ইসলামী ব্যাংক চরম সঙ্কটে!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ২৭ ২০১৮, ১৪:৩৯

দেশের ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক। কয়েক বছর আগেও এ ব্যাংকের সুনামের কমতি ছিল না। কিন্তু ব্যাংকটিতে সরকারের হস্তক্ষেপে দফায় দফায় রদবদল আর অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকে। আর্থিক সংকটে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকটি। নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এক সময় আমানতকারীরা ছুটতেন ইসলামী ব্যাংকের পেছনে, এখন আমানতের পেছনে ছুটছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের এই বেহাল অবস্থায় শঙ্কিত গ্রাহকরা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পুরো আর্থিক খাতেই বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। গত বছরের জানুয়ারিতে মালিকানা বদল ও ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তনের মাত্র ১৫ মাসেই আস্থার সঙ্কটে ভুগছে ব্যাংকটি। এর কারণ হিসেবে অব্যবস্থাপনা, লোভ ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের কাছে রাতারাতি পুরো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া এবং কয়েকজন পরিচালকের অযাচিত হস্তেেপ ব্যাংকটি এমন দুরবস্থায় পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে আমানত এসেছে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা, এ সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে যে পরিমাণ আমানত এসেছে, তার তিন গুণ ঋণ দিতে হয়েছে ব্যাংকটিকে। এই ঋণ কোথায় গেছে এ নিয়ে মুখ খুলতে চাইছে না ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কেউই। এমনকি ব্যাংকটিতে চাউর আছে এই ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নির্দিষ্ট একটি স্থানে এই ঋণ গেছে। একই সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট স্থানে নতুন করে বড় অঙ্কের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন নিয়েও ব্যাংকটির নতুন মালিকদের সঙ্গে পরিচালনা পরিষদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আর তাই ভবিষ্যতে মানি লন্ডারিং মামলা, দুদকের হয়রানিসহ নানা ঝামেলা এড়াতেই গত ১৭ এপ্রিল পদত্যাগ করেছেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এছাড়া সম্প্রতি একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ও তিনজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (ডিএমডি) একযোগে পাঁচজন পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া নিজেদের দ্বন্দ্বে গত বছর ব্যাংক ছেড়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুল আলম। : সূত্র মতে, এক সময়ে আমানতকারীদের আস্থার অন্যতম নাম ছিল ইসলামী ব্যাংক। অধিকাংশ গ্রাহকই ছুটতেন ইসলামী ব্যাংকে। অথচ মাত্র কয়েকদিনে বেসরকারি খাতে দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংক শুধু আমানতের পেছনে ছুটছে। গত বছরের জানুয়ারিতে বাজার থেকে নতুন শেয়ার কিনে ব্যাংকটির মালিকানা বদল হয়ে চলে আসে চট্টগ্রামবিত্তিক শিল্প গ্রুপ এস আলমের কাছে। মালিকানা বদলের পরপরই ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের পর এই প্রথম বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ল ব্যাংকটি। আর তাই টাকার অভাবে ঋণ দেয়ার কার্যক্রম ছোট করে এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত ৯২ শতাংশে হয়ে গেছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত হারের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান মোট আমানতের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে মুদারাবা আমানত ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর বাকিটা খরচ ছাড়া (কস্ট ফ্রি) আমানত। ব্যাংকটি বিনিয়োগ রয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ ৭৪ হাজার ৮৭ কোটি এবং বাকিটা শেয়ার বিনিয়োগ। সে হিসাবে আইডিআর ৯১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়ে গেছে। অথচ ২০১৭ সালের শুরুতে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬৭ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ও ঋণ ৬১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকটির ইসলামিক বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ৫ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের শুরুতে আমানত বেড়ে হয় ৭৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ও ঋণ বেড়ে হয় ৭০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। : ইসলামী ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, পরিবর্তনের আগমুহূর্তেও ব্যাংকটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ছিল। কিন্তু পরিবর্তনের পর তারা যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছে, ঋণ দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সীমা ছাড়িয়ে ইসলামী ব্যাংক প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ সাধারণ মানুষ নয়; গেছে ব্যাংকটির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থানে। আর সংকটের কারণও সেটাই। এমনকি অর্থসংকটে পড়ে সরকারের ইসলামী বিনিয়োগ বন্ডে থাকা টাকাও তুলে নিয়েছে ব্যাংকটি। বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমার মধ্যে আনতে ব্যাংকটিতে ঋণ ফিরিয়ে আনতে হবে, অথবা আমানত বাড়িয়ে অনুপাত সমন্বয় করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বলছেন, আমানত বৃদ্ধির যে হার, তাতে এ সীমা সমন্বয় করা ব্যাংকটির জন্য কঠিনই। : এদিকে মালিকানা বদলের পর ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি মালিকানা কমে গেছে। আস্থাহীনতায় অনেকেই ব্যাংকের মালিকানা ছেড়ে দেন। ব্যাংকটির শুরুতে বিদেশিদের অংশ ছিল ৭০ শতাংশের মতো, বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসার পর থেকে অনেকের কাছে বিষয়টি ধোঁয়াটে মনে হয়েছে। বিনিয়োগ-আমানত অনুপাতটা ৯২ শতাংশে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। এটা স্বাভাবিক যে ঋণ দেয়ায় আগে এত আগ্রাসী হওয়ায় এখন রণশীল হতেই হবে। : সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেকোনোভাবেই হোক আমানতকারীদের কাছে এমন একটি বার্তা রয়েছে যে, ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। এটা দূর করতে হবে। ইসলামী ব্যাংক যেহেতু দেশের বড় ব্যাংক এবং এর তি মানে দেশের তি, তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এর ব্যাপারে বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে। অর্থাৎ পরিচালনা পরিষদ যাতে সঠিক ভূমিকা পালন করে, সিদ্ধান্ত নেয়ার েেত্র রাজনৈতিক হস্তপে যাতে না থাকে। : আরাস্ত খানের পদত্যাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন : ঢাকার একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে ২১ জন পদস্থ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ ও ২টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৯শ’ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন না করায় আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। সূত্রমতে কয়েক মাস আগে ইসলামী ব্যাংকের ২১ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার জন্য আরাস্তু খানের কাছে একটি তালিকা পাঠানো হয়। এর মধ্যে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের নাম ছিল। এ ২১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে ঠুনকো অভিযোগ আনা হয় এসব ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত অথবা দলটির শুভানুধ্যায়ী। এদের মধ্যে ৫ জন পদস্থ কর্মকর্তা চাপের মুখে গত ৩ এপ্রিল তাদের পদ থেকে এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ২ দিন পর তাদের পদত্যাগপত্র যথারীতি গৃহীত হয়। এদের মধ্যে ছিলেন একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৩ জন ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও ১ জন সিনিয়র নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান। : কিন্তু এখানেই বিষয়টির সমাপ্তি ঘটেনি। ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের ওপর তালিকাভুক্ত অপর ১৬ জনকে বরখাস্ত করার জন্যও চাপ দেয়া হয়। কিন্তু আরাস্তু খান এতে সম্মত না হয়ে বলেন এ ধরনের বিপুলসংখ্যক পদস্থ নির্বাহীদের বরখাস্ত করা হলে ব্যাংকে জ্ঞানসম্পন্ন ও দক্ষ লোকের বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সূত্রমতে একজন প্রভাবশালী পরিচালক এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংক থেকে জামায়াত-শিবিরের লোক মুক্ত করতে উৎসাহী নন বলে আখ্যায়িত করেন এবং সরকারের একটি মহল তা লুফে নিয়ে এ অপপ্রচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে আরাস্তু খানকে পদত্যাগ করতে বলা হয় এবং গত ১৭ এপ্রিল তিনি পদত্যাগ করেন। বোর্ড তাৎক্ষণিকভাবে তার এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং কোনো কালক্ষেপণ না করে উক্ত পদে অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নাজমুল হাসানকে উক্ত পদে সমাসীন করেন। এর আগে নাজমুল হাসান ইসলামী ব্যাংকের একজন ইনডিপেনডেন্ট পরিচালক ছিলেন। আরাস্তু খানের পদত্যাগের অপর একটি কারণ ছিল বড় ধরনের কোনো ঋণ প্রদানের তিনি বিপক্ষে ছিলেন। তিনি একটি বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৪শ’ কোটি টাকা ঋণ দিতে অস্বীকার করেন। তিনি ব্যাংকের তহবিল ঘাটতির কারণে তাদের ঋণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। অপর একটি ব্যবসায়ী গ্রুপকেও তিনি অনুরূপভাবে ৪শ’ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকারীর মতে এসব ইস্যু তাকে একটি মহলের কাছে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে। ব্যাংকের অপর একজন পরিচালকের মতে ব্যাংকটিকে বিরাজনীতিকরণে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবকে সরকারেরই অপর একটি মহল অপব্যবহার করছে। : ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইবনে সিনা ট্রাস্ট : ইসলামী ব্যাংকের সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইবনে সিনা ট্রাস্ট। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ মুহূর্তে ৩ কোটি ৬০ লাখ ৭৭ হাজার ৩শ ৯১টি শেয়ার আছে। পুঁজিবাজারে তালিকাবুক্ত বেসরকারি ব্যাংকটির এ শেয়ার ইবনেসিনা ট্রাস্ট দেবে পুঁজিবাজারেই। বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েব সাইডে এ তথ্য জানানো হয়। : এদিকে বুধবার ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদের সভায় ২০১৭ সালের জন্য ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী ২৫ জুন ব্যাংকের ৩৫তম বার্ষিক সাধারণ সভার অনুমোদন সাপেে এ ডিভিডেন্ড প্রদান করা হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের ডিভিডেন্ডের রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২১ মে। ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. নাজমুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসিফ আব্দুল্লাহ আল-রাজী ও মো. সাহাবুদ্দিন, পরিচালবৃন্দ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. মাহবুব উল আলম উপস্থিত ছিলেন। তবে দুজন পরিচালক সভায় উপস্থিত ছিলেন না। সভায় ২০১৭ সালের নিরীতি আর্থিক বিবরণী অনুমোদন করা হয়। সভা সূত্রে জানা যায়, আর্থিক বিবরণী অনুমোদনের বিষয় থাকায় সভায় অন্য কোনো ইস্যুতে আলোচনা হয়নি। :