নদীতে ভাসমান খাঁচায় মৎস চাষ: আত্ম-কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তের সূচনা করলেন রিয়াজুল

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ১০ ২০২০, ০৯:৫৯

আজিজুল হক, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: প্রমত্তা দুধকুমার নদের গর্ভে তিনি হারিয়েছেন সর্বস্ব। নদীর ধারে কোনমতে টিকে আছে তার বাড়ির একাংশ। সব হারিয়ে তিনি যখন হতভম্ভ, ঠিক তখনই তার মাথায় নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়। দুধকুমার নদের অবারিত জল রাশি তাকে মৎস চাষের স্বপ্ন দেখায়।

রিয়াজুল ভাবতে থাকেন কিভাবে পানির এই প্রাকৃতিক উৎস ব্যবহার করে মাছ চাষ করা যায়। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে রিয়াজুল চলে যান উপজেলা মৎস অফিসে। তৎকালীন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মৎস কর্মকর্তা আব্দুর রহমান খান তাকে ভাসমান খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষে উৎসাহ দেন এবং রিয়াজুলের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি দলকে এই পদ্ধতির উপর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে উক্ত দলকে আইএপিপি (ইন্ট্রিগেটিভ এগ্রিকালচার প্রোডাক্টিভিটি প্রজেক্ট) এর আওতায় ২০১৪ সালের জুন মাসে ১০টি খাঁচা তৈরীর উপকরণ প্রদান করা হয়। মাছের পোনা ও খাদ্য বাবদ সকল খরচাদি উক্ত প্রকল্প বহন করে। ৫ মাস মেয়াদি এই প্রকল্পে দারুণভাবে সফল হয় রিয়াজুলরা। বাকী সদস্যরা লাভের অংশ নিয়ে সটকে পড়লেও রিয়াজুল নিজের টাকা বিনিয়োগ করে পরবর্তী মেয়াদের কার্যক্রম একাই শুরু করেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রিয়াজুলকে। সব কেড়ে নেয়া এই নদীর পানিকে কাজে লাগিয়ে প্রবল উদ্যোমে তিনি ঘুরে দাড়িয়েছেন। আজ তিনি উপজেলার একজন মডেল মৎস চাষী। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক লোক তার মাছের খামার দেখতে আসেন। ভূরুঙ্গামারী উপজেলার মৎস চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হচ্ছে তার মৎস খামার থেকেই।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাটেশ্বরী ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে রিয়াজুলের বাড়ি। রিয়াজুল পড়াশুনা করেছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। তার বাবার নাম মৃত ওমেদ আলী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রিয়াজুল তৃতীয়।

রিয়াজুল জানান, ২০১৪ সালের আইএপিপি প্রজেক্টে সফলতার পর উপজেলা মৎস অফিস থেকে ’ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ’ প্রকল্পে‘র আওতায় তাকে আরও ১০ টি খাঁচার জন্য অর্থায়ন করা হয়। সেখানেও তিনি অবিশ্বাস্য সফলতা অর্জন করেন। তার সফলতার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করলে কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রসাশক ফেরদৌস খান স্ব-প্রণোদিত হয়ে রিয়াজুলকে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান এবং তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাগফুরুল হাসান আব্বাসীকে রিয়াজুলের প্রকল্পটি সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে ২০১৮ সালে আব্বাসী সাহেব রিয়াজুলের প্রকল্পটি পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন এবং এডিবি প্রকল্প থেকে তাকে আরও ১০ টি খাঁচার অর্থায়ন করেন। এভাবে রিয়াজুলের মোট খাঁচার সংখ্যা দাড়ায় ৩০ টিতে। পরবর্তীতে তিনি নিজ অর্থায়নে আরও ৩০ টি খাঁচা সংযোজন করেন।

রিয়াজুল বলেন, প্রতিটি ভাসমান খাঁচা তৈরীতে খরচ হয় ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। প্রতিটি
খাঁচায় পোনা ও খাদ্যসহ খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা । ৪ থেকে ৫ মাস পর প্রতি খাঁচায় মাছ উৎপাদন হয় ৮ থেকে ১০ মণ। যার বাজার মূল্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রতি খাঁচায় তার লাভ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

আবদ্ধ পানিতে মাছ চাষ এবং নদীর পানিতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আবদ্ধ পানিতে মাছের বিষ্ঠা থেকে এমোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হওয়ার কারণে মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত সহ রোগ-বালাইয়ের অনেক ঝুঁকি থাকে। কিন্তু নদীর পানিতে সেসব ঝুঁকি একদমই নেই। এছাড়াও নদীর স্রোতে ভেসে আসা খুঁদে পানা ও শ্যাওলা খুব সহজেই সংগ্রহ করে মাছের উপযুক্ত খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গত দেড় মাস যাবৎ তিনি বাড়তি কোন খাবার না দিয়ে তিনি এসব খাবারই ব্যবহার করে আসছেন। এসব খাবারের পুষ্টি মান অনেক বেশি। তাছাড়া প্রাকৃতিক পানিতে চাষ হওয়ার কারনে এই মাছ খেতেও অনেক সু-স্বাদু।

রিয়াজুল আরো জানান, শুকনা মৌসুমে উপজেলার মৎস চাহিদার বৃহদাংশ তার প্রকল্প থেকে মিটানো সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি তার প্রকল্পটি আর বড় করতে পারছেন না। প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করে তেলাপিয়া ছাড়াও অন্যান্য প্রজাতির মাছ চাষ করতে চান তিনি। ব্যাংকগুলোতে লোনের জন্য বারবার আবেদন করেও তিনি কোন সাড়া পাননি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৎস চাষের জন্য তাদের কাছে কোন বরাদ্দ নেই। তাই হতাশ হয়ে রিয়াজুল অর্থ যোগানের জন্য অন্য কোন উৎসের সন্ধান করছেন।

রিয়াজুলের সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষের স্বপ্ন দেখছেন। এই প্রকল্পটি শুরু করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। নদীর তীরে বসবাসকারী এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। তাই এই বিশাল অর্থের যোগান তাদের কাছে নেই। ফলে, নদীগুলোকে তারা এই কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না।

রিয়াজুল জানান, অন্যান্য উপজেলায় মাছ চাষের এই পদ্ধতি ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করলেও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাকে অন্যান্য জেলা ও উপজেলা থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে এই পদ্ধতির উপর তারা ধারনা নিয়ে তারা সফল হচ্ছেন। কিন্তু আমার নিজ উপজেলায় এরকম কোন উদ্যোগ দেখি না। আসলে আমরা হয় চাকুরি নয়তো ‘কামলা’ দিতেই বেশি পছন্দ করি। ব্যবসার ঝুঁকি নিতে চাই না।’ তিনি এই অঞ্চলের বেকারদের সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে এই প্রকল্পে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।

এই বিষয়ে উপজেলা মৎস কর্মকর্তা ফারাজুল কবির জানান, রিয়াজুল এই অঞ্চলের বেকারদের মডেল। ইতিপূর্বে তাকে আমরা সহযোগিতা করেছি। নতুন উদ্যোক্তা তৈরীর চেষ্টা করছি। নতুন উদ্যোক্তা পেলে আমরা তাদেরকেও সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরুজুল ইসলাম বলেন, আমি নতুন এসেছি । নদীর পানিতে ভাসমান খাঁচায় রিয়াজুলের মাছের প্রজেক্ট সম্পর্কে আমি শুনেছি। তার প্রজেক্টটি সরেজমিনে পরিদর্শন করার ইচ্ছে আমার রয়েছে। দুধকুমার নদটি এই অঞ্চলের মাছ চাষের একটি উর্বর ক্ষেত্র। শুধু রিয়াজুল নয় যারা এমন সৃজনশীল আত্নকর্মসংস্থানমূলক কাজে এগিয়ে আসবে তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে।