একটি করুণ কাহিনী

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১০ ২০২১, ২১:৩৯

মহিউদ্দিন কাসেমী

হাফেজ মাওলানা আজিম উদ্দিন। গ্রামেই থাকেন। সামান্য কৃষি জমিতে চাষাবাদ করেন। পাশের গ্রামে ইমামতি করেন। নিজ গ্রামে বেলদিয়া, পাশের গ্রাম সাধুয়া। বাড়ি হতে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে যান। একটা খাল পেরিয়ে যেতে হয়। নিজেই বাঁশ কেটে একটি সাঁকো তৈরি করেছেন। ঘুটঘুটে আঁধারে ফজরের নামাজেও নিয়মিত হাজির হতেন মসজিদে। দায়িত্বে কখনও অবহেলা ছিল না।

হাফেজ সাহেব সবার কাছে ইমাম সাব নামে পরিচিত। সকলেই জানেন তিনি মাটির মানুষ। কারও সাথে সামান্য বিবাদ পর্যন্ত নেই। তবে এলাকায় অন্যায় হলে প্রতিবাদ করেন। চোর ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের নসিহত করেন।

দুই ছেলে ও এক কন্যার পিতা মসজিদ হতে ৫০০০/- বেতন পান। মকতব পড়ালেও পৃথক কোনো সম্মানী ছিল না। তবুও মন দিয়ে নিষ্ঠার সাথে বাচ্চাদের কুরআন পড়ান। এলাকার যুবক বয়সী প্রায় সবাই হাফেজ সাহেবের কাছে কুরআন পড়েছেন।

সামান্য বেতন ও কৃষি কাজ করে আনন্দে ও সুখেই দিন কাটছিল। অভাব ছিল কিন্তু কষ্ট ছিল না। তিনবেলা খাবার জোগাতে কষ্ট হতো; কারও কাছে বলতেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে আলিম পাশ করেছে মাত্র। ছোটো ছেলেকে ঋণ করে মালদ্বীপ পাঠিয়েছেন গত জানুয়ারিতে। কিছুদিন পরই করোনা শুরু, এক টাকাও বাড়ি পাঠাতে পারেনি। লকডাউনে কাজ বন্ধ।

এত কষ্ট ও অভাবেও হাফেজ আজিম উদ্দিন ভেঙে পড়েননি। সাহস রেখেছেন। নিবিষ্ট মনে রবের কাছে চেয়ে গেছেন। হয়তো দিন বদলাবে। বড় ছেলেটার একটা চাকরি হবে। করোনা কেটে যাবে ছোটো ছেলেটা মালদ্বীপ হতে টাকা পাঠাবে৷ একটা নতুন ঘর উঠাবে।

১৯/৯/২০২০
ইমাম সাহেব এশার নামায পড়িয়েছেন। নফল নামাজ ও ইবাদত করতে একটু বিলম্ব হয়। নিজেই মসজিদ বন্ধ করেন। গ্রামের মসজিদে বেতনভুক্ত মুয়াজ্জিন থাকে না। ইমামই মুয়াজ্জিন। সব মুসুল্লি বাড়িতে চলে গেছে। নয়টার মতো হবে সময়। আজিম উদ্দিন একাকী বের হলেন। বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার খাবেন। ঘুমুবেন। আবার শেষরাতে মসজিদে আসতে হবে। রাস্তায় হাঁটছেন। ১৫/২০ মিনিটের পথ। সাঁকোর কাছে চলে এসেছেন। পেছন থেকে একজন ডাক দিল, হুজুর খাড়ান। লোকটি কাছে এসে একটি আঘাত করল। মুহূর্তেই আরও ৪/৫ জন জড়ো হল। সবার হাতে ধারালো অস্ত্র। আজিম উদ্দিন জিজ্ঞেস করছেন, কী জন্য তোমরা আমাকে মারছো?! তারা কোনো কথা শুনেনি। শুধু প্রথম চিৎকার দিতে পেরেছেন। এরপর আর কোনো আওয়াজ করতে পারেননি। ক্ষতবিক্ষত দেহ মাটিতে পড়ে থাকে৷ চিৎকারের আওয়াজ কয়েকজন শুনেছে; কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি৷ জানের মায়া সবারই আছে।

আজিম উদ্দিনের আর বাড়িতে ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে। এরপর মামলা হল। কয়েকজন ধরা পড়ল৷ আবার তারা টাকা দিয়ে ছাড়াও পেল!

আজকে গিয়েছিলাম হাফেজ মাওলানা আজিম উদ্দিন সাহেব রহ. এর বাড়িতে। শহুরে মাওলানাদের মতো তিনি ফেসবুক চালাতে জানতেন না, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ছিল না, লেখক ছিলেন না, ভক্ত মুরিদান নেই; তাঁকে নিয়ে কোনো স্মারক হবে না। তবে এতটুকু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, শহুরে মাওলানাদের চেয়ে অনেক আগে তিনি জান্নাতে যাবেন। জান্নাতিতের গুণাবলি তাঁর মধ্যে ছিল৷

তাঁর পরিবার মামলা চালাবে তো দূরের কথা, ঘরে ঠিকমতো চাল ডালও নেই। আমরা তিনজন গিয়েছিলাম৷ বারান্দায় বসে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিলাম, এটা মনে হয় দুজন খেয়াল করেননি৷ আজিম উদ্দিনের স্থানে মুহিউদ্দীনও তো হতে পারত! আমার পরিবারকে এমন অসহায়ভাবে আমার দেখলে কেমন লাগত, এটা ভেবেই হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। মানুষ কত অসহায়ভাবে বেঁচে আছে!

২০/৯/২০ তারিখে স্থানীয় পত্রিকার নিউজ এসেছে। একাত্তর টিভিও নিউজ করেছে৷ আমরা মরহুমের স্ত্রী, ভাই ও ভাতিজার সাথে কথা বলেছি। বড় ছেলের সাথে ফোনে কথা বললাম। মামলার কাগজপত্র দেখলাম। এ পর্যন্ত মাত্র একজন তাঁদেরকে দেখতে গেছেন৷ তিনি হলেন ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী। তিনিও পরে খোঁজ নেননি। কোনরকম সহযোগিতা করা হয়নি। নিদারুণ কষ্টে কাটছে দিনগুলো।

একজন ইমাম সাহেব নির্মমভাবে নিহত হলেন, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। নবগঠিত পাগলা থানা, গফরগাঁও উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলা এবং সমগ্র বাংলাদেশে ইমাম এবং আলেমদের কত সংগঠন! কত লোকজন! কত টাকা পয়সা খরচ করেন তাঁরা! কিন্তু ইমাম ও হাফেজ মাওলানা আজিম উদ্দিন বিনা কারণে নিহত হলেন! তার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে! কেউ দেখার নেই! মামলা চালানো তো দূরের কথা চাল নেই ঘরে!

আমার/আপনার ঘরে চাল না থাকার মর্ম উপলব্ধি করেছি কখনও?! আমাদের ফ্রিজ ভর্তি থাকে বাহারি মাছ মাংসে! আফসোস!

মাওলানা সাহেবের অসহায় পরিবারকে দেখা বর্ণনাতীত কষ্ট পেয়েছি।

আমাদের করণীয় কী?

* খুব দ্রুত তার পরিবারের জন্য চাল ডাল তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করা।

* আরও ডিটেইলস যোগাড় করে তার পরিবারকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা।

* ইমাম ও আলেমদের নিয়ে মানববন্ধন করা।

* মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করা।

* মামলার ব্যাপারে সহযোগিতা করা।

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের বাড়ি একই গ্রামে। তার আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে আছে খুনিরা। আর কোনে বাঁধা নেই।

গফরগাঁও ও পাগলা থানার অনেক রথি-মহারথি আলেম আছেন৷ তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ করব, একজন অসহায় ইমামের পাশে দাঁড়ান।আমার সাধ্যের সবটুকু করব। ইনশাআল্লাহ।

নিহত হাফেজ আজিমুদ্দীন, পিতা : মরজত আলী, বেলদিয়া, সাধুয়া বাজার, নিগুয়ারী; গফরগাঁও ময়মনসিংহ। সাধুয়া খলিফাবাড়ী মসজিদে ২০ বছর ইমাম ছিলেন তিনি। সার্বিক পরামর্শের জন্য 01923-543915 (বিকাশ পার্সোনাল। এবং হোয়াটস্যাপ; নম্বরটি বন্ধ আছে।)

(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।)