ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে যাওয়া, মুক্তিপণ চেয়ে ফোন কল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ০২ ২০২১, ১৩:৪২

আব্দুল্লাহ মায়মূন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

গুম থাকাবস্থায় প্রথম দুই-তিন দিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে পার হলো। তাদের সব জিজ্ঞাসাই ছিলো আমাকে ঘিরে। ড্রাইভার আব্দুর রহীম কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ করতো না। সে শুধু বসে থাকতো। টেনশান করতো। কখনো গাড়ির জন্যে, কখনো নিজের মেয়ের জন্যে। সে প্রায়ই বলতো, আমি গরীব মানুষ কীভাবে গাড়ীর খরচ বহন করবো ইত্যাদি। অত্যধিক টেনশনে সে মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে যেতো। তখন তারা তাকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিত তখন সে আবার সুস্থ হত। আমার‌ও টেনশন ক্রমান্বয়ে বাড়ছিলো। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ কমে যাওয়ায় আমার তেলাওয়াত বাড়ছিলো, এখন কোনো কোনো দিন ১০-১৫ পারা করে কুরআন কারীম তেলাওয়াত হতে লাগলো।

এদিকে বাহিরে যখন আমাদের পরিবার নুসরাতকে থানা থেকে উদ্ধার করে, তখন তারা থানায় জিডি করার জন্যে বার বার চেষ্টা করেন। জিডি না করলে পরবর্তী অনেক কাজ আটকে যাবে। এক্ষেত্রে আমার বড় ভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ মুস্তাফীজ, আমার মামা জমিয়তের একাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরি, দুলাভাই মাওলানা নুমানুল হক চৌধুরী, চাচা জনাব ছয়ফুল করিম বেগ এবং খালাত ভাই আব্দুল আউয়াল শাহেদ অনেক দৌড়াদৌড়ি করেন। তারা চেষ্টা করেন ঘটনাস্থল হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানায় জিডি করতে। থানার ওসি প্রথমে জিডি নেবে বলে আশ্বাসও দেয়। তারা এ আশায় থাকেন, এজন্যে ফেসবুকসহ সামাজিক নেটওয়ার্কে ব্যাপক প্রচারের অনুমতি দেননি। কেননা পুলিশ তাদেরকে এমনভাবে আশ্বাস দেয় যে, তারা মনে করেন- যত কম প্রচার হবে তত আমাকে পেতে সুবিধা হবে। পুলিশ তখন তাৎক্ষণিকভাবে তিনজন এসআইয়ের সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করে। এদিকে হবিগঞ্জের র‍্যাবও সাথে সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এতে মোটামুটি তাদের প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসে সবাই বিশ্বাস করে নেন যে, প্রশাসন তাদের কথা রাখবে। কিন্তু জিডি নিতে যখন প্রশাসন গড়িমসি করা শুরু করে, বারবার কথা পাল্টাতে থাকে, তখন পরিবার এ ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

এর‌ইমধ্যে একবার আমার ফোন থেকেই আমার চাচা ছয়ফুল করিম সাহেবের কাছে ফোন আসে। ফোনদাতা নিজেকে অপহরণকারী দাবি করে। সে আমার মুক্তির জন্যে দশ লক্ষ টাকা দাবি করে। তখন চাচা বলেন, টাকা দিব। তবে প্রথমে মায়মুনের সাথে কথা বলাও। এতে ফোনদাতা আটকে যায়, তার ধোঁকাও প্রকাশিত হয়ে যায়৷

এদিকে স্থানীয় মিডিয়া ও জাতীয় মিডিয়া রঙ-চঙ দিয়ে এটাকে পারিবারিক কলহের জের ধরে অপহরণ শিরোনামে হাইলাইট করতে থাকে। তাদের সংবাদের শিরোনাম ছিলো ‘লন্ডনী বধুর স্বামী অপহরণ’ এ নামে। এতে মূল ভিক্টিম আমি এবং ড্রাইভার পার্শ্বীয় আলোচনায় পড়ে যাই। সংবাদ প্রচারের ধরন দেখলেই মনে হয় যে, অপহরণকারীদের প্রধান টার্গেট ছিলো লন্ডনী বধু অর্থাৎ নুসরাত। আর লন্ডনী বধুকে অপহরণ করতে না পেরে তার স্বামী অর্থাৎ আমাকে অপহরণ করেছে। এতে করে মূল ঘটনাই অন্যদিকে প্রবাহিত হতে থাকে।

এরচেয়েও অবাক করা খবর হলো, সিলেটেরই কিছু আলেম যাদেরকে তারুণ্যের অহংকারসহ বিভিন্ন অভিধায় তার ভক্তরা স্মরণ করে, এরাও নাকি ঘরোয়া আলোচনায় বলা শুরু করে যে, ঘটনা পারিবারিক কলহের জেরে হয়েছে এবং অপহরণের পিছনে নুসরাতের হাত রয়েছে৷ একজন মানুষের রুচি কতটুকু নিম্ন হলে এরকম একটি স্পর্শকাতর সংবাদ তদন্ত ছাড়াই প্রচার করতে পারে?

ওই সময় পুলিশের ডিআইজি বরাবরও আবেদন করা হয়, বিভিন্ন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতও করা হয়। তখন তাদের মুখ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা-বার্তা শোনা যায়।

আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মুকীত জালালাবাদী রাহ.। আমার গুমের পর তিনিই আমার জন্যে অনলাইনে বিশ্বস্ত মাধ্যমের ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে তিনি লিখেন, গুম-কাণ্ডের দুদিন পর একজন স্থানীয় সাবেক জনপ্রতিনিধির সাথে পূর্বপরিচিত সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশের এক সদস্যের দেখা হলেই তিনি বলে উঠেন,

—মায়মূন বেঁচে গেছে…!

—কোথা থেকে?

—ক্রসফায়ার থেকে…!

—কিভাবে?

— তার উপর ক্রসফায়ারের অর্ডার ছিলো, তার ভাগ্য ভালো। তাকে একটি স্পেশাল বাহিনী ধরে নিয়ে ঢাকা চলে গেছে।

এরপর থেকে সন্ধান লাভের আগ পর্যন্ত মায়মূন একেবারে লাপাত্তা। কত লোক কতভাবে উদ্যোগ নিয়ে সন্ধান লাভ করতে ব্যর্থ হন; এর হিসাব একেবারে কম নয়, বরং বলতে হবে অনেকটা দীর্ঘ।’

যাইহোক, যখন বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচারের কারণে মূল সংবাদের আবেদনটা হারিয়ে যাচ্ছিলো, তখন পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় যে, হবিগঞ্জ কোর্টে মামলা করবে। যেহেতু স্থানীয় থানা মামলা নেয়নি, তাই কোর্টে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে আমাকে আর ড্রাইভারকে ভিক্টিম দেখানো হয়। অজ্ঞাত পাঁচজনকে বিবাদী করে অপহরণ মামলা করা হয়।

এরপর বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার থেকে বাঁচতে মূল ঘটনা তুলে ধরতে পারিবারিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ১২ দিন পর সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য পাঠ করেন আমার বড়ভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ মুস্তাফীজ। উপস্থিত থাকেন আমার মেজো মামা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের একাংশের সভাপতি মাওলানা হাফিয মনসূরুল হাসান রায়পুরি, দুলাভাই মাওলানা নুমানুল হক চৌধুরী এবং খালাত ভাই আব্দুল আউয়াল শাহেদসহ অনেকেই।

সংবাদ সম্মেলনের নিউজগুলো ইসলামিক নিউজ পোর্টালগুলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরে, আর অন্যান্য নিউজমাধ্যমগুলো গা ছাড়া ভাব নিয়ে সংবাদ প্রচার করে।

সংবাদ সম্মেলনের পর সিলেটের উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে বারুতখানা মহিলা মাদরাসায় বুখারী শরীফ খতম করে আমার জন্যে দোয়ার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন আমার বিভিন্ন উস্তাদসহ সিলেটের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম।

ওই দোয়া মাহফিলে আমার আব্বা উপস্থিত উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে একটি বার্তা প্রেরণ করেন, “আগত উলামায়ে কেরামকে আমার সালাম বলবে এবং কষ্ট করে হাজির হওয়ার জন্য সবাইকে আমার পক্ষ থেকে শুকরিয়া জানাবে। আর বলবে, তাঁরা যেন দুআ করেন যে, মায়মূন যাদের কাছেই থাকুক আল্লাহ্ তাআলা যেন তাদের অন্তরে মহব্বত ঢেলে দেন। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তাআলা যেন নিজ রহমতে তাকে তাঁর হেফাজতে রাখেন। নিজ কুদরতে তাকে ওদের হাত থেকে নাজাত দান করেন এবং নিজ ফযল ও করমে সহী-সালামতে তোমাদের কাছে তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেন।

وما ذلك على الله بعزيز وهو على كل شيء قدير

আর যদি হায়াত না থাকে, তাহলে যেন দরজায়ে শাহাদাত দান করেন এবং আখেরাতের জিন্দেগী সুখময় করেন “।

মজমায় পিনপতন নীরবতা। বক্তব্যটি শোনার পর প্রায় সবার চোখে পানি। এরপর শুরু হয় আল্লাহর দরবারে হৃদয় উজাড় করা ফরিয়াদ আর আহাজারি। এমন আবেগঘন পরিবেশ ও দৃশ্য; যা ভাষায় বুঝানো কঠিন।

মিহনা’র পূর্ব প্রকাশিত পর্বগুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন