নীরব বিপ্লবের মহানায়ক ফুলতলীর পীর ও মুর্শিদ মাওলানা আবদুল লতিফ চৌধুরী (রহ.)

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১৪ ২০২২, ১৬:৫৬

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী: বেশ ক’বছর আগে সিলেটের এক মহাসম্মেলনে মঞ্চে বসা ফুলতলীর মরহুম পীর সাহেব হযরাতুল আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী রহ.। তার একপাশে উস্তাদুল আসাতেজা খতিব উবায়দুল হক রহ.। অপরপাশে দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক ধর্ম এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মাওলানা এম এ মান্নান রহ.। এটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে আন্দোলনের একটি প্রোগ্রাম। এ তিন মনীষীর একজনও আজ বেঁচে নেই। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাই চ‚ড়ান্ত। বান্দারা মনে করে এ সময় তারা থাকলে ভালো হতো। আর আল্লাহ ভালো মনে করেছেন বলেই নিজ ইচ্ছায় যথাসময় তাদের নিয়ে গেছেন।

এরপরও বর্তমান সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় মনে হয় রাজপথে, ভাবনায়, পরিকল্পনায়, নেতৃত্বে এসব মনীষীর উপস্থিতি আজও বিকল্পহীন। পীরসাহেব ফুলতলীর কথাই ধরা যাক। বিগত সময়ের নাস্তিক্যবাদী আগ্রাসন, সেক্যুলারিজমের ঝড়ো হাওয়া, ইসলামের ব্যাপারে দ্বিধা-সংশয় ও অপপ্রচার, মুরতাদ হওয়ার হিড়িক, শিরকের নানা অনুশীলন, শিক্ষানীতির ধর্মহীন চরিত্র, দুর্নীতি, অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপাচার যখন ৯২ ভাগ মুসলমানের আবাসভ‚মি স্বাধীন বাংলাদেশকে খুবলে খাচ্ছে, তখন আন্দাজ করা যায় যে, আধ্যাত্মিক শক্তি, সামগ্রিক শিক্ষা ও সেবা কার্যক্রম, আন্দোলন সংগ্রামে পীর সাহেব ফুলতলী মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী কতটা অপরিহার্য। গোটা জাতিকে দীনের খাতিরে ঐক্যবদ্ধ করা এবং কালেমাওয়ালা নানা কর্মপন্থার মুসলমানকে একটি বিন্দুতে জড়ো করার মতো বড় ব্যক্তিত্ব আজ বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। এমন অভিভাবকতুল্য মনীষীদের চলে যাওয়া জাতির জন্য অশনি সংকেত।

তার জীবন কর্ম ও অবদান নিয়ে আলোচনা শুরু করলে লেখক বা বক্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান যে, কোন দিক রেখে কোন দিক আলোচনা করবেন। আমারও সেই অবস্থা। যাই হোক, একটি ঐতিহাসিক বিন্দু থেকে শুরু করা যাক। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামের ব্যানারে পরিচালিত ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক আন্দোলনে শর্ষিনার পীর হযরত মাওলানা শাহ নেছার উদ্দিন আহমাদ রহ., হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ., মাছিহাতা দরবারের পীর সাহেব মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন আহমাদ রহ., হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল ওহাব রহ. প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখের সমন্বয়ে পরিচালিত আন্দোলনে ফুলতলীর পীর সাহেব রহ. ছিলেন অন্যতম নেতৃপুরুষ। হাকীমুল উম্মাত মুজাদ্দেদে মিল্লাত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সুযোগ্য খলিফা হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ. এর বিশেষ অনুরোধে পীর সাহেব ফুলতলী রহ. ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনসমূহে যোগ দান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তার বয়ানে আকৃষ্ট হয়ে দেশের নানাপ্রান্তের আলেম উলামা, পীর মাশায়েখ, খানকাহ ও দরবারের জিম্মাদারগণসহ ঐতিহ্যবাহী জৌনপুরীসহ উল্লেখযোগ্য সকল সিলসিলার উলামায়ে কেরাম ও পীর সাহেবগণ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব হতে আমৃত্যু দেশের মানুষকে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে শিক্ষিত এবং অভ্যস্থ করে ইসলামী রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি করাই পীর সাহেব ফুলতলী রহ. এর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিষয়টি দেশি-বিদেশি নানা চক্রে পড়ে হুমকির সম্মুখীন হয়। অনুগত মূলধারার সেনাবাহিনী নিয়ে শহিদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম সাহেবের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালনায় নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন হন। সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও আত্মিক শক্তিসম্পন্ন সকল পীর মাশায়েখ নিয়ে ঢাকার বায়তুল মোকাররামস্থ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন পীর সাহেব ফুলতলী রহ.। সভাপতির ভাষণে তিনি দেশের সর্বত্র বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) এর হাদীস: ‘মান লাম ইয়ারহাম সাগীরানা ওয়া লাম ইয়ুওয়াক্কির কাবীরানা ওয়া লাম ইয়ুবাজ্জিল উলামাআনা ফালাইসা মিন্না’ (অর্থাৎ যে আমাদের বড়দের মান্য করে না, ছোটদের স্নেহ করে না আর আমাদের আলেমগণকে সম্মান করে না- সে আমার উম্মত নয়) এর ব্যাখ্যা করে বলেন, এ হাদীসের ওপর দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত সেনাবাহিনী এবং আমলাগণ আমল করলে চেইন অফ কমান্ড ঠিক হয়ে যাবে। আর তখনই আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার সাহায্য আসবে। এরপর তিনি তার উদ্ভাবিত ঐতিহ্যবাহী ধারায় পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। বলা হয়ে থাকে, তার এই ভাষণে তিনি যেভাবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পথ নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর দ্বারা রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষভাবে উপকৃত হয়। বিশিষ্ট বুযুর্গগণের আন্তরিক দোয়ার ফলে দেশে সুশাসন এবং শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং দেশ পরমুহূর্ত থেকেই চরম অর্থনৈতিক সংকট হতে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকার বায়তুল মোকাররাম মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় মিরাজুন্নবী (সা.) সম্মেলন। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতি নির্ধারিত ছিলেন পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এম এ সাত্তার। কিন্তু তিনি নিজে সভাপতিত্ব না করে পীর সাহেব ফুলতলী রহ. কে উক্ত সম্মেলনের সভাপতি মনোনীত করেন। খতীবে আজম সিদ্দিক আহমাদ রহ. মি’রাজ সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। এই মাহফিলে হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম রহ., মাওলানা আমীনুল ইসলাম, মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ., মাওলানা আব্দুল গাফফার রহ., মাওলানা মাসুম রহ. প্রমুখ দেশ বিখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও মুফাস্সিরগণ বয়ান পেশ করেন। পীর সাহেব ফুলতলী রহ. এর ভাষণে অতীত বুযুর্গদের রূহ ও সজীবতা ছিল। আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য ছিল। শরীয়া সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ।

মাসিক মদীনার সম্পাদক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী স্কলার মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ. একদিন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, পঞ্চাশের দশকের দিকে একদিন বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের এক বৈঠকে মাগরিবের নামাযের সময় হলে হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ. ইমামতির জন্য ফুলতলী সাহেবকে বলেন। তখন ফুলতলী সাহেব বলেন, আমরা একজন হাফিজ সাহেবের পেছনে নামাজ পড়ব। একথা বলে তিনি মাওলানা আতহার আলী রহ. এর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। মাওলানা আতহার আলী রহ. তখন বলে উঠলেন, আপনি তো হাফিজের দাদা। মাওলানা আতহার আলী রহ. পীর সাহেব ফুলতলী রহ. কে কী দৃষ্টিতে দেখতেন তা তার মন্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়। সেদিন সকল আলেমের নামাজের ইমামতি পীর সাহেব ফুলতলী রহ.ই করেছিলেন।’ উল্লেখ্য, মাওলানা আতহার আলী রহ. এই নিবন্ধকারের খান্দানের পীর ও মুর্শিদ। আমার দাদা শায়খে কামেল হযরত মাওলানা আহমাদ আলী খান রহ. তার প্রধান খলিফা। আমার আব্বা মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ. মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর ভাবশিষ্য ও প্রধান সহকর্মী ছিলেন।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে পীর, আওলিয়া ও উলামা মাশায়েখের মাধ্যমে। যারা মহানবী সা. এর অনুপম আদর্শ ও সুন্দরতম আখলাক নিজেদের মধ্যে লালন করতেন। মানুষের কল্যাণে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন। সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতেন। এসব বুযুর্গগণের আধ্যাত্মিক শক্তির বলেই দুনিয়ার জাহেলিয়্যাত পরাজিত হয়। স্বর্ণযুগের এসব ওলি দরবেশের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য ওলিয়ে কামেল সাহেব কেবলা ফুলতলী শামছুল উলামা হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ চৌধুরী রহ. (জ. ১৯১৩, মৃ. ২০০৮)। তিনি বাল্য বয়সেই দীনি শিক্ষা অর্জন করার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। কেবল গতানুগতিক আলেম বা পীরের মতো কাজ করেন নি। তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইবাদত বন্দেগী, তাসবিহ তাহলীল, জিকির মুরাকাবা পাশাপাশি সৃষ্টির সেবাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য তার অবদান তার চলে যাওয়ার পরেও পত্র-পল্লবে বিকশিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তার কিরাআত পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট লাখো ছাত্র, দীনি উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি শত সহস্র শিষ্য ও আধ্যাত্মিক দীক্ষাপ্রাপ্ত অসংখ্য মুরিদান ছাড়াও তার রয়েছে ঔরসজাত নেক সন্তান। যা একজন মানুষের পরকালীন অব্যাহত মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে থাকে। দুনিয়াতেও যারা তার মিশনকে অগ্রসর করে। এদিক দিয়ে সাহেব কেবলা ফুলতলী রহ. অনন্য। তার সন্তানদের মধ্যে সবাই উল্লেখযোগ্য। হযরত আল্লামা মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী, হযরত আল্লামা মোহাম্মদ নজমউদ্দীন চৌধুরী, হযরত মাওলানা মোহাম্মদ শিহাবউদ্দীন চৌধুরী, মুফতী মাওলানা মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী, মাওলানা মোহাম্মদ কমরউদ্দীন চৌধুরী, (একবার বোখারা-সমরকন্দ সফরের সময় সেই কাফেলায় তাকে আরো দু’য়েকজন ভাতিজা, সঙ্গী ও খাদেমসহ পেয়েছিলাম। তার অসাধারণ নম্রভদ্র আচরণ, চলা বলায় উচ্চমানের আদব ও আভিজাত্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। লাখো মানুষের মধ্যে এমন দরবেশসুলভ বাদশাহী চালচলন এখন দুনিয়ার কোথাও আর চোখে পড়ে না।) হাফিজ মাওলানা মোহাম্মদ ফখরউদ্দীন চৌধুরী ও মাওলানা মোহাম্মদ হুছামউদ্দীন চৌধুরী। সাহেব কেবলা ফুলতলী কেবল সিলেট অঞ্চলেই দীনের খেদমত, সমাজকল্যাণ ও মানব উন্নয়ন করেন নি দেশের বাইরেও তার কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল।

যুক্তরাজ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন

হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর দীনী খেদমতের পরিধি বাংলাদেশ, ভারত তথা সমগ্র উমহাদেশ ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইলমে কিরাত, ইলমে হাদীস, ইলমে তাসাওউফসহ সব ধরনের খেদমত পরিচালনার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে বহু সংখ্যক দীনী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. প্রতিষ্ঠিত এ সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।

দারুল হাদীস লতিফিয়া: হযরত আল্লামা সাহেব কেবলা রহ. ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম বৃটেনে সফরকালে সে দেশে অভিবাসী মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন। সেই বছরই পূর্ব লন্ডনের নিউ রোডের ভাড়া করে ঘরে ‘মাদরাসায়ে দারুল কিরাত মাজিদিয়া’ নামে একটি মাদরাসা শুরু করেন। ১৯৮১ সালে ক্যানন স্ট্রিট রোড, লন্ডন ঊ-১ এর ফ্ল্যাট কিনে মাদরাসা স্থানান্তর করা হয়। তখনকার সময়ে লন্ডনে মসজিদ কেন্দ্রিক প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। ২০০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এখানেই এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মক্তব ও প্রাইমারী ইসলামী শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল, কলেজ ও উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হয়। ক্যানন স্ট্রিট রোডের ‘মাদরাসায়ে দারুল কিরাত মজিদিয়া’য় কামিল (টাইটেল) ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলে ছাত্রদের স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই মাদরাসার জন্য বৃহত্তর পরিসরে ভবন ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ লক্ষ্যে বেথনাল গ্রিনে একটি ভবন কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সাহেব কেবলা নিজে লন্ডনে গিয়ে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে নিয়ে বর্তমান ভবনটি তিনি উদ্বোধনও করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি তথা কামিল জামাত পর্যন্ত মাদরাসা উন্নীত হওয়ার কারণে নতুন আঙ্গিকে মাদরাসা কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় মাদরাসার নামকরণ করা হয় ‘দারুল হাদীস লতিফিয়া’। ইলম-আমল, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং আদব আখলাকের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণে আদর্শ মুসলিম গঠনের প্রত্যয় নিয়ে দারুল হাদীস লতিফিয়া তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ফুলতলী রহ. এর বড় নাতী মাওলানা মুহাম্মদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী।

এছাড়া দারুল হাদীস লতিফিয়া নর্থওয়েস্ট ইউকে নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ওল্ডহ্যাম শহরে। ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুযায়ী এটা পরিচালিত হচ্ছে। এর প্রিন্সিপাল হিসাবে আছেন ফুলতলী সাহেবের আরেক নাতি মাওলানা সালমান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী।

আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে: ইংল্যান্ডে অবস্থানরত মুসলিম সমাজকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা, আদর্শের উপর টিকিয়ে রাখা ও দীনী খেদমত আনজাম দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. তার প্রথম বৃটেন সফরকালে গঠন করেন ‘আনজুমান আল ইসলাহ ইউকে’। বর্তমানে ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটি বড় নগরে ‘আনজুমানে আল ইসলাহ’ এর শাখা রয়েছে।

লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে: বৃটেনে বসবাসরত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কিরামের একতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দীনী খেদমত আনজাম দেওয়ার মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. প্রতিষ্ঠা করেন ‘আল ইসলাহ উলামা সোসাইটি ইউকে’। হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর ইন্তিকাল পরবর্তী সময়ে এ সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে’।

লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে: আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর নিকট ইলমে কিরাতের সনদগ্রহণকারী বৃটেন প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে তাদের মাধ্যমে সমাজের ইলমে কিরাতের খেদমত জারি রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সংগঠনটি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে কিরাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করে আসছে।

দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট ইউকে: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর নির্দেশনায় এবং তার নিকট থেকে কিরাত সনদপ্রাপ্ত কারী সাহেবগণের পরিচালনায় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের নিমিত্তে গড়ে উঠেছে অনেক কিরাত প্রশিক্ষণকেন্দ্র। দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের সিলেবাস অনুসরণে এ সকল কেন্দ্রে কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের অনেকগুলো শহরে এ সকল কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে।

মসজিদ-মাদরাসা: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর নির্দেশ, তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং তার মুরীদীন-মুহি্বীনের উদ্যোগে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে অনেক মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। কোনো শহরে মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের সংবাদ শুনলেই হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. স্বয়ং উপস্থিত থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছেন, উদ্যোক্তাদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যুুগিয়েছেন। হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কেবলা রহ. এর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ওল্ডহ্যাম জালালিয়া মাদরাসা, লতিফিয়া একাডেমি ওল্ডহ্যাম। সর্বশেষ ২০০৭ সালে বৃটেন সফরকালে তিনি ওল্ডহ্যামে একটি পূর্ণাঙ্গ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনুমোদন করেন। তার দোয়া, ইজাযত ও সহযোগিতায় লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ, টিপটপ, ওয়ালসল, ওল্ডহ্যাম, লুটনসহ সমগ্র ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার। তার ইন্তিকালের পরবর্তী সময়ে তার সুযোগ্য সাহেবজাদা ও শাগরিদগণ তার এ সকল খেদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠা করছেন নতুন নতুন মাদরসা, মসজিদ, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার। শুধু ইউরোপ নয়, আমেরিকাসহ অন্য অনেক স্থানে এ ধারার বহু প্রতিষ্ঠান ও ইসলামিক সেন্টার ফুলতলী সিলসিলার প্রসারে কাজ করছে।

সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার বার্মিংহাম ইউকে: ফুলতলী রহ. এর রুহানী আওলাদদের মাধ্যমে বার্মিংহামে সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি সেখানকার মুসলিমদের মধ্যে সহিহ ইমান-আকিদা ও ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এর ফাউন্ডার হচ্ছেন ফুলতলী রহ. এর বড় সাহেবজাদা ও (বর্তমান পীর) আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। এর প্রিন্সিপাল ও খতিব হিসাবে আছেন সিরিয়ার বিশিষ্ট আলেম শায়খ সাইয়্যিদ ফাদি জুবা ইবনে আলী।

ফুলতলী ইসলামিক সেন্টার কভেন্ট্রি ইউকে: কভেন্ট্রিতে ফুলতলী ইসলামিক সেন্টার নামে আরেকটি ইভিনিং মাদরাসা ও মসজিদ রয়েছে ফুলতলী সিলসিলার। এটি পরিচালনা করছে সিলসিলা ইসলামিক সোসাইটি ইউকে নামীয় সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানে বিকালে ছোট ছোট বাচ্চাদের সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিখানো হয়। তাজবীদ শিক্ষা দেওয়া হয়।

আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার মিশিগান, আমেরিকা: আমেরিকায়ও এই মহান বুযুর্গের রুহানী আওলাদরা মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বিশেষ করে মিশিগান আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার মসজিদে প্রকাশ্যে মাইকে আজান হয়। এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ২০০০ সালে এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর পাশেই রয়েছে খ্রিস্টানদের চার্চ। চার্চে প্রকাশ্যে ঘণ্টা বাজিয়ে খ্রিস্টানরা প্রেয়ার করেন। মুসলিমরাও মাইকে আাজান দেওয়ার জন্য কাউন্সিলে আবেদন করেন। কাউন্সিল সেখানকার অধিবাসীদের ভোটে আজান হবে কি হবে না এ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একদিকে সংখ্যাগরিষ্ট অমুসলিম অন্যদিকে নিতান্তসংখ্যক মুসলিম। স্বাভাবিকভাবে রায় আজান না দেওয়ার পক্ষেই যাবার কথা। বিষয়টি ফুলতলী সাহেবকে জানানো হলে তিনি দোয়া করেন। আল্লাহর খাস রহমতে মাইকে আজানের পক্ষেই ভোট বেশি পড়ে। এর পর থেকে আজ অবধি এই মসজিদে মাইকে আজান হয়। এর চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন ফুলতলী মসলকের আরেক খাদিম মো. আব্দুল মুতলিব সাহেব।

লতিফিয়া ফুলতলী কমপ্লেক্স: লতিফিয়া ফুলতলী কমপ্লেক্স একটি বৃটিশ কারিকুলাম অনুসারে পরিচালিত মুসলিম স্কুল। প্রতিষ্ঠানটিতে আবাসিক ও অনাবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। এর প্রিন্সিপাল ফুলতলী সাহেবের স্নেহধন্য রুহানী সন্তান মাওলানা এম এ কাদির আল হাসান। এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হযরত আল্লামা মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী।

ফুলতলী হুজুরের বৈশিষ্ট্য অনেক। এরমধ্যে লক্ষনীয় তার সমাজকর্ম। অন্য অনেক পীরের মতো তিনি দরবার স্থাপন করে অর্থ ও ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকার পথ ধরেন নি। তিনি তার সকল অর্জনকে মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন। তার প্রভাব তিনি কাজে লাগিয়েছেন কোরআন প্রচারে। দীনী শিক্ষার প্রসারে। তার সরলতার নমুনা এখনো দেখা যায় তার উত্তরসূরী হযরত মাওলানা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী বর্তমান পীর সাহেব ফুলতলীর মধ্যে। তাঁর অন্যান্য সন্তানদের মাঝেও সে দুনিয়া বিরাগী খেদমতের মানসিকতা। এ যুগে একজন প্রভাবশালী ও পুরনো আমল থেকে বহু সম্পদশালী একজন পীর এতোটা দুনিয়াবিমুখ হতে পারেন তা বর্তমান পীরসাহেব মাওলানা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী সাহেব কে না দেখলে বুঝা যাবে না।

শুধু বিদেশে নয় দেশেও আদর্শ শিক্ষিত ও আদব কায়দা সংবলিত আলোকিত ঈমানদার যোগ্য, দক্ষ মানুষ তৈরির জন্য ফুলতলীর প্রয়াস প্রশংসনীয়। সিলেটে সাহেব কেবলা রহ. এর প্রতিষ্ঠিত দু’টি অনার্স কোর্সসহ মাস্টার্স মানের কামিল মাদরাসা রয়েছে। আরো রয়েছে দেশব্যাপী ভবিষ্যৎ ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আনজুমানে আল ইসলাহ’ নামের সংগঠন। যার দ্বারা তৈরি হচ্ছে আদর্শ ও কর্মবীর আলেম উলামা। বৃটেনে অন্তত ২৫০ মসজিদে ফুলতলীর দীক্ষাপ্রাপ্ত ইমাম ও খতিব রয়েছেন। যার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তারা ফুলতলীর পীরসাহেবানের হাতে গড়া। বর্তমান যুগে দুনিয়ার লোভ ছেড়ে শুধু দীনী কাজ ও মানবকল্যাণকে নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা এসব ইমাম ও আলেম অতীতযুগের ইসলাম প্রচারক আউলিয়া দরবেশদেরই উত্তরসূরী। দুনিয়া যখন অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও ভোগবিলাসের পেছনে ছুটছে, যখন আরব শাসকরাও পথ হারাচ্ছে, যখন বহু খান্দানী পীর আউলিয়া ও খানকাহ দরবার পরিচালকদেরও পদস্খলন ঘটছে। তখন ফুলতলীর নীতি আদর্শ চোখে পড়ার মতো। হুজুরের নাতি আহমদ হাসান চৌধুরী শাহান এক প্রতিশ্রুতিশীল আলেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি ঢাকা হাইকোর্ট মাজার মসজিদের খতিব হিসেবে তার মেধা, প্রতিভা ও আধ্যাত্মিকতার সূচনা খুবই আশাপ্রদ। দাদার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আল্লাহ তাকে কবুল করুন। বৃটেনে যারা সাহেব কেবলা ফুলতলী রহ. এর মিশনকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাদের মধ্যে তালামীযে ইসলামিয়ার সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাফিয সাব্বির আহমদ ও মাওলানা এম এ কাদির আল হাসান প্রমুখ উজ্জ্বলমুখ পাশ্চাত্যে বাংলাদেশি ঐতিহ্যবাহী তরিকার প্রচারকরূপে পরিচিতি লাভ করেছেন।