জাতিকে জাগ্রত করতে হবে: ড. মুশতাক আহমদ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ১৮ ২০২২, ০৭:১২

(ড. মুশতাক আহমদ। পীরে কামেল, শাইখুল হাদীস, খতিব, সুবক্তা, বিদগ্ধ গবেষক এবং মৌলিক ঘরানার একজন লেখক। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছেন ১৯৮৫ সালে। ঢাকা আলিয়া থেকে কামিল পাশ করেছেন ১৯৮৬ সালে। এরপর ২০০০সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল পিএইচডি সমাপ্ত করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৮৬ সালে। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সনে। বর্তমানে তিনি সেখানে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন তরুণ আলেম ও সাংবাদিক আমিন মুনশি।  একুশে জার্নালের পাঠকদের জন্য তাঁর সেই সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো——


আমিন মুনশি: আপনার লেখালেখির শুরুটা কখন, কিভাবে? একটু বিস্তারিত শুনতে চাই!

ড. মুশতাক আহমদ: আমরা তখন ফরিদাবাদ পড়ি। আমাদের ছাত্রদের উদ্যোগে সে সময় দেয়ালপত্রিকা বের হতো। মাও. ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। মাও. আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া রহ.সহ আমরা সেই পত্রিকায় লেখালেখি করতাম। আমাদের দেয়াল পত্রিকা তখন খুব প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সেখানে মৌলিক লেখাগুলো আমাকেই লিখতে হতো। কারণ, স্কুলপড়ুয়া ছিলাম কেবল আমি। তাই মৌলিক রচনাগুলো আমাকে দিয়ে লেখানো হতো। সেখান থেকেই সূচনা। মনে পড়ে, সেখানে শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) জীবনীর উপর লিখেছিলাম। লেখাটি খুব প্রশংসনীয় হয়েছিল। কিন্তু সেটা প্রিন্ট হয়নি। এরপর আমি সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভীর (রহ.) উপর আর্টিকেল লিখেছিলাম। সেটাও বেশ সাড়া জাগানো ছিল। পরবর্তীতে এটাকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। আমি বিষয়টি নিয়ে সেমিনারও করেছিলাম। তারপর ফরিদাবাদ থেকে হাটহাজারী, সেখান থেকে মালিবাগ, অতঃপর দেওবন্দে চলে যাই লেখাপড়ার জন্য। তখনও আমি দৈনিক পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। দৈনিক বাংলা, ইনকিলাব, সংগ্রামে প্রায়ই আমার লেখা ছাপা হয়ে আসতো। পরবর্তীকালে যখন আমি #শিক্ষকতা শুরু করি তখন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফসহ বিভিন্ন কিতাবের বেশ কিছু মৌলিক লেখা আমি লিখেছি। ‘ত্রৈমাসিক ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পত্রিকা’ এবং ‘মাসিক অগ্রপথিক’ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতাম আমি। প্রথমটা হচ্ছে গবেষণামূলক। দ্বিতীয়টা হচ্ছে সাহিত্যমূলক। একসময় আমাকে পিএইচডি করতে হলো। তখন বেশ কিছু সেমিনার করতে হয়েছিল। সেগুলোতে মূল প্রবন্ধ লিখতাম।

আমিন মুনশি: ‘আমাকেও লিখতে হবে’- এই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কোথায়? কার কাছ থেকে?

ড. মুশতাক আহমদ: লেখার জগতে এই প্রেরণা মৌলিকভাবে আমার কাছে আসে ‘লাজনাতুত ত্বলাবা’র #কর্মসূচি থেকে। আমি, মাও. ইসহাক ফরিদী রহ., মাও. আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া রহ., মাও. আবু সুফিয়ান জাকি আমরা ছাত্রজীবনের সেইসময় একাডেমিক কার্যক্রম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ‘ইসলামী ছাত্র ঐক্য’ নামে একটি সংগঠন করি। পরে আমাদের এই কার্যক্রমকে আরও সুগঠিত করার জন্য আমাদের উস্তাদ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, মুফতি গোলাম মোস্তফা, মুফতি আবদুল হান্নানসহ প্রমুখের নেতৃত্বে আমাদের সংগঠনকে ‘লাজনাতুত ত্বলাবা’ নামে পুণঃবিন্যাস করে দেয়া হয়। আর এই লাজনাতুত ত্বলাবার কর্মসূচি ছিল সম্পূর্ণ একাডেমিক। আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা-চেতনা, তাদের দর্শন, তাদের জীবন-ইতিহাস, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সেই আলোকে নিজেদেরকে গড়ে তোলার একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। সেখানে আমাকে একাডেমিক নেতৃত্বে থাকতে হয়েছে বহুদিন। আর এই চিন্তা-চেতনার চর্চা আমাকে #অনুপ্রাণিত করেছে যে, আমাকেও লিখতে হবে।

আমিন মুনশি: আপনার মৌলিক বইয়ের সংখ্যা কত? এর মধ্যে সবচে’ প্রিয় বই কোনটি?

ড. মুশতাক আহমদ: আমার মৌলিক বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২০টি। আর অনুবাদ গ্রন্থ আছে প্রায় ২৫টির মত। মৌলিক বইয়ের মধ্যে সবচে’ প্রিয় বলতে গেলে আমার পিএইচডির বই। যেটা এখন ‘মাকতাবাতুল আযহার’ ছাপিয়েছে- শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.। বইটি বাংলাদেশের সুধীসমাজে এবং ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সকল গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি প্রথম সারির। তাছাড়া ‘তাহরীকে দেওবন্দ’ বইটিও আমার অসম্ভব প্রিয়। এটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রথম বই। আমার আগে এ বিষয়ে মৌলিকভাবে গবেষণামূলক #দেওবন্দ আন্দোলনকে বাংলা ভাষায় বই আকারে কেউ উপস্থাপন করেনি। আমার পরে অন্য অনেকেই করেছেন। তবে আমার বইটি দীর্ঘদিন বেফাকের মিশকাত জামাতে সিলেবাসভুক্ত ছিল। লেখালেখির ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে; তবে পরিমাণে কম। এখন নিজস্ব লেখার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠে না। কারণ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা এমফিল গবেষণা করে এখন তাদেরকে পরামর্শ ও থিসিস পরিক্ষা-নিরীক্ষা করার কাজে বেশি সময় দিতে হয়।

আমিন মুনশি: একজন লেখকের মধ্যে কি কি গুণ থাকা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? অথবা ভালো মানের লেখক হতে হলে কি কি পন্থা অবলম্বন করা দরকার?

ড. মুশতাক আহমদ: একজন লেখকের মধ্যে প্রথম গুণ থাকতে হবে- যে বিষয়ে তিনি লিখবেন সে বিষয়টি তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন। কুরআন ও হাদিসের সহি উৎস থেকে তার এই জ্ঞান অবশ্যই সমর্থিত হওয়া চাই। দ্বিতীয়তঃ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সহজ- সাবলীল ভাষা প্রয়োগ করা চাই। যেন সাধারণ পাঠকের জন্য পড়তে কোনো বেগ পেতে না হয়। তৃতীয়তঃ সুপ্রিয় আঙ্গিকে উপস্থাপনের যোগ্যতা থাকা চাই একজন লেখকের মধ্যে। বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ছোট ছোট বাক্য, উপ-শিরোনামেও সুন্দর রচনা লেখা যায়। চতুর্থতঃ লেখককে অবশ্যই লেখার ক্ষেত্রে আবেগ-অনুরাগমুক্ত হতে হবে। অন্যায়ভাবে কাউকে আঘাত করা বা আহত করা একজন ভালো লেখকের পরিচয় নয়। সমাজের যেসকল বিষয়গুলি অবহেলিত, একটি সুন্দর সম্প্রীতি সৌহার্দ্যমূলক সমাজ বিনির্মাণে যেসকল বিষয় অনুপস্থিত সেসকল দিকগুলো খুঁজে খুঁজে জাতিকে নতুন দিগন্তের #সন্ধান দেয়া একজন সচেতন লেখকের দায়িত্ব। সমাজের সকল অনাচার প্রতিহত করার জন্য একজন লেখককে দরদের সাথে এগিয়ে আসা দরকার। স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ ও কল্যাণকামিতা নিয়ে অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে লিখতে হবে শক্ত কলমে। দরদি লেখকের একটি বাক্যও অনেক সময় একটি সমাজের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মোটামোটি এই যোগ্যতাগুলি একজন লেখকের মধ্যে থাকা জরুরি।

আমিন মুনশি: লেখকদের সংগঠন থাকার আবশ্যিকতা কতটুকু- এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বা পর্যবেক্ষণ জানতে চাই!

ড. মুশতাক আহমদ: সংগঠন মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান করে। লেখকদের কোনো ফোরাম তৈরি হলে সাহিত্য রচনার শৈল্পিক গুণাগুণ নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখকদের সংগঠন বা প্ল্যাটফর্ম থাকা আমি উপকারী পদক্ষেপ বলে মনে করি।

আমিন মুনশি: ফেসবুক- ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করা একজন সৃজনশীল লেখকের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ বলে আপনি মনে করেন?

ড. মুশতাক আহমদ: ফেসবুক- ইন্টারনেট এগুলো সামাজিক যোগাযোগের অত্যাধুনিক পদ্ধতি। এ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে নিজ প্রতিভার বিকাশ সাধনে কোনো আপত্তি মনে করি না। তবে ফেসবুক-ইন্টারনেট এগুলোর পেছনে অহেতুক পড়ে থাকা কিংবা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া আমি উচিত মনে করি না। এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন-সাবধান থাকা জরুরি। যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলিতে ভালো ও কল্যাণকর জিনিস যেভাবে আছে তদ্রুপ সেখানে অনৈতিক ও চারিত্রিক বিপর্যয়েরও অনেক কিছু রয়েছে। যারা নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের জন্য মুক্তভাবে ফেসবুক-ইন্টারনেট চর্চা করা ঠিক নয়। কোনো ব্যক্তি নিজের খায়েশাতকে নিয়ন্ত্রিত রাখার দক্ষতা থাকলে তার জন্য #ফেসবুক-ইন্টারনেট থেকে অনেক উপকারী জিনিস আহরণের সুযোগ আছে। আমার মতে, নিজকে নিয়ন্ত্রিত রাখা সম্ভব হলে ইন্টারনেটের জগত পরিভ্রমণ করতে কোনো আপত্তি নেই। বরং এটাকে উপকারী মনে করি সবার জন্য।

আমিন মুনশি: ‘বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম’ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

ড. মুশতাক আহমদ: বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের একদল তরুণের সাথে আমার দেখা হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের অফিসে। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথাও হয়েছিল। তাতে আমার যা মনে হলো, এরা বয়সে নবীন হলেও তাদের ভেতরে আছে সুন্দর-স্বচ্ছ মন। তাদের অনুসন্ধিৎসা, প্রতিভার লালন ও বিকাশে তাদের প্রত্যয় জাতিকে নতুন নতুন ভাবনা উপহার দেয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সর্বোপরি তাদের নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের উচ্ছ্বলতা, প্রাণবন্ততা, সদিচ্ছা, অবিরাম সাধনা চালিয়ে যাওয়ার গভীর প্রত্যয়- এগুলো আমাকে বিমুগ্ধ করেছে।

আমিন মুনশি: তরুণ লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলুন…

ড. মুশতাক আহমদ: তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য- লিখতে হবে। মৌলিকভাবে কাজ করা শিখতে হবে। জাতিকে জাগ্রত করতে হবে। সারা পৃথিবীকে আদর্শিক চেতনায় ঝাঁকুনি দিতে হবে। এই বিশ্বাস এবং প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগুতে হবে।

আমিন মুনশি: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. মুশতাক আহমদ: তোমাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ আমাদের সকল শুভচিন্তাকে কামিয়াবি দান করুন। আমিন!

২৮.০৩.২০১৮