গলাকাটা সমাচার এবং আমাদের রুচিবোধ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

নভেম্বর ২৭ ২০১৯, ০১:১২

।। লুৎফুর রহমান ফরায়েজী ।।

রুচি বড় আজীব চিজ। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। এক খাবার এক সময় দেখলেই হামলে পড়তে মন চায়, আবার সেই খাবারই আরেক সময় দেখলে খাবার ইচ্ছে মরে যায়।

রুচিটা গিরগিটির মত। সময় ও স্থানের ব্যবধানে রং বদলে ফেলে। তবে কিছু অভিরুচি আছে আভিজাত্যের। শালীনতার। ভদ্রতার। কালের আবর্তে যা রং পাল্টায় না। কা’বার কালো গিলাফের মত। আপন মহিমায় ভাস্বর থাকে। শত ঝড় ঝাপ্টায়। সে থাকে অপরিবর্তনীয়। চির অম্লান হয়ে।

কওমী মাদরাসার মাহফিলের হারানো রুচি

আমরা যে সময় তাইসির মীযান পড়ি। ১৯ শতকের শেষ দিক। আমরা কেউ কল্পনাই করতাম না যে, কোন কওমী মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে কোন সাধারণ সুরেলা বক্তা বয়ান করবে।
মাদরাসার মাহফিল মানে, কোন বিজ্ঞ শাইখুল হাদীস, বড় আলেম কিংবা আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ পীর মাশায়েখরা বয়ান করবেন। ইসলাহী কথা বলবেন। চাই, তারা বয়ানের জগতে নামকরা হোক বা না হোক।
সুরেলা ও নিমমোল্লা বক্তার বাজার গরম ছিল আলীয়া মাদরাসা, বাজার কমিটি, গ্রাম কমিটি, যুবসমাজ ইত্যাদি কর্তৃক আয়োজিত মাহফিলে।
আমরা বড় হয়েছি মুফতী ফজলুল হক আমীনী রহঃ, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রহঃ, মাওলানা ইদ্রিস সাহেব শায়েখে সন্দীপী রহঃ, মাওলানা ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ, মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী বারাকাল্লাহু ফী হায়াতিহী, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী দামাত বারাকাতুহুগণের আাত্মশুদ্ধিমূলক হৃদয়কাড়া তাত্ত্বিক বয়ান শুনে।

কিন্তু সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে রুচিবোধ। এখনতো দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে আধা মাওলানা, আজান বিশেষজ্ঞ, নাটুকে, চুক্তিবাদী বক্তাদের আধিপত্য। হারিয়ে গেছে প্রকৃত মুখলিস আল্লাহ ওয়ালা, বিজ্ঞ আলেম, শাইখুল হাদীসদের কদর।

এখনো দাগ কেটে আছে মনে। তিন বছর আগে একবার জামালপুর থেকে ফোন এল। এলাকায় আহলে হাদীসদের দৌরাত্মে উলামাগণ পেরেশান। মাহফিল করবেন বক্তা লাগবে। ফোন দিল আমাকে।
আমি পরামর্শ দিলাম-বিজ্ঞ হাদীস বিশারদ আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহুকে দাওয়াত দিন। হুজুরকে নিলে এ বিষয়ে তথ্যবহুল আলোচনা পাবেন।

অপরপ্রান্ত থেকে মাওলানা আমাকে বলে- হুজুর কি বয়ান করতে পারেন?
আমিতো হতভম্ব। যিনি দীর্ঘ সময় যাবত তিরমিজী ও বুখারীর দরস দিচ্ছেন সুনামের সাথে, শত শত ছাত্রের সামনে ক্লাস নিচ্ছেন প্রতিদিন, তিনি বয়ান করতে পারেন কি না এ কেমন প্রশ্ন? বললাম- আপনারা কি আহলে হাদীস বিষয়ে দালিলীক আলোচনা শুনতে চান, নাকি বাজার গরম করতে চান?
যদি বাজার গরম করা মাকসাদ হয়, তাহলে বাজারী বক্তা তালাশ করুন। আমাকে ফোন দিলেন কেন?
এই হল, আমাদের হাল। দরকার কুরআন, খুঁজে কামারের ঘরে।

গলাকাটা সমাচার

বলতে দ্বিধা নেই। শব্দটা আমার মনঃপুত নয়। কারণ, ওয়াজ করে চুক্তি করে টাকা নেয়া যাবে মর্মে রাসায়েলে ইবনে আবেদীনে আল্লামা শামী রহঃ পরিস্কার বলেছেন। সুতরাং এ মাসআলা নিয়ে এতোটা কঠোরতা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা অবশ্যই ভাবা দরকার।

প্রশ্নটা এখানে নয়, প্রশ্নটা অন্যখানে। প্রশ্ন হল, গলাকাটাকে গলাকাটা বানালো কে? কিভাবে তিনি গলাকাটায় রূপান্তরিত হলেন? গোড়াটা আগে খুঁজে দেখা দরকার।

বছরে দিন হল ৩৬৫টি। একটা মানুষের কাছে যদি চার পাঁচ হাজার দাওয়াত আসে। এখন লোকটা করবে কি? যদি মানুষটা যেতে না চায়, আপনি জোর করে টাকার অংক বাড়িয়ে, কারো কারো ক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের অফার করে, আট দশজনকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে জোর করে বাধ্য করান, এরপর আবার তাকে গলাকাটা বলে গলা ফাটান, তাহলে দোষটা ঐ বক্তার না আপনার?

কেন আপনার তাকেই লাগবে? যে পণ্যের ডিমান্ড বা চাহিদা অসীম, কিন্তু পণ্যের সাপ্লাই তথা যোগান থাকে কম, সেই পণ্যের বাজারদরতো বাড়বেই। এটাতো স্বাভাবিক অর্থনৈতিক থিউরী।

প্রশ্নটা হল, যদি পণ্যটা অনর্থকই হয়, অপ্রয়োজনীয় হয়, তাহলে এর পিছনে অহেতুক ছুটে তার দাম বাড়াচ্ছেন কেন? দোষটা পণ্য বিক্রেতার নাকি ক্রেতাদের?

আমাদের রুচিবোধ

কিছু কথা এমন, যার চুলচেরা বিশ্লেষণ অশালীন। কিন্তু সংক্ষেপটা ভদ্রোচিত। যেমন বাবা কনেকে বরের হাতে তুলে দিয়ে বলল যে, ‘আমার মেয়েটা অনেক আদরের। তার হকগুলোর দিকে খেয়াল রেখো। তাকে কষ্ট দিওনা’।

কনের হক রক্ষার সংক্ষেপ কথাটা শালীন ও ভদ্রোচিত। কিন্তু হকের চুলচেরা বিশ্লেষণটা অশালীন ও অভদ্রোচিত। কারণ, হকের মাঝে তার শারিরীক চাহিদা মেটানোও শামিল। কিন্তু বাবার পক্ষে কনে জামাইকে বিস্তারিত এসব বলে দেয়াটা ভদ্র ও সভ্যতা বিবর্জিত নয় কি?

আমাদের শেরেতাজ আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী দামাত বারাকাতুহু একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি কারো নাম বলেননি। একটি চরিত্রের কথা বলেছেন। সেই চরিত্রটি কে? তিনি তা নির্দিষ্ট করেননি। সুতরাং কাউকে নির্দিষ্ট করে হযরতের বক্তব্য নিয়ে ভয়ানক চুলচেরা বিশ্লেষণে লিপ্ত হয়ে আমরা কতটুকু শালীনতার চৌহদ্দিতে থাকছি?

মাহফিলের হাদিয়া নিয়ে কুরুক্ষেত্রে তৈরী করে ফেললাম আমরা। একেকজন বিশাল হিষ্ট্রি লিখছেন ওমুক হুজুর ভালো, তিনি এই করেছেন সেই করেছেন। আবার ওমুক হুজুর খারাপ তিনি এই করেছেন সেই করেছেন।

নাম আসছে অনেক। নামগুলো দেখে যারা হাকীকত জানেন। তারা অনেকেই হাসেন। কারণ, যাদের সুফী হিসেবে দেখাচ্ছেন, তাদের চরিত্রেরও ভিন্ন দিক থাকতে পারে, যা হয়তো আপনি জানেন না। যারা জানেন, তারা আবার লিখছেন ভিন্ন কথা।

সব কিছু নিয়েই এভাবে হুলুস্থুল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার এই অসহিষ্ণু ও অসুস্থ্য মানসিকতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
কিছু বিষয় এড়িয়ে গেলে জাতির এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে বলুনতো!

এই যে, পরিস্থিতি আমি আপনি সৃষ্টি করলাম। এতে লাভটা কার হচ্ছে? আমরা ঠিক কী করতে চাচ্ছি?
১.
পুরো মুসলিম মিল্লাতের কাছে ওয়াজ মাহফিলের এ দাওয়াতী কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছি।
২.
মাহফিলের বক্তাদের দোষ প্রকাশ করার মাধ্যমে বিষয়গুলো প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর করে অবাধে মাহফিলের উপর বিধিনিষেধ আরোপের মত ভয়ানক সিদ্ধান্তের সহযোগিতা করছি।
৩.
উলামায়ে কেরামের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে উঠিয়ে দিচ্ছি।

আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন। দ্বীনের উপকার করতে গিয়ে অপকার করা থেকে রব্বে কারীম আমাদের হিফাযত করুন। আমীন।