ইসলামে সত্যবাদিতার গুরুত্ব

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১১ ২০২১, ০০:০৫

আহমদ যাকারিয়া

মানুষ সামাজিক জীব। আমরা একে অপরের সঙ্গে চলতে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়, লেনদেন হয়। সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রেও কথা দেয়া নেয়া হয়। জীবনের চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের আলাপ আলোচনা, কথা বার্তা, লেনদেনে জড়িয়ে পড়তে হয়। ব্যবসা না হয় চাকুরী সব ক্ষেত্রে আমাদের হয় সত্যবাদী অথবা মিথ্যাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে। তবে যিনি সত্যবাদী হন, তিনি হন বিশ্বস্ত এবং সকলের প্রিয়। আমরা জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে সত্যবাদী ব্যক্তির ওপর নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারি। আল্লাহ তায়ালার কাছে ইহকালে এবং পরকালে সত্যবাদী ব্যক্তি পুরষ্কার পেয়ে থাকেন। একজন সত্যবাদী আল্লাহ তায়ালা ও মানুষের কাছে অধিক প্রিয়। আল্লাহ তায়ালা সত্যবাদীদের মর্যাদা দিয়েছেন এবং মানুষকে সত্যবাদীদের সাহচর্য নেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন।

সত্যবাদিতার মর্যাদা:
সত্যবাদিতা এটি একটি মহৎ গুণ। শরিয়ত যে সকল চারিত্রিক দিকের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে সেগুলোর মাঝে সত্যবাদিতা অন্যতম। এটি একটি সুউচ্চ আদর্শ। মহামানবগণই এ গুণটি অর্জন করেন। আর অপদার্থরা এ থেকে পিছিয়ে থাকে। এ কারণেই এটি ছিল সমস্ত নবীগণের অবিচ্ছিন্ন গুণ। ঠিক এর উল্টো ছিল মুনাফেকদের অবস্থা। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সততা ও সত্যবাদিতায় সমূহ কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে। সত্যবাদিতার পুরস্কার জান্নাত, আর মিথ্যাবাদীতার শাস্তি জাহান্নাম।

ইসলাম সত্যবাদিতা ও সত্যবাদীদের সম্মান করে, মর্যাদা দেয়। আর যারা মিথ্যাবাদী তাদেরকে ঘৃণা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেয়। মিথ্যা ভয়ংকর খিয়ানতের আলামত; নিফাক ও কপটতার আলামত। হাদীসে এসেছে: ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে।’ (বুখারী)

হজরত হাসান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা. থেকে মুখস্থ করেছি, ‘যা তোমাকে সন্দেহে পতিত করে, তা ছেড়ে দিয়ে এমন বস্তুর দিকে যাও, যা তোমাকে সন্দেহে পতিত করে না। সততা ও সত্যবাদিতা নিশ্চয়ই প্রশান্তিদায়ক আর মিথ্যা সন্দেহ সৃষ্টিকারী।’ (তিরমিজি)

এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ সত্য কথা বলে মনে প্রশান্তি লাভ করে, যদিও তা নিজেদের বিরুদ্ধে যায়। অন্যদিকে মানুষ মিথ্যা বলে মানসিকভাবে চিন্তিত থাকে। ভয় করে লোকসমাজে আমার মিথ্যা ধরা পড়ে যায় কি না।
সত্যের বিপরীত বস্তু হলো মিথ্যা। মিথ্যা শয়তানের অন্যতম ধারালো অস্ত্র। মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। মিথ্যাবাদী মানবসমাজের বড় শত্রু।

নবী সা. বলেছেন যে, ‘এটি একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতা যে তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছ এবং সে তোমাকে বিশ্বাস করে, অথচ তুমি তাকে মিথ্যা বলছ।’
(আততারগিব, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৫৯৬)

কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসীকে সত্পথে পরিচালিত করেন না।’
(সুরা : যুমার, আয়াত : ৩)

সত্যবাদীতার ফলাফল অনেক রয়েছে। তন্মধ্যে―

(১) সত্য নেক আমলের দিকে ধাবিত করে আর নেক আমল জান্নাতের পথ দেখায়।

(২) সত্যবাদী আল্লাহ তাআলা ও মানুষের নিকট প্রিয়।

(৩) সত্য মানুষকে ইহকাল ও পরকালের ক্ষতি থেকে সংরক্ষণ করে।

(৪) সত্যবাদিতা ঈমানের পূর্ণতাদানকারী গুণ। সত্যবাদিতা নির্ভেজাল ও নির্মল ঈমানের জন্ম দেয়। সত্যবাদী ব্যক্তিরাই প্রকৃত অর্থে দুনিয়া-আখিরাতে সফলকাম হয়ে থাকে। সত্যবাদী-সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তিরাই আল্লাহর ওপর যথোপযুক্ত তাওয়াক্কুল ও ভরসা রাখে। কল্যাণকর কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং অকল্যাণকর কাজে হয় প্রতিবাদী। এসব কারণেই আল্লাহ মুমিনদেরকে তাকওয়া, আল্লাহ-ভীত ও সত্যবাদী লোকদের সঙ্গ অবলম্বন করার জোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাই ইসলামে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ও সত্য সাক্ষ্য দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে- ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সহিত মিশ্রিত করিও না এবং জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিও না।’ (সুরা বাকারা : ৪২)

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ (সূরা আত-তাওবা : ১১৯)

সত্যবাদীদের বলা হয় সাদেকীন। এর অর্থ যারা বোধ ও বিশ্বাসে সত্যবাদী, কাজে সত্যবাদী এবং লেনদেন, বেচাকেনাসহ সকল ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী।

মিথ্যার অনেক খারাপ পরিণতি রয়েছে। তন্মধ্যে―

(১) মিথ্যা মুনাফেকদের খাসলত বা অভ্যাস।

(২) মিথ্যা যে ব্যক্তির অভ্যাসে পরিণত হয় আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যাবাদীদের কাতারে লেখা হয়। এটি অত্যন্ত খারাপ দিক। কোন ব্যক্তি তার পরিবার অথবা সঙ্গীদের নিকট মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হতে চায় না। অতএব সে কীভাবে তার খালেকের নিকট এমনটি হতে চায় ?

(৩) মিথ্যাবাদীর সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য।

(৪) কখনো কখনো দেখা সে সত্য বললেও তা গ্রহণ করা হয় না। কেননা লোকজন তার কথার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ইবনে মুবারক রহ. বলেন : মিথ্যার সর্বপ্রথম শাস্তি হলো তার সত্য কথাও গ্রহণ না করা।

(৫) মিথ্যা বলার কারণে সমাজে কপটতার প্রসার হয়। কেননা সব ধরনের কপটতার উৎস হলো মিথ্যাবাদিতা। বহু অপরাধের সঙ্গে মিথ্যাবাদিতা জড়িত। মিথ্যাবাদীরা নিজেদের ওপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীরা সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীদের দায়িত্বজ্ঞান লোপ পায়। মিথ্যাবাদীদের সমাজে কোনো সম্মান থাকে না। তাই তারা নির্লজ্জের মতো যেকোনো ধরনের কাজে লিপ্ত হয়। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়।

সত্যবাদীতার পুরুষ্কার: সত্যবাদী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন।

‘আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকার করবে। তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে; যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নদী। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল।’
(সূরা আল মায়েদা : ১১৯)

‘এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর যে, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা।’
(সূরা ইউনুস : ২)

সত্যবাদিতা এমন মহৎ গুণ যে আল্লাহ নিজেই এ গুণে গুণান্বিত বলে উল্লেখ করেছেন। সত্যবাদিতা আল্লাহর গুণ। আর মুমিন মাত্রই আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হতে চান। ইরশাদ হয়েছে ‘আর কথায় আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী কে’?
(সূরা নিসা : ৮৭)।

শেষকথা:
সত্যবাদিতা শুধু কথায় নয়, কর্ম ও সার্বিক অবস্থায় প্রযোজ্য। কথার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতার অর্থ সকল প্রকার মিথ্যা থেকে নিজের জবানকে হেফাজত করা। কর্মে সত্যবাদিতা হলো ব্যক্তির অন্তর ও বাহির একরকম হওয়া। ভেতরে একরকম বাইরে অন্যরকম এরূপ না হওয়া। যাতে ব্যক্তির কথা ও কাজে মিল থাকে। সার্বিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের সত্যবাদিতা। যেমন ইখলাস ও ভয়, তাওবা ও আশা, যুহদ, আল্লাহ ও তার রাসূল সা. এর মোহাব্বাত, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা।

একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সত্যবাদিতার ফজিলত ও মিথ্যাবাদিতার খারাপ পরিণাম সম্পর্কে জানা উচিত। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিকভাবে আমল করার তওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।