ডিসেম্বর : রক্তশপথের মাস

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৬ ২০১৯, ১২:২৫

ইলিয়াস মশহুদ ।।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দেশমাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফল আসে এই মাসে। রচিত হয় বাঙালির নতুন ইতিহাস। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় নতুন এক দেশ-বাংলাদেশ।
ডিসেম্বর স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করা লাল-সবুজের ‘সোনার বাংলা’র। আমাদের লাল-সবুজের পতাকা অর্জন, সেই সঙ্গে সমৃদ্ধশীল একটি দেশ গড়ে তোলার রক্তশপথের কথা। মনে করিয়ে দেয় পয়তাল্লিশ বছর ধরে সেই লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই দেশে অনাহারে-অর্ধাহারে ধুকতে থাকা মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার কথা। স্বাধীন দেশে স্বাধীণভাবে মত প্রকাশের কথা। আমাদের প্রাপ্য অধিকারের কথা। আমরা কথা বলবো, রাস্তাঘাটে নির্ধিদ্বায় ঘুরে বেড়াবো, ধর্ম পালন করবো নিশ্চিন্তে, নিরাপদে; কেউ আমাদের বাঁধা দেবে না, কথা বলতে গেলে ঠুঁটি চেপে ধরবে না। চলার পথে কেউ বন্দুকের নল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকবে না, এমন রঙিন স্বপ্ন দেখেই আমরা প্রতিটি প্রহর পার করি। ভোরের সূর্য দেখি। প্রশ্ন হলো- স্বাধীনতার এই সাড়ে চার দশক অতিক্রম করেও আমরা কী স্বাধীন?

বছর ঘুরে আবারো এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। তাই এবারের ডিসেম্বর হোক অঙ্গীকারের মাস। প্রত্যয়বদ্ধ হওয়ার মাস। নতুন চেতনায় জেগে ওঠার মাস। দেশপ্রেমকে শাণিত করার মাস। অধিকার আদায়ের মাস। নতুন করে বিজয়ী হওয়ার মাস।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও আমরা জাতিগত জীবনে যা অর্জন করতে পারিনি, জাতি হিশেবে এগিয়ে যেতে আমাদের যেসব ঘাটতি রয়েছে, সেসব ঘাটতি পূরণে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবভিত্তিক আদর্শিক চেতনা সমাজ-রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিতে হবে এই মাসে।
সংবিধান আমাদের জীবনের স্বাধীনতা, ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এগুলোকে ‘মৌলিক অধিকার’ ঘোষণা করেছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে এগুলোই ভিন্নরূপে ‘সার্বজনীন মানবাধিকার’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। অথচ এই দেশে এই মুহূর্তে এগুলোর অস্তিত্ব কোথায়?

এখন যদি কেউ আমাদের প্রশ্ন করে, কতো হাজার প্রাণের বিনিময়ে আমরা পাকদের পরাজিত বিজয়ী হয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি? সরল-সোজা উত্তর- ত্রিশ হাজার প্রাণের বিনিময়ে। কতো মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে? মুখস্ত জবাব- অসংখ্য অগণিত মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। তবে আসল কথা হচ্ছে- সংখ্যায় আমাদের কিছু যায় আসে না। আমাদের কথা হল, দেশবিজয়ের দীর্ঘ এই সময়ের পরও কি আমরা প্রকৃতপক্ষে বিজয়ের স্বাদ নিতে পারছি? স্বাধীন’র মত স্বাধীন হতে পেরেছি? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে কেনো এখনো কুকুরের মত মানুষের হাতে মানুষ মরছে? কেনো প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হয় ধর্ষণের খবর? ধর্ষক কেন সমাজে মাথা উঁচু করে ঘোরে? ফাঁসীর দ-প্রাপ্তরা দলীয় রাষ্ট্রপতির কৃপায় খালাস হয়ে বেরিয়ে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করা কি বিজয়ের চিহ্ন‎? মানুষ খুন করে প্রভাবশালী হবার কারণে গ্রেফতার না হয়ে উল্টো শোকগ্রস্ত পরিবারকে মামলা না করার হুমকি প্রদান করে? কেনো ব্যাংক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে রাষ্ট্রকে দেউলিয়া বানিয়ে দেয়া? এটাই কি বিজয় অর্জনের লক্ষ্য ছিলো?
সারা বিশ্বের সামনে বড পতাকা তোলে ধরলেই কি বিজয় উদ্যাপন হয়ে যায়? সারা বছর গাঁজাখোর আর হেরোইঞ্চিদের বসবাসের সুযোগ দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর শহিদ মিনার পরিষ্কার করে ফুল দিলেই কি শহিদদের সম্মান হয়ে যায়?

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেই ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। দেশকে পিছিয়ে দিতে চায় একটি গোষ্ঠি। কোনোভাবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি তারা। এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে একটি অপাঙক্তেয় রাষ্ট্র হিশেবে প্রমাণ করার সব চেষ্টা হয়েছে। সংবিধান থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক চেতনার দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বানানোর কসরত চলছে। ঈমান-আকিদা, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর কৌশলী আক্রমণ এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংবিধান থেকে মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং বিসমিল্লাহ উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভাবদৃষ্টে মনে হচ্ছে- লাল-সবুজের এ বাংলা যেনো কোনো একটি গোষ্ঠির পৈত্রিক সম্পত্তি। এবং তারা তা-ই মনে করে। প্রতিপক্ষকে নানান উপায়ে কোণঠাসা করে রাখা, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধগতি, শিক্ষার বেহাল দশা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নৈরাজ্য, খুন-ধর্ষনের হিড়িক- এসব অপকর্ম-কুকর্ম আমাদের পিছিয়ে রাখছে।

চলমান ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। জনগণের সম্মিলিত শক্তিই সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারে। সমুলে উৎপাঠন করতে পারে। এনে দিতে পারে নতুন মুক্তি। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। পরাধীনতার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা। স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছরেও সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। দারিদ্রতা দূরিকরণ সম্ভব হয়নি। ভাব’র বিভেদ এখনো নিঃশেষ হয়নি। জাতি হিশেবে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আসেনি অর্থনৈতিক মুক্তি। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। যেদিন দেশের সব মানুষ পাবে প্রকৃত শিক্ষার আলো, পাবে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা, যেদিন সব মানুষের বাসস্থান নিশ্চিত হবে, সেদিনই অর্জিত হবে কাঙ্খিত বিজয়। সেদিনের অপেক্ষায় আছি আমরা। সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে বিজয়। বিজয়ের মাসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও আত্মত্যাগ। মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি এক সাগর রক্তে আর অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত আব্রুুর বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে এনেছিল অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন প্রিয় মাতৃভূমি। ১৯৭১ সালের এ মাসেই বিজিত হই আমরা। মুক্ত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। বিশ্বমানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত ঝকঝকে এক পতাকা। ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ঊনিশশ’ একাত্তরে ডিসেম্বর যতই এগিয়ে আসছিল, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততোই তরান্বিত হচ্ছিল। অবস্থা এমন ছিল যে, বিজয় যেনো সময়ের ব্যাপার মাত্র। এদিকে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিং¯্র পাকহানাদার বাহিনী। নভেম্বরের শেষ দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে দেয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন। তারা শীঘ্রই পরাজয়ের খেতাব নিয়ে অপমানিত হয়ে দেশে ফিরছে।
একাত্তরের রক্তঝরা এই মাসের প্রথম দিকেই গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা খড়কুটোর মতো ভেস্তে যায়। পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া তার চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বৃদ্ধি করায় ভারতও এর মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখে ভারত সরকার আঁচ করতে পেরেছিল পাকিস্তান নিশ্চিত যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিল তা নয়, কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতিও চালিয়ে যাচ্ছিল। পাক সেনাদের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজে লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না; বরং লড়াই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল।
অন্যদিকে বীর বাঙালির গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পাক হানাদাররা। যতই সময় গড়াচ্ছিল, গেরিলা আক্রমণ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পাকসেনাদের হাতে তখনও আধুনিক সমরাস্ত্র বিপুল পমিাণে মজুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকদের পরাস্ত করতে থাকে। মুক্তিপাগল বাঙালির অকুতোভয় লড়াইয়ে পাক হানাদারদের রাতে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ে। নিয়াজি বুঝতে পারেন এবার বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেই নয়। তাই মার্কিন সাহায্য নিশ্চিত করা, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ এ দেশি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন জেনারেল নিয়াজি।

পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতি স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। এ দেশের তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা সেদিন বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই একটি কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধে আবিষ্ট হয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যার যার মতো করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দেশমুক্তির মঞ্চে জাতি এক হয়। এরই মধ্যে নানা কূট-কৌশল চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু তাদের সব কূট-কৌশল নস্যাৎ করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে বিজয় পদচুম্বন করে আমাদের। অসীম ত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম, ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে বাঙালীকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালী তার মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। এ ডিসেম্বরেই পর্যুদস্ত হয় হানাদারবাহিনী। রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। বাংলার আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্য।