ডারউইনিজম ও পিয়ার রিভিউ জার্নাল সমাচার: বিজ্ঞান ও বাস্তবতা 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৫ ২০২১, ১৮:৩২

ডারউইনিজম/বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী  সমাজের বিজ্ঞানীদের একটি প্রশ্ন ইদানিং নজরে এসেছে। ‘পারলে পিয়ার রিভিউ জার্নালে পাবলিশ করে প্রমান করতে হবে বিবর্তন ভুয়া’।
এই প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই পাল্টা প্রশ্ন করছি, আগে বিবর্তনের স্বপক্ষের কোনো এক্সেপেরিমেন্টাল এভিডেন্স যেটা পিয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, এমন কিছু আমাকে দেখান, পরে বাকি আলাপ হবে। এবার কিছু বিষয় আলোচনা করা যাক।
অনেকেই আমাকে বলে, আপনি কেনো ডারউইনিজমের বিরুদ্ধে পিয়ার রিভিউ জার্নালে লেখা প্রকাশ করছেন না? এই ধরণের প্রশ্ন কলাবিজ্ঞানীদের কৌশলের একটা অংশ। বিষয় হলো, বিজ্ঞান সমাজ বিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছুই মেনে নেয় না। এটা অনেকটা আমাদের বাকস্বাধীনতার মতো অবস্থা। আপনি যত বড় বিজ্ঞানীই হোন না কেনো, আপনাকে বিবর্তন মেনে নিতে হবে, এটলিস্ট এর বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না। বিজ্ঞানের ডার্ক সাইডের মধ্যে এটা একটা। আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখানে শূন্য, হয়তো অনেকে প্রথম শুনছেন, কিন্তু এটাই নির্মম সত্য। এক্সপেরিমেন্টাল এভিডেন্স না থাকা স্বত্তেও একটা থিওরি আপনাকে মানতে তারা বাধ্য করছে।
.
 ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ এর সাথে দূরতম সম্পর্ক থাকলেও কোনো জার্নাল আপনার পেপার পাবলিশ করবে না। কিছু উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে, আমেরিকান বিজ্ঞানী ডঃ রিচার্ড স্টেনবার্গ যিনি নিজেই একজন এভোলিউশনারী সায়েন্টিস্ট, NCBI’র স্টাফ সায়েন্টিস্ট, তিনি একটা পিয়ার রিভিউ জার্নালের এডিটর ছিলেন। সেই জার্নালে স্টিফেন মেয়ারের একটা জার্নাল পাবলিশ হয়। সেই পেপারে জাস্ট একটা জায়গায় ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ শব্দটা ছিলো, তাতেই ডঃ রিচার্ড স্টেনবার্গ তার এডিটরশীপ জব হারান। তার বিশ্বাসের জন্য তাকে ‘ইন্টেলেকচ্যুয়াল টেররিস্ট’ বলতেও বাধেনি সংশ্লিট ডিপার্টমেন্টের প্রধানের। দেখুন একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীও তার কাজ সাচ্ছন্দে করতে পারছেন না, বা মত প্রকাশ করতে পারছেন না।
বিবর্তনের সাথে দ্বিমত প্রকাশের জন্য আরো কিছু বিজ্ঞানীকে চাকরি হারাতে হয়েছে বা মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে। এরকম কিছু বিখ্যাত উদাহরণ হলো, ১৪ বছর ধরে নাসাতে জব করা ডেভিড কোপেজ নামের এক বিজ্ঞানী চাকরিচ্যুত । ডঃ গ্যাব্রিয়েল অভিটাল নামের ইসরাইলি চিফ সায়েন্টিস্টকে বরখাস্ত করা হয়েছে এই থিওরির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে। জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির সেল বায়োলজির সাবেক লেকচারার ডঃ ক্যারোলিন ক্রোকার চাকরি হারিয়েছে তিনি তার ক্লাস লেকচারে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ শব্দটা উল্লেখ করেছিলেন শুধুমাত্র ওই কারণে।
স্টোনি ব্ৰুক ইউনিভার্সিটির নিউরোসার্জরীর সাবেক প্রফেসর ডঃ মাইকেল এগনোরকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়েছে শুধুমাত্র একটা স্বাক্ষরের জন্য। তার অপরাধ ডারউইনিজমের বিরুদ্ধে লেখা এক লেটারে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন।
ডঃ গিলের্মো গঞ্জালেজ, অস্ট্রোফিজিসিস্ট, আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক সহকারী অধ্যাপক। ভালোমানের রিসার্চ করা স্বত্তেও তার চাকরি স্থায়ী করা হয়নি,  অপরাধে হলো তার লিখিত একটা বইয়ের কো-অথর ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ এ বিশ্বাসী!!!
প্রফেসর রবার্ট মার্ক, বেইলোর ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিকাল এন্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিস্ট্যাঙ্গুইস প্রফেসর। তার গবেষণা কর্মের সাইটেশন ১৩০০০ এর উপর। ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ এর সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে ইউনিভার্সিটি তাকে দেয়া ফান্ডিং গ্রান্ট ফিরিয়ে নেয় এবং তার রিসার্চ ওয়েবসাইট রিমুভ করে দেয়, যদিও পরবর্তীতে  শর্তাসাপেক্ষে ওয়েবসাইট চালু করার অনুমতি দেয়।
ডঃ গুয়েন্টের বেকলি, জার্মান ফসিল বিশেষজ্ঞ, যিনি একজন বিখ্যাত এভোলিউশনারী সায়েন্টিস্ট। এভোলুশনের উপর অনেক কাজ করেছেন, অনেক নামকরা পিয়ার রিভিউ জার্নালে গবেষণা ছাপিয়েছেন। তার গবেষণার সাইটেশনের সংখ্যা তিন হাজারের উপরে। এই প্রোফাইলধারী এভোলিউশনারী সায়েন্টিস্টেরও উইকিপেডিয়া পেজ রিমুভ করে দেয়া হয়েছে তার অপরাধ তিনি ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করছিলেন।
ডঃ বেকলি, প্রায় পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে এভোল্যুশন এর পক্ষে কাজ করেছেন, তার প্রকাশনা দেখলেই অনুমান করা যায়। বছর পাঁচেক আগে তিনি জার্মানির ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে ‘ডারউইন ইয়ার’ সেলেব্রেশন উপলক্ষে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। সেখানে তিনি ডারউইনিজমের পক্ষে এভিডেন্স হিসাবে ব্যাকটেরিয়াল ফ্লাজেলা ডেভেলপমেন্টর অ্যানিমেশন পর্যন্ত শো করেছিলেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি কট্টর ডারউইনিস্ট ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি যখন একটা ভিন্নমতের বই পড়েন তখন থেকে তার ভুল ভাঙতে শুরু করে, এমনকি এতদিন তিনি যেই ব্যাকটেরিয়াল ফ্লাজেলাকে ডারউইনিজমের পক্ষে প্রমান হিসাবে দাঁড় করাতেন সেটাতেও বড় ধরণের গলদ ধরা পরে।
তার মতে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’র স্বপক্ষে যারা কাজ করে তারা অধিকতর উদার ও আলোচনায় আগ্রহী। তারা তাদের আইডিয়া কারো উপর চাপায় দেয় না। অনেকে মনে করে তিনি কট্টর ক্রিশ্চিয়ান তাই হয়তো ইভোল্যুশন ডিনাই করেছে,সত্যতা হলো, সে নিজেই বলেছে সে ছোটবেলা থেকে সেক্যুলার পরিবেশে বড় হওয়া মানুষ, তাকে বাপ্টাইজডও করা হয়নি। অর্থাৎ নামকরা এভোল্যুশন সায়েন্টিস হয়েও এভোল্যুশনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেয়া পুরোটাই বেসিস অন সাইন্স, এখানে ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই, যদিও কট্টর এভোল্যুশনিস্টরা তাকে ক্রিশ্চিয়ান পরিচয় দিয়ে মূল ঘটনা আড়াল করতে চায়।
এবার যারা কথায় কথায়  পিয়ার রিভিউ চান, তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলছি, আপনাদের অঙ্গনেরই বড় বিজ্ঞানী, যিনি একসময় এভোলুশনের পক্ষে গবেষণা ছাপিয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছেন যে এই থিওরিটা ভুলে ভরা। আপনার মস্তিস্কে জিজ্ঞাসা করুন, যেই পিয়ার রিভিউকে এভিডেন্স হিসাবে গ্রহণ করলেন, সেই পিয়ার রিভিউয়ের লেখকই বলছে ওগুলো ভুয়া। তাহলে পিয়ার রিভিউকে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ ধরার যুক্তিটা কোথায়?
শুধু কি তাই? এভোলুশনিস্টরারা এতটাই কট্টর যে অন্য ফিল্ডের বিজ্ঞানীরাও যদি এভোল্যুশন ডিনাই করে তাদেরকেও ছাড় দেয়া হয় না। এরকম কট্টরপন্থা অবলম্বন করে কিভাবে আশা করেন যে বিরুদ্ধবাদীরা কেনো বিবর্তনের বিরুদ্ধে  প্রামাণাদি হাজির করছে না? এভোল্যুশনের প্রতি বিজ্ঞানের অন্ধ ও কট্টর সমর্থন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরঞ্চ এটা একটা অবৈজ্ঞানিক পন্থা, বিজ্ঞানের নীতির সাথেও এটা বেমানান।
লেখক:
ড.সাইফুর রহমান
এম এস (নিউরো সাইন্স),
পিএইচডি(হার্ভাড ইউনিভার্সিটি)