ঈদ হোক আমার, ঈদ হোক সবার

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১২ ২০১৮, ০৭:২৯

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুলঃ শাওয়ালের চাঁদ মানে ঈদের চাঁদ। শেষ রামাদ্বানের সন্ধ্যায় খোলা আকাশের দিকে ছোটবড় সবাই আমরা দলবেঁধে চেয়ে থাকি। ঈদের চাঁদকে খুঁজি। কাংখিত সেই চাঁদের সাথে দেখা মিললে সবার হৃদয়ে বয়ে যায় আনন্দের ঝর্ণাধারা। ধ্বনিত হয় ‘ঈদ মোবারক।’ রেডিও, টেলিভিশন ও ইউটিউবে বাজতে থাকে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় ঈদের গান ‘ও মন রমযানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ এবারের ঈদুল ফিতরেও এর ব্যতিক্রম হবে না।

ঈদ অর্থ আনন্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো বারবার ফিরে আসা। আল্লাহ তা’আলা এ দিনে বান্দাহকে তাঁর নি’আমাত ও অনুগ্রহ দ্বারা প্রতি বছর ধন্য করে থাকেন। রামাদ্বানের পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। বছর ঘুরিয়ে বারবার তিনি বান্দাহদের -কে ফিতরা প্রদান ও গ্রহণ করার সুযোগ করে দেন। এতে মানুষের প্রাণে আনন্দের সঞ্চার হয়। এ সব কারণে এ দিবসের নামকরণ হয়েছে ঈদ।

ঈদুল ফিতরে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে ফিতরা প্রদান করা। রামাদ্বান মাসের সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের নামাযের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের দান করাকে শরীয়তের পরিভাষায় ফিতরা বলা হয়ে থাকে। প্রত্যেক নারী-পুরুষ, ছোট বড়, স্বাধীন পরাধীন, ধনী গরীব সকলের ওপর ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। আর এ ফিতরা, যারা ফকির ও মিসকিন তারাই গ্রহণ করবে।

ঈদুল ফিতর সর্বপ্রথম পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর পহেলা শাওয়াল, শুক্রবার ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদরে বিজয় লাভের ১৩দিন পর। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, মহানবী সা. মদীনায় এসে জানতে পারেন যে, এখানকার অধিবাসীগণ বছরে দু’দিন খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব উদযাপন করে। মহানবী সা. তাদের কাছে জানতে চাইলেন- এই যে দু’দিন উৎসব কর তা কিসের জন্য? তারা বলল- জাহিলিয়াতের যুগে এই দু’দিন আমরা খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তি ও আনন্দ-উৎসব করতাম। এ কথা শুনে তিনি তাদের বললেন – “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের দু’দিনের বদলে দু’টি উত্তম দিন দান করেছেন আর তা হচ্ছে, কোরবানির দিন এবং সিয়াম ভাঙার দিন।”

ঈদুল ফিতর বা সিয়াম ভাঙার উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ-সৌকর্যমণ্ডিত, যা মানবতার বিজয়বারতা ঘোষণার পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথ নির্দেশ করে। মহান রাব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁরই ইবাদতের জন্য। মানুষ পৃথিবীতে আসার হাজার হাজার বছর আগে সব মানুষের রুহের কাছ থেকে আলমে আরওয়া বা আত্মার জগতে আল্লাহ শপথ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সমস্ত আত্মাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেছিলেন: ‘আলাসতু বি রাব্বিকুম’ আমি কি তোমাদের রব নই? সব আত্মাই এক বাক্যে বলেছিল: হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। এই অঙ্গীকারবদ্ধ মানব রুহ পৃথিবীতে বিশেষ আকৃতির দৈহিক কাঠামোয় অবস্থান গ্রহণ করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পৃথিবীতে আগমন ঘটে। আল্লাহর কাছে সে যে অঙ্গীকার করেছিল, পৃথিবীতে এসে তা রক্ষা করার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা। ঈদুল ফিতর সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমাদের সমাজে ঈদের দিনে সবাই চেষ্টা করে বছরের অন্য দিনগুলো থেকে একটু ভাল খেতে। ভাল পোশাক পরিধান করতে। মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলতে। দুঃখ-বেদনা মনের ভেতর চাপা দিয়ে রেখে হলেও মন উজাড় করে একটুখানি হাসির ঝিলিক বিলিয়ে দিয়ে ঈদ উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তুলতে। কিন্তু অনেকেই পারলেও সমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পারে না। তারা বরাবরই ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকে। যখন আমরা সবাই ঈদের আয়োজন ও আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকি তখন তারা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। ভিক্ষার ঝুলিটি ঈদের দিনেও তাদের হাত থেকে বিরতি নিতে পারে না। অভাবের তাড়নায় খুশির এ দিনেও বের হতে হয় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বাবা-মায়ের জন্য ছোট্ট একটা উপহার, ছেলে মেয়েদের জন্য নতুন জামা-কাপড়, প্রিয়জনদের জন্য উপহার সামগ্রী সহ কিছু না কিছু সবাই এ দিনের জন্য কিনে আপনজনদের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের দ্বারা এসব কখনো পুরণ হয় না।

ধনী-গরিব, আমির-ফকির, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব মানুষ মিলে একই আনন্দ অনুভবে এক মহা ঐক্য ও সংহতির মিলন মোহনায় এসে দাঁড়াবার এক অনন্য ব্যবস্থা এই পবিত্র ঈদুল ফিতর হলেও আমাদের দেশে বাস্তবে তা নেই। ঈদুল ফিতর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দিলেও আমরা আজও পরিপুর্ণ শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি। ঈদে ধনী, গরীব, জাত, বর্ণ নেই কোন ভেদাভেদ এ কথা সবাই মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবে আমরা প্রমাণ করতে পারছি না। এসব রাষ্ট্র ও আমাদের ব্যার্থতা। রাষ্ট্র ও আমরা এর দায় এড়াতে পারি না।

আমাদের এ সমাজে এমনও কিছু মানুষ রয়েছেন, যাদের ঘরে ঈদ আসে প্রতিদিন। যাদের পুরো জীবনটাই আনন্দ আর হাসি-খুশির মধ্য দিয়ে কাটে। অথচ যারা জীবনযুদ্ধে পরাস্ত, হতাশাগ্রস্ত-বঞ্চিত, যারা জন্মগতভাবে গাছতলা আর আর ফুটপাতের বাসিন্দা তাদের ঘরে বছরেও ঈদ আনন্দের ছোয়া লাগে না। আনন্দ, সুখ কি জীবনে তারা অবলোকন করতে পারে না। এ জনগোষ্ঠী সারাটি জীবন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে অবহেলিত। এবারের ঈদেও হয়তো অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর গায়ে নতুন জামা লাগবে না। তাদের ঘরে হয়তো রকমারি সুস্বাদু খাবার তৈরী হবে না। তাদের ঘরের শিশু- কিশোরদের মাঝে হয়তো ঈদ আনন্দের ছোয়া লাগবে না। এসকল বনী আদমের জীবনে যদি ঈদ আনন্দের ছোয়া না লাগে তা হলে আমাদের জন্য ঈদের এ আনন্দোৎসব তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে কি করে? এ সকল বনি আদমকে আনন্দের বাইরে রেখে জাতীয় জীবনে ঈদের পরিপূর্ণতা আসতে পারে না। ঈদের এ আনন্দোৎসব আমাদের জন্য তখনই তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে যখন তা একটি সর্বজনীন রূপ নেবে। জাতীয় জীবনে ঈদের পরিপূর্ণতা তখনই আসবে যখন আমরা ঈদের আনন্দকে গরীব, দুঃখী, অসহায়, বঞ্চিতসহ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারব।

ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকা চলবে না। সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার ভেতর দিয়েই ঈদের আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। ইসলাম ধর্মে ধনী-গরিবের মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার সুযোগও করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের অভিভাবক ও সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়ে সবার সাথে তাদেরকেও উৎসবের আওতায় নিয়ে আসা। কমপক্ষে ঈদের দিনটিতে ভিক্ষা করা থেকে তাদের বিরত রাখা। লিল্লাহ, সদকা, যাকাত এ সব ঈদের দিনের জন্য না রেখে রামাদ্বানের শুরুতেই বন্টন করে দিলেই ভাল হয়। অসহায় গরিব পরিবারগুলো ঈদের আগে কিছু পেলে হয়তো তাদের মনের মতো করে ঈদ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। রামাদ্বান মাস যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বার্তা দিয়ে যাচ্ছে তাকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রের অভিভাবক ও সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো সময়ের অপরিহার্য দাবী।

বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ইসলামের ভুমিকা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও শাশ্বত জীবন বিধান। যা আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো বীভৎস সমাজ শরীরে সুস্থতার ঔষধ সেবন করে নিষ্কলুষ সুস্থ প্রশান্তির সমাজ গড়তে সক্ষম হয়েছিল। সক্ষম হয়েছিল সর্বনিকৃষ্ট হতে সর্বোৎকৃষ্ট জাতি সৃষ্টি করতে। মানুষকে দিয়েছিল মানুষ হিসেবে বেচে থাকার ন্যায্য অধিকার। সমাজে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সর্বক্ষেত্রে চিরন্তন এবং শাশ্বত বিধি-বিধান। ইসলাম বৈষম্য সমর্থন করে না। তা সত্ত্বেও, আমাদের দেশে দিন দিন ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এ বৈষম্য যেকোন সর্বজনীন উৎসবের আনন্দকে ক্ষুণ্ন করে। যদিও ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে আমাদের দেশে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠেনি, তারপরও রামাদ্বান যে চিত্তশুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতরের দিনে সেই শিক্ষাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

শেষ কথায় বলতে চাই, ঈদ হোক আনন্দের। ঈদ হোক আমার। ঈদ হোক সবার। ধনীর পাশাপাশি গরিবের জীর্ণ কুটিরেও ‘ঈদ’ আসুক আনন্দের বার্তা নিয়ে। আসুক বিনম্র পদভারে। আসুক সবার ঘরে ঘরে অনাবিল খুশির ডালা সাজিয়ে। আনন্দের বন্যায় ভেসে যাক সব দুঃখ-দৈন্যের আবর্জনা। সবার মুখে অন্তত এ দিনটিতে হাসি ফুটুক এটাই প্রত্যাশা। সবাইকে ঈদ মোবারক।