে, এ ব্যাপারে প্রথম আলো’র সাক্ষী হইল তৎকালীন সওজ-র একজন উপ-বিভাগীয় আর একজন উপজেলা প্রকৌশলী। মজার না!

তৃতীয়ত, পুলিশের ভূমিকারে কীভাবে পোট্রে করছে প্রথম আলো? জাস্ট একটা হেডিংয়েই সেটা পরিষ্কার৷ ৭ মার্চের প্রথম পাতায় ছাপা হেডিং: ‘হামলা ঠেকাতে গিয়ে মার খাচ্ছে পুলিশ: ৪ মাসে নিহত ৭, আহত ৫৬৯’।

চতুর্থত, সরকার যেন ‘(জামাতের) সহিংসতা’ বন্ধে আরো কঠোর হয়, সেই আর্জিও জানাইছে প্রথম আলো। ‘মাঠ প্রশাসন আতঙ্কে: নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি’ (৬ মার্চ), ‘সুজনের আহ্বান: স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির তাণ্ডব প্রতিরোধ করুন’ (৫ মার্চ), ‘হামলা ঠেকাতে গিয়ে মার খাচ্ছে পুলিশ: ৪ মাসে নিহত ৭, আহত ৫৬৯’ (৭ মার্চ), ‘সাংসদেরা জামায়াত-বিএনপির; নিষ্ক্রিয় ছিল আ.লীগ, প্রশাসন’ (১১ মার্চ)— এই ধরনের অসংখ্য নিউজ করছে প্রথম আলো, যেগুলার মূল সুর হইল জামাত ইচ্ছামত সহিংসতা করতেছে, কিন্তু সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতেছে না কেন?

৩.

এ ধরনের নিউজ ধারাবাহিকভাবে করে গেছে ওই সময় প্রথম আলো। এইভাবে, প্রথমে গুলি করে পাখির মত মানুশ মারাটারে ‘সহিংসতা’ শব্দে ঢুকাইছে তারা, তারপর সেই সহিংসতার দায় জামাতরে দিয়া সব খুনের দায়ও জামাতের উপর চাপাইছে, আর তারপর জামাতের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হইতে উস্কাইছে সরকাররে। আর এই পুরা পরিস্থিতিটা তৈরি হওয়ার পিছনে আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী ও গণজাগরণ মঞ্চের ভূমিকারে একদম বা প্রায় গায়েব কইরা দিছে। এরমধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের সাথে আবার প্রায় নিয়মিত তাল দিয়া গেছে তারা; ইমরানের উত্থানেরও অনেকদিন পর পর্যন্ত।

প্রথম আলোর এই প্রচারণাই আওয়ামী লীগের তৎকালীন অনেক বয়ানের ভিত গড়ে দিছে। ৬ মার্চের প্রথম আলো’র হেডিং: ‘৬৭ জনের মৃত্যুর দায় বিএনপি-জামায়াতের: সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি’। প্রথম আলো এই বিবৃতিরে চ্যালেঞ্জ জানাইছে কখনো? একদম না। কারণ, এই বিবৃতির ভাষা তাদেরই বানানো আশলে।

৪.

ফরহাদ মজহার তখন বলছিলেন যে, মিডিয়া এখন সন্ত্রাস করছে। বলছিলেন, যেকোন দেশে এই লেভেলের সন্ত্রাস মিডিয়া করলে, মিডিয়ার বিরুদ্ধে পাবলিকের রেজিস্ট্যান্স আরো ভয়াবহ হয়; এখানে তো সামান্য কিছু পটকা ফোটানো হইছে। আর এই বক্তব্যের জেরে ফরহাদ হইছেন ‘সন্ত্রাসী’।

অথচ আমাদের আরেক বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান এই মিডিয়াসন্ত্রাস দেখেন নাই। উনি দেখছেন কেবলই ‘আমার দেশ’র ‘নজিরবিহীন উস্কানি’। সরকার কেন ‘আমার দেশ’র বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আরো আগে নেয় নাই, বা সাংবাদিকরা কেন আরো আগে ‘আমার দেশ’ বয়কট করে নাই, এই মর্মে উষ্মা প্রকাশ করছেন। কিন্তু প্রথম আলোর এই ভূমিকা নিয়া উনি সামান্য উষ্মাও কোথাও প্রকাশ করছেন বলে দেখি নাই।

তো প্রথম আলো এগুলা কেন করছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ই তো, না! তাইলে, তাদের চেতনা যে অনেক ভাল চেতনা, সেইটা পাবলিক বুঝবে কীভাবে? এই চেতনা যে আবার রিপিট করবে না প্রথম আলো, তার ভরসা কী?

৫.

প্রথম আলো আর আওয়ামী লীগের এই ম্যাচ মূলত ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। প্রথম আলো নানা দুর্নীতির সমালোচনা করবে, আওয়ামী লীগের অপশাসন নিয়া আলাপ দেবে, রাজনীতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মর্মে হাউকাউ করবে, সরকারের বিভিন্ন অসঙ্গতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দেবে (আর দেওয়ারই তো কথা; কারণ প্রথম আলো তো ওই অর্থে বাঙলাদেশে প্রচলিত রাজনীতিরেই ‘অপরাজনীতি’ ভাবে; সেজন্যেই তো সে ‘সুশীল রাজনীতি’ ওরফে ১/১১-এর দোসর হইছিল), কিন্তু আওয়ামী লীগ যে ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাস ব্যবহার কইরা এই ফ্যাসিবাদ গইড়া তুলছে, প্রথম আলো সেই ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাসরে ফানা কইরা দিতে পারবে না, সেই ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাসরে শক্তিশালীই করবে বরং সে। কারণটা সিম্পল: ‘প্রথম আলো’ ওই ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাসেরই একটা অংশ।

আমরা প্রথম আলো’র পক্ষে দাঁড়াব এখন, সেটা ঠিকই আছে। প্রথম আলোর এই বিপদে খুশি হওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু, ইতিহাসের এই বোঝাপড়াগুলা সাইরা রাখা জরুরি; যেন সুশাসন ও ন্যায়বিচারের বাঙলাদেশে ‘প্রথম আলো’র মত কর্পোরেটরা নিজেদের ইডিওলজির চাপে মানুশ খুনের বৈধতা বা ১/১১ এর মত পরিস্থিতি তৈয়ার না করতে পারে।

‘প্রথম আলো’ এখনও পর্যন্ত আমাদের সাংবাদিকতা বা প্রকাশনা সেক্টরের সেরা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হোক তা আমরা চাই না। কিন্তু প্রথম আলো যদি সত্যিই দেশের মানুশের ভাল চায়, একটা স্থিতিশীল দেশ ও সমাজ চায়, তাইলে তারা তাদের ভুলগুলা স্বীকার কইরা, শোধরায়ে নিয়া, নিজেদের সীমিত ‘চেতনা’র কুয়াটারে আরো বড় করবে— এই আশা রাখি। নতুবা সারা দেশের মানুশ মিলাও হয়ত একদিন আর প্রথম আলোরে বাঁচাইতে পারবে না।