তরুণদের মননশীলতা ধ্বংসে টিকটক ভিডিও’র দায়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ১১ ২০২০, ১৮:৩১

মুফতি আহমদ যাকারিয়া


টিকটকের পরিচয়:
টিকটক একটি ভিডিও শেয়ারিং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সার্ভিস যা ByteDance এর মালিকানাধীন। এটি একটি বেইজিং-ভিত্তিক সংস্থা, 2012 সালে Zhang Yiming প্রতিষ্ঠা করেন।
বস্তুত টিকটক হলো একটি সঙ্গীত ভিডিও প্ল্যাটফর্ম। যেখানে আপনি একেকটি সঙ্গীতের সাথে নিজের আবেগ, অনুভূতি অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। এটি একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক। এটিকে অশালীনতার একটি প্রতীক বলেই মনে করেন সচেতন মহল। এই টিকটক হল মূলতই একটি এন্ড্রয়েড আপ্লিকেশন। যাতে একাউন্ট খুললেই আপনি গান, কবিতা, ছন্দের সাথে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শন করে ভিডিও করতে পারবেন এবং তা পোষ্ট করতে পারবেন।
টিকটকের জনপ্রিয়তার পেছনের কারণগুলো হচ্ছে:
১- এসব ভিডিও আকারে ছোট এবং ব্যবহার করা সহজ।
২- সবসময় এতে যুক্ত হয় নতুন নতুন ফিচার।
৩- ভিডিওতে নিজের কণ্ঠ মেলানো যাকে বলা হয় লিপ সিঙ্ক।
৪- ভিডিওতে অন্যের কণ্ঠ ব্যবহার।
এই অ্যাপ কতো বড়ো?
১- ২০১৯ সালের শুরু থেকেই ডাউনলোড চার্টের শীর্ষের কাছাকাছি অবস্থান করছে টিকটক।
২- গত বছর ইন্সটাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটকে টপকে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ ডাউনলোডকারী অ্যাপে পরিণত হয় এটি।
৩- এই কোম্পানির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭৫ বিলিয়ন ডলার যা রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবারের চেয়েও বেশি।
৪- করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময় টিকটকের জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। লকডাউনের কারণে ঘরবন্দী মানুষের তীব্র আগ্রহ তৈরি হয় এই অ্যাপের প্রতি। বলা হচ্ছে, টিকটক ও তার সহযোগী অ্যাপ দোইনের মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি। দোইন অ্যাপটি শুধু চীনেই ব্যবহার করা যায়।
৫- জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারতে টিকটক নিষিদ্ধ করার আগে এটি সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে দেশে দশ কোটিরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যে টিকটক ডাউনলোড করেছে।
৬- ২০১৮ সালে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ ছিল এই টিকটক।
৭- ইকোনমিক টাইমস পত্রিকা লিখছে, প্রতিমাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছে।
৮- মূলত চীনা টেক কোম্পানি বাইটডান্সের অ্যাপ টিকটক সাড়া ফেলেছে সারাবিশ্বে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই অ্যাপটি ডাউনলোড এবং জনপ্রিয়তায় হারিয়েছে সব অ্যাপকে। চীনে এই অ্যাপটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেও অন্যান্য দেশেও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে টিকটক।
৯- এক মাসে প্রায় ৮শ মিলিয়ন টিকটক মানুষ ব্যবহার করে এই টিকটক।
১০- টিকটকের প্রায় ৫৭ ভাগ ব্যবহারকারীই চীনা।
১১- টিকটক অ্যাপটির নির্মাতা “বাইটডান্স” বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামী প্রাইভেট সেটাপের অন্যতম। যাদের মূল্য প্রায় ৭৮ মিলিয়ন ডলার।
১২- টিকটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন তিনটি অ্যাপ হিসেবে।
প্রথমটি ছিল মার্কিন একটি অ্যাপ; যার নাম “মিউজিক্যাল ডট লি”। এটি শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রযুক্তি বিষয়ক চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্স ২০১৬ সালে একই ধরনের একটি অ্যাপ চালু করে যার নাম “দোইন”।
পরে বাইটড্যান্স টিকটক নাম নিয়ে সারা বিশ্বে তার প্রসার ঘটাতে শুরু করে এবং ২০১৮ সালে মিউজিক্যাল “ডট লিকে” কিনে নিয়ে তাকেও টিকটকের সাথে একীভূত করে ফেলে। বাইটড্যান্স তার অ্যাপগুলোকে চীনা মালিকানা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এরই অংশ হিসেবে “ডিজনির” শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা “কেভিন মায়ারকে” টিকটকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিযুক্ত করেছে।
টিকটক: শখের নাকি আসক্তি?
টিকটক অ্যাপ কেউ ভিডিও করছেন অর্থ উপার্জনের জন্যে আবার কেউবা বানাচ্ছেন শখের বসে। অনেকেই এসব ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে বনে যাচ্ছেন প্রসিদ্ধ তারকা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের ছোট ছোট ভিডিও আসক্তির পর্যায়ে গেলে তা তরুণ সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
এলাকার রাস্তায় হঠাৎ এমন অঙ্গভঙ্গি দেখে যে কেও প্রথমে অবাক হবেন বা হতেই পারেন। একটু ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে, এখানে ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে টিকটকের জন্য। শুধু সাধারণ মানুষ নন টিকটক আসক্তিতে এখন জড়িয়ে পড়েছেন সেলিব্রেটি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার তরুণও।
কেবল মজা বা ব্যঙ্গ নয়, অর্থ উপার্জনের জন্যেও এই মাধ্যমটি এখন দারুণ জনপ্রিয়। অবশ্য টিকটকের মতো লাইকি সহ আরও বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে সেগুলোও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়তার সাথেই চলছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহার আসক্তির পর্যায়ে গেলে তা তরুণ সমাজের জন্য ক্ষতিকর, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংসের জন্য এই টিকটক মোটাদাগে দায়ী। এই সব অ্যাপের ভিডিও শিক্ষামূলক তো নয়ই, বরং তা ব্যঙ্গাত্মক, অশ্লীল, উদ্ভট, রুচিহীন, অনভিপ্রেত। এ ধরনের কন্টেন্ট দেশীয় সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই হুমকিস্বরূপ।
নাম বিকৃত করে বলা, মানুষের আকার-আকৃতি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে এই সাইটে। আর কারণে সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় এসব নিয়ে বড় ধরনের বিবাদ সবার সামনেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আকার-আকৃতিতে মানুষের কোনো হাত নেই। আল্লাহ তা’আলা সবকিছুর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। যাকে যে আকৃতিতে তিনি ভালো মনে করেছেন, সেভাবেই তাকে সৃষ্টি করেছেন। আকৃতি নিয়ে ব্যঙ্গ মানে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। অথচ এগুলোই হচ্ছে এখন প্রতিনিয়ত। পৃথিবীতে কত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এগুলো এই সাইটে তেমন গুরুত্ব হয়ে উঠে না। যত সব আজগুবি আর বিদঘুটে আচরণ হতে পারে এর সবকিছুর নিন্দিত উপস্থাপনের জায়গা হলো এই টিকটক।
এটার মাধ্যমে তরুণ উঠতি বয়সের ছেলেরা সম্মানিত মানুষের কথা ও কাজকে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে উপস্থাপন করে তাদের মানহানি করতেছে।  এটার মাধ্যমে হাসি, তামাশা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ, অশ্লীল রঙ্গ-তামাশা করার যেন শেষ নেই।
এক মুসলমান অপর মুসলমানকে নিয়ে উপহাস করছে। অথচ এ ধরনের উপহাস, ঠাট্টা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা ইসলামে সম্পূর্ণ ভাবে নাজায়েজ। কোরআন বলা হয়েছে, ‘মুমিনগণ কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকে যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এরূপ কাজ হতে তওবা না করে তারাই জালেম।’ (হুজরাত:১১)
অথচ আজকে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের চিত্র কী? এই রঙ্গ তামাশাই যেন আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন অপরজনকে পঁচাতে পারলেই এটাকে সফলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে বয়সে জ্ঞানের রাজ্যে প্রতিযোগিতার সাথে তরুণদের বিচরণ করার কথা সেই বয়সে তারা সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় এসব টিকটকের পেছনে দৌড়াচ্ছে; এবং পরিচিত হবার পর ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। পাশাপাশি নীরবে যে নিজের ভবিষ্যত ধ্বংস করছে এর দিকে তার খেয়াল দেবার যেন কোন ফুরসত নেই।
টিকটকে জমা মজার সব ভিডিও দেখা যে কোনো বয়সী ব্যক্তির জন্য  আসক্তির কারণ হতে পারে এবং হচ্ছেও বটে। তবে বর্তমানে শিশুদের জন্য এটি চরম আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিও প্ল্যাটফর্ম তবুও এতে থাকা ভিডিওগুলো দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিমেষেই পার করে দেওয়া যায়। এ কারণে সন্তানের যে পরিমাণ সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেওয়ার কথা তা দিচ্ছে না বরং তার সব মনযোগ ঐ টিকটকের লাইক কমেন্টসে। এতে করে শিশু কিশোরদের মানসিক বিকাশে চরম পর্যায়ের সমস্যা তৈরী হচ্ছে। তার মেধার ক্ষয় হচ্ছে এসবের পেছনে যার ফলশ্রুতিতে তরুণদের জীবনের  মূল  যে কাজ তথা শিক্ষার্জন চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আর একটি তরুণ শিক্ষার প্লাটফর্ম থেকে ছিটকে পড়া মানে একটা সমাজ, একটা দেশে উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে যাওয়া। তাই এসব ব্যাপারে অভিভাবকদেরকে আরো সচেতন হতে হবে।
ফেইসবুকে লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট পাওয়ার জন্য কত ধরনের পাগলামি করা হচ্ছে তা টিকটকের কিছু ভিডিও দেখলেই বোঝা যায়। এর বিরুদ্ধে নানা কুৎসিত ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে। বলা হচ্ছে এই অ্যাপের কারণে নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা হুমকির মুখে পড়েছে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীল কন্টেন্ট ও ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও। এর ফলে তৈরি হচ্ছে একধরনের অসুস্থ মানসিকতা। অনেক পুরুষ যেমন নারী সেজে অভিনয় করছেন আবার অনেকে তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) সেজেও অভিনয়ে মেতেছেন। অনেকে টিকটকের ভিডিওয়ের জন্য দুর্ঘটনার শিকারও হচ্ছেন। মজা করার উদ্দেশ্যে টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য গিয়ে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতেছে তরুণরা; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা এসব খবর এখন সবারই জানা। হাসি-তামাশা করুন সমস্যা নেই। তবে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত। সীমারেখার মধ্যেই করতে হবে এসব। কোন জিনিসই সীমালঙ্গন করা উচিত না।
রসিকতা অবশ্যই ইসলাম সমর্থন করে। তবে রসিকতা হতে হবে সত্য ও বাস্তবধর্মী। মিথ্যাচার বা কাউকে খাটো করার জন্য কোন ধরনের রসিকতা ইসলাম সমর্থন করে না। স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা করতে পারে। বাবা তার সন্তানদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। এতে সম্পর্কে বৈচিত্র্য, স্থিরতা, নতুনত্ব ও দৃঢ়তা আসে। বন্ধন হয় শক্ত ও মজবুত। অথচ এখনকার সমাজে হচ্ছে এর উল্টোটা। ভরা মসলিসে একজনকে নিয়ে কেউ ব্যঙ্গ করল। এমন কথা তার নামে বলা হলো, যা সম্পূর্ণই মিথ্যা অথবা কাল্পনিক। সবাই হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়ল আর মিথ্যা আনন্দে আন্দোলিত হলো। লজ্জা আর অপমানে ওই ব্যক্তি তখন মুখ লুকায়। চোখে পানি এসে যায়। যারা এমন কাজ করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। রাসুল সা. বলেন; ধ্বংস ওই ব্যক্তির জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে, তার ধ্বংস অনিবার্য, তার ধ্বংস অনিবার্য। (তিরমিজি:২২৩৭)
আসলে টিকটকের কোন ভালো দিক নেই। তার সবকিছুই মন্দে ঠাসা। টিকটকের ভালো দিক রয়েছে এরকম দাবী আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারবে না। এর মন্দের ফিরিস্তি অনেক লম্বা! কত দিক বলা যাবে? যেমন প্রথমেই বলা যায় যে, টিকটকের প্রাইভেসি সেটিংস নিয়ে; এর মাত্র দুই ধরনের প্রাইভেসি সেটিংস রয়েছে।
একটা হচ্ছে ওনলি মি। অর্থাৎ শুধু নিজে দেখা যাবে।
আরেকটি হচ্ছে পাবলিক, যা সবাই দেখতে পারবে। সবার জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে আলাদা আর কোনো অপশন নেই। চাইলেই যে কেউ মেসেজ করতে পারবে। কথা বলতে পারবে। টিকটকের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে তার ব্যবহারকারীদের বয়স। বলা হয়ে থাকে যে, ১৩ বছরের বেশি যাদের বয়স শুধুমাত্র তারাই এই অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ১২ বছরেরও কম বয়সীরাও এই অ্যাপ ব্যবহার করছে নিজের বয়স গোপন রেখে।
সারা বিশ্ব যখন এই অ্যাপে মজেছে বাংলাদেশই বা আর বাদ যাবে কেন। বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয় সব শ্রেণির কাছে এই বাঁদরামো টাইপের টিকটক। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের কাছেও পৌঁছে গেছে এই অ্যাপ। যারা টিকটকে জনপ্রিয় তাদের রয়েছে লাখ লাখ ফলোয়ার।
বাংলাদেশের ফিল্ম অভিনেতা, টেলিফিল্ম ও নাটক অভিনেতা ও অভিনেত্রীসহ জনপ্রিয় তারকাদের সংলাপ নিয়ে মেতে উঠেছেন টিকটক ব্যবহারকারীরা। শুধু অভিনেতা কেন এই তালিকা থেকে বাদ যাননি গায়ক-গায়িকা, ওয়াজ মাহফিলের বক্তা এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও।
বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের অংশ, টকশোর অংশ, সংবাদের অংশ নিয়েও বানানো হচ্ছে টিকটক ভিডিও। শিশুদের বিভিন্ন কথার সঙ্গে বড়রা অভিনয় করে দেখাচ্ছেন। হলিউড, ঢালিউড, বলিউডের সেলিব্রেটিদের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিচ্ছে তারা এক নিমিষেই। মজার ছলে ভিডিও বানিয়ে অনেকেই হয়ে যাচ্ছেন সস্তা জনপ্রিয়।
সমাজের পচনশীল উদ্ভট কিছু তরুণদের মতো তারকারাও আক্রান্ত হয়েছেন এই টিকটক ভাইরাসে। পূর্ণিমা, পপি, অপু বিশ্বাস থেকে শুরু করে হালের মাহিয়া মাহি, মেহজাবিন চৌধুরী, টয়া, দিঘী পর্যন্ত টিকটক ভিডিও আপলোড করে সবার ‘বাহবা’ কুড়াচ্ছেন। নায়করাও বাদ যাচ্ছেন না। তবে নায়কদের চেয়ে নায়িকাদের ঝোঁকটাই বেশি। বিশেষকরে পূর্ণিমার টিকটক ভিডিওর জুড়ি নেই। তিনি এককভাবে কিংবা অন্য তারকাদের সঙ্গে নিয়েও মজার মজার টিকটক ভিডিও বানান। তাতে তার অভিব্যক্তি, দুষ্টুমিতে বুদ হয়ে আছেন দর্শক। কিন্তু এতে সমাজের সার্বিক উন্নয়নে কি কোন উপকার হচ্ছে?
অনেক বিরক্তিকর কথা ও ঘটনার জন্মদাতা এই টিকটক। কয়টার উদাহরণ দেব? যেমন ধরুন;
ভাল্লাগে, খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে;
এই শব্দগুলোর আবির্ভার বেশ কয়েক বছর আগে হলেও সম্প্রতি এটা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড হওয়া একটি ভিডিওর মধ্য দিয়ে। বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টের একটি অংশ থেকে এই ডায়লগের শুরু। সেই অংশটি ব্যঙ্গাত্মকভাবে পুনরায় নির্মাণ করে ডাবিং অ্যাপ টিকটকে আপলোড করেন দুই বোন। মাইক্রোফোনের বদলে ব্যবহার করা হয় মেকআপের একটি ব্রাশ। যেটা ধরে রেখেছিলেন তাদের মা। এরপর বাকিটা সবার জানা। রাতারাতি তা জনপ্রিয়তা পায়। সেই বক্তব্য আরও বহু ব্যবহারকারী তাদের ভিডিওতে ব্যবহার করেন। এভাবে টিকটক থেকে ফেইসবুকে এসে বাক্যটি ছড়িয়ে পড়ে সব ধরনের সামাজিক মাধ্যমে। এরকম আরো বহু জনপ্রিয় ভিডিওর জন্ম দিচ্ছে টিকটক। সামাজিক মাধ্যম সাইট হিসেবে ফেইসবুক বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আর অ্যাপ হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় টিকটক এটা সবাই এখন একবাক্যে স্বীকার করবেন।
নিজের সৃজনশীলতা গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এক রকম প্রতিযোগিতাই শুরু হয়েছে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছোটদের বিভিন্ন ডিভাইসের ব্যবহার। অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের হাতে মোবাইল এবং বিভিন্ন জনপ্রিয় অ্যাপের ব্যবহার এখন খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর উদ্ভট অ্যাপ সমুহের মধ্যে টিকটক হলো অন্যতম। টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের দেশে। প্রতিনিয়ত লাখ লাখ ব্যবহারকারীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এটি। তরুণ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ও এর প্রতি সন্তানের আসক্তি পিতামাতা ও অভিভাবকদেরকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। পড়া-লেখা বাদ দিয়ে সবসময় টিকটকের লাইক কমেন্টসের দিকেই তার সমস্ত মনযোগ। এই অসুস্থ মানসিকতা লালন করে বড় হওয়া ছেলেটি এক সময় সমাজ ও দশের চিন্তা বাদ দিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক দেশ এই ভিডিও অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। বিশেষকরে আমেরিকার অভিযোগ টিকটকের মতো চীনা অ্যাপ তার দেশের নাগরিকদের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। একই অভিযোগে টিকটক সহ বেশ কিছু চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে ভারত। যদিও চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি বাইটডান্স লিমিটেড বলছে, টিকটক ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় বরাবর জোর দিয়েছে তারা।
এই অ্যাপের কারণে নতুন প্রজন্মের সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠা হুমকির মুখে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই অ্যাপের কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীল কন্টেন্ট ও ব্যঙ্গাত্মক যতসব আজগুবি ভিডিও। এর ফলে প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। তারা স্বাভাবিক কথাকেও ব্যঙ্গ করে প্রচার করছে, আর এতেই তারা নিজের সফলতা জ্ঞান করছে। এসব এখন প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি বদভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
নতুন প্রজন্মকে ইন্টারনেটের আপত্তিকর আসক্তি থেকে বের করে আনতে ও দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় এসব সাইট বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করছি বাংলাদেশ সরকারকে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অশ্লীল, ব্যঙ্গাত্মক এবং অপসংস্কৃতির কনটেন্ট আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে দেশীয় সংস্কৃতির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে এসব প্ল্যাটফর্ম।
শুধু টিকটক নয় বরং দেশীয় সংস্কৃতির জন্য হুমকি রয়েছে এমন সব ধরনের সাইট বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করছি। সমাজের মানুষের জন্য ইন্টারনেটকে নিরাপদ করে দিন। এ দেশের মানুষ, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না এমন কোনো কিছুকেই রাখা উচিত না। ধ্বংসাত্মক সব কিছুকে চিহ্নিত করে তা নির্মূল করা সরকারের দায়িত্ব।
টিকটকের মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও ছড়ানো হয় অশ্লীল ও আপত্তিজনক কনটেন্ট। এর কারণে তরুণ সমাজ বিশেষকরে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের উপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এই ধ্বংসাত্মক অ্যাপ টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি উঠেছে। আশাকরি সরকার কর্পোরেট দিক বিবেচনা না করে বরং চারিত্রিক ও নৈতিক দিক বিবেচনা করে এই সাইট বন্ধ করতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।