নিজের বাড়ি জানিনা!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ০৮ ২০১৮, ১২:২৩

রুহিন আহমেদঃ গতকাল দুপুরবেলা সিলেট রেলস্টেশনের পাশে দাড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে ভাইয়া ডাক শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ১০-১২ বছরের একটি ছেলে হাত পেতে দাড়িয়ে আছে।
ছেলেটির একটি হাত একটা ব্যাগ ছিল । তাই সে এক হাত পেতে আমার সামনে দাড়িয়ে ছিল। সে বলল,ভাই ১০০ টাকা দিবেন । ১০০টাকা শুনে আমিত অবাক।৫ টাকা ১০ টাকা নয় পুরু ১০০ টাকা শুনে তো আমার চোখ কপালে উঠে এলো। জিজ্ঞাসা করলাম এতো টাকা দিয়ে কি করবি।ভাই ঈদের কাপড় কিনব।সারা বছর এই দুইটা ছেড়া কাপড় পরতে আর ভাল লাগে না। দেখেন একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট পড়ে আছি। প্যান্টটা নিচের দিকে ছেঁড়া আর অনেক ময়লা আর শার্ট রং হল সাদা কিন্তু মাটি লাগতে লাগতে এখন পুরো শার্ট মাটির মত রং ধরে গেছে।
১০০টাকায় কাপড় পাওয়া যায়,কি না আমার আগে জানা ছিল না।কৌতুহল হল জিজ্ঞাসা করলাম, এই বয়সে তো তোমার স্কুলে যাওয়ার কথা। তুমি ভিক্ষা করছ কেন।l আমার কথা শুনে সে কাতর কন্ঠে বলল, আমি ইচ্ছে করে ভিক্ষা করি না, শুধু দুই বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্যে ভিক্ষা করি। এটুকু বলে সে চলে যেতে লাগল । তার জন্যে খুব মায়া হলো। তার কথা শুনে তার জীবন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হল।
সে হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই আমার কথার উত্তর না দিয়ে আবার হাটতে লাগল। আমিও তার পিছু ছাড়লাম না।হাটা শুরু করলাম তার পিছনে, বার বার ডাক দিলাম কথা না শুনে হাঠতেছে। অবশেষে একশ টাকা দেওয়ার শর্তে কথা বলতে রাজি হল।
তারপর সে বলতে শুরু করল তার দুঃখের কাহিনী। আমি আমার নিজের নাম কি সেটা এখনো ঠিক মত জানি না। একেক জন একেক নামে ডাকে তবে প্রায়সবাই আমাকে মনু বলেই ডাকে।
আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার বাড়ি কোথায় আমি নিজেও জানি না । আমার যতটুকু মনে হয় যখন আমার মা আমার ছোট ভাই হওয়ার প্রসোবের সময় মারা গিয়েছিলো। তখন আমার কত বয়স ছিলো আমার মনে নাই । মা মারা যাওয়ার পর বাবা কিছুদিন পর নতুন আরেক টা বিয়ে করে। সৎ মা আসার পর থেকে বাবা আমার আর কোন খবর রাখেনা। আমার বাবা রিকশা চালানোর পাশাপাশি অবৈধভাবে টাকা-পয়সা কামাত। রাত্রে মাদক সেবন করতো ও মাদকের ব্যাবসা করত।একদিন বাবাকে পুলিশে অনেক মেড়েছিলো ,তারপর থেকে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল।অনেকদিন হাসপাতালে তাকার পর বাবা হঠাত মারা গেল।বাবার মৃত্যুর খবর শুনে সৎমা অসুস্থ হয়ে যায়।তারপর সৎমা অসুস্থতা নিয়ে নিজের ভাপের বাড়ি চলে যায়। আমি তখন একা হয়ে যাই। আত্নীয়স্বজনদের বাসায় আশ্রয় পাওয়ার জন্যে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে তাড়িয়ে দিল।তার পর অনেকদিন নিজের নানা বাড়ি থেকেছিলাম।মামার বউ আমাকে পছন্দ করেন না, কারণ আমি ছিলাম একজন মাদকসেবীর ছেলে।
প্রতিটা সময় বলতেন আমি নাকি আমার বাবার মতন হবো।আমি নাকি উনার ছেলে মেয়েদের নষ্ট করে ফেলছি। তারপর রাগ করে আরো অন্য ছেলেদের সাথে একটা রেল স্টেশনে আসি।
এসে দেখি আমার মতন অনেক শিশু টোকাই কাজ করে রেল স্টেশনে ।তারপর তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। নিজের জীবন বাচাতে আমিও তাদের মত টোকাই কাজ করি। ।রেলস্টেশনে প্লাস্টিক এর বোতল কুড়িয় ব্যাগের মধ্যে রাখি।আর পরে যখন একসাথে অনেকগুলা জমা হয় তখন মহাজনের কাছে বিক্রি করি।একদিন রোদের মধ্যে সারাদিন কোন টোকাই না পেয়ে মালবাহী ট্রেনের বগিতে একটু শুয়ে বিস্রাম নিচ্ছিলাম।কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুজতে পারি নি।যখন ঘুম ভাংলো তখন ট্রেন চলছিল।ট্রেন টা কোথায় যাচ্ছিল আমি জানি না। আম তখন ভয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। একটা সময় ট্রেন থামল অচেনা আরেকটা যায়গায়। আমি আমার বন্ধুদের খুজছিলাম ।অনেক খোজাখুজির পর তাদের পেলাম না। তারপর একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ট্রেন সিলেট এসে থামল। সারাদিন দিন তখন আমার খুব ক্ষুধা লাগছিল।আমার পকেটে কোন টাকা ছিল না। আমি ট্রেন থেকে নেমে একটা জায়গায় বসে কান্নাকাটি করছিলাম।
ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একসময় দোকান থেকে রুটি চুরি করেছিলাম। তাই লোকজন ও দোকানদার আমাকে চোর ভেবে অনেক মেরেছিল।এরপর ক্ষিধের জ্বালায় বেগ করতে গিয়ে ধরা পড়লাম। তখন অনেকে মিলে মারধর করে আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখল। যে হাত দিয়ে বেগ চুরি করেছিলাম সে হাতে রড দিয়ে অনেক মেরেছিল। এখনো এই হাত দিয়ে শক্তির কোন কাজ করতে পারি না।
তারপর এখানেও(সিলেট) আমার মতন অনেক শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখি । তখন থেকে এই সিলেট স্টেশনটাই আমার ঘর বাড়ি। রাত্রি যখন হয়ে আসে তখন এই স্টেশনের যেখানে জায়গা পাই সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ি।
তার দুঃখের কথা শুনে আমি বললাম, আচ্ছা তোমার জীবনের সপ্ন কি। সে বলল, আমার জিবনের সপ্ন যে ভাল কিছু খাবো, ভাল কিছু পড়বো, ভাল বিছানায় ঘুমাবো।
আমি খুব অবাক হলাম তার কথা শুনে। যারা দু-মুঠো ভাতের জন্যে সংগ্রাম করে বেচে থাকে তারা হয়তো এর চেয়ে বড় স্বপ্ন দেখে না!