ইসলামী দলগুলোর জোট ত্যাগ : বিএনপির নির্লজ্জ উদাসীনতা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ০৩ ২০২১, ০৩:২৫

সৈয়দ শামছুল হুদা

চারদলীয় জোট সরকারের সকল শীর্ষনেতাই প্রায় এখন পরপারে। একমাত্র ব্যতিক্রম বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। যদিও বা না থাকার মতোই। ইতিমধ্যে ২০০০সালের যারা নির্বাচনী গণজোয়ারগুলো দেখেছেন, তাদের মনে আছে, সে সময়ের বড় বড় জনসভাগুলোতে প্রথম দিকে জেনারেল এরশাদ, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আল্লামা আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও বেগম জিয়া একই সভায়, একসাথে মঞ্চে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন সেই সব ছবির কথা। আজ এরশাদ সাহেব নেই।শায়খুল হাদীস নেই। মুফতি আমিনী নেই। জনাব নিজামী সাহেব নেই। সেই সরকারের একমাত্র কিংবদন্তী, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া এখনো বেঁচে আছেন। কী প্রেক্ষাপটে সে সময় জোট গঠিত হয়েছিল তা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। কোন প্রেক্ষাপটকে সামনে আমাদের বড় দুই মুরুব্বি জোটে যোগ দিয়েছেন সেই প্রেক্ষাপটও এখন নতুন প্রজন্মের স্মরণ নেই। পরবর্তীতে ৪দলীয় জোট ভেঙ্গে নানা রাজনীতির বাঁক পার হয়ে ২০দলীয় জোট গঠন এবং ধীরে ধীরে সেই জোটও আজ বিলুপ্তির পথে। রাজনীতিতে এমন উত্থান-পতন ঘটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, ইসলামী দলগুলো একে একে বিএনপি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অথবা দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে সব দেখেও একযুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিতে এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথ্যা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং নানা ব্যঙ্গোক্তি, বক্রোক্তিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা কি বর্তমান বিএনপির অদূরদর্শিতা, রাজনৈতিক অধঃপতন, মতি-গতির পরিবর্তন নাকি অন্য কিছু এর পেছনে লূকিয়ে আছে তার কিছুই বুঝতে পারছি না। বর্তমান বিএনপি নেতৃবৃন্দের এটা মাথায় রাখা উচিত যে, তারা বেগম জিয়ার চেয়ে বেশি বিএনপি প্রেমিক নন। আজ বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ও শারীরিক দুর্বলতার ঠিক এই সময়ে বিএনপির বাম দিকে মোড় নেওয়ার লক্ষণটা শুধু বিএনপির জন্যই নয়, বরং সকল বাংলাদেশি জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী লোকদের জন্যও বিপদজনক। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো বুঝতে পারছে না যে, এদেশে বামদের তেমন কোন মূল্য নেই। তারা যদি স্বেচ্ছায় বামদের নেতৃত্ব নিতে চায়, আর এটা করতে গিয়ে গিয়ে ডানদের অবহেলা করে, ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের অবমূল্যায়ণ করে, তাহলে তারা ডানদের সমর্থন হারাবে। আর বামার্দশের ড. কামালদের কতটা জনসমর্থন আছে, আর বিএনপিকে তারাই বা কতটুকু বিশ্বাস করে সেটা এদেশের অনেকেরই জানা।

যুক্তফ্রন্ট করে বিএনপিকে গত নির্বাচনে ড. কামালরা মূলা দেখিয়েছে। এখনো ফখরুল সাহেবদের হুঁশ ফিরছে না। বর্তমান সরকার যেভাবে সবকিছু নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে ইসলামী দলগুলোকে বিএনপি এভাবে হারানোটা তাদের জন্যই অশুভ লক্ষণ। অবশ্য আওয়ামীলীগ যে ফাঁদ তৈরি করে যাচ্ছে, সেটা তাদের জন্য বুমেরাংও হতে পারে। তারা সবগুলো ইসলামী দলকে বিএনপি থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর বিএনপি ইসলামী দলগুলোর বিদায়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তাদেরও যে কিছু করণীয় আছে সেটা তারা আওয়ামীলীগ থেকে দেখেও শিখেনি। লীগ সরকার দিলীপ বড়ুয়াদের মতো লোকদেরও ফুল মন্ত্রী বানিয়েছিল। ঘাতক ইনু-মেননদের মন্ত্রী বানিয়েছিল। (তাদেরই ভাষায়)। অথচ বিএনপি ইসলামীদলগুলোর প্রতি কখনোই ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেনি। বর্তমান বিএনপি নেতৃত্ব এদেশের ইসলামপন্থীদের রিজার্ভ ভোট মনে করে রেখেছে। যেটা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান করেননি। সে ধারা বেগম জিয়াও অনেকটা রক্ষা করে চলেছিলেন। যদিও পুরোপুরি পারেননি।

লীগাদর্শের কৌশল হিতে-বিপরীতও হতে পারে
একটি কথা মনে রাখতে হবে, এদেশের মানুষ আর যাই হোক তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদকে সহজে মেনে নিবে না। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে এদেশের প্রাতঃস্মরণীয়, বরণীয় নেতৃবৃন্দই লড়াই-সংগ্রাম করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে ৪৭সালে দেশবিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৭১সালেও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের ইসলামীপন্থীদের উল্লেখ করার কোন ভূমিকা ছিল না। যেমনি ছিল না ৪৭এ। উলামায়ে কেরাম বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন। সে সময় রক্ত দিয়েছেন বটে। কিন্তু ৪৭এ মুসলিম জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনে আলেমদের ভূমিকার চেয়ে সাধারণ মুসলিম রাজনীতিবিদদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। বর্তমান সরকার যদি মনে করে ইসলামপন্থীদেরকে বিএনপি থেকে সরিয়ে দিলেই আগামী নির্বাচনে পথ পরিস্কার। বিএনপির ভরাডুবি নিশ্চিত। তাহলে সেটাও ভুল হতে পারে। বর্তমান সরকার এদেশের আলেম-উলামাদেরকে রাজনৈতিক জায়গা থেকে যে জায়গায় ঠেলে দিয়েছে সে জায়গায় থেকে উলামায়ে কেরাম তাদের সঠিক ভূমিকাটা এখন কোনভাবেই পালন করতে পারবে না। এসব কারণে এদেশের আলেম-উলামাসহ সরকারকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসর একবার এই ধ্বনি তুলতে পারলে, আর কোন রকম নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে ফলাফল কল্পনার বিপরীত হওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে বরং বিএনপি বিদেশি আনুকুল্য পেয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে।

আবার এটাও হতে পারে যে, সবগুলো ইসলামী দল যদি সত্যিই নিজস্ব চিন্তা-আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং রাজনৈতিক স্বতন্ত্র বলয় গড়ে তুলতে পারে, সেই ক্ষেত্রে ইসলামীদলগুলো মিলে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরণের প্রভাবও বিস্তার করে বসতে পারে। ক্ষুদ্ধ মানুষের সিদ্ধান্ত সবসময় আশানুরূপ নাও হতে পারে। এদেশের মানুষ বর্তমানে চরম ক্ষুদ্ধ। নির্বাচনী পদ্ধতিকে একেবারেই ধ্বংস করে দেওয়ায় এবং জনগণের মতামতের কোনরকম গুরুত্ব না থাকায় মানুষ সুযোগের অপেক্ষায়। ১৯৯১সালে ভৈরবের জাদরেল নেতা জিল্লুর রহমান সাহেবকে একজন বৃদ্ধ আব্দুল লতিফ যেভাবে হারিয়ে দিয়েছিলেন তাতে বুঝা যায়. বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণ সুযোগ পেলে কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।

তবে, পরাজিত বর্তমান বিএনপির মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, তারা এখনো ধরেই নিয়েছে ক্ষমতা তাদের হাতের নাগালে। যে কোন মুহুর্তেই তারা তা ছুঁয়ে ফেলবে। আর সে জন্যই দীর্ঘদিন তাদের জোটে থাকা ইসলামী দলগুলোর বিদায়ে কোনরকম সহানূভূতি প্রকাশ করছে না। এটা মিস্টার তারেক রহমানের অবগতি-অনুমতিতে হচ্ছে কী না জানি না, তবে যারাই এ ধরণের মনোভাব রাখুক তারা বড় ধরণের ভুলের মধ্যে আছে। সমাজে সামগ্রীকভাবে ইসলামপন্থীদের বড় ধরণের প্রভাব আছে এ কথাটা বিএনপি নেতৃত্বকে স্মরণ রাখতে হবে। আর এ জোট ভাঙ্গার পেছনে সরকারের যেমন হাত আছে, তেমনি বিএনপির ব্যর্থতাও কম নয়। তাদের উদাসীনতা, নিজেদের মধ্যে সবকিছু একচ্ছত্রভাবে করার মানসিকতা এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।

দেখা যাক। জনগণতো অপেক্ষাতেই আছে। অসহায় জনগণের কীই বা করার আছে। সঠিক নেতৃত্বহীন বিপুল জনতাও কোন কাজে আসে না। বিএনপি তারা নিজের পায়ে একা কতটুকু দাঁড়াতে পারবে সেটা সময়ই বলে দিবে। তবে বিএনপি একেবারেই হারিয়ে গেছে আমি সেটাও মনে করি না। সবই সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। তবে একা ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে সবাইকে নিয়েই বিএনপির আগামীর স্বপ্ন দেখা উচিত। এদেশে ইসলামপন্থীর গ্রহনযোগ্যতার একবারে দুর্বল নয়। শুধুমাত্র যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তারা পিছিযে আছে। এদেরকে অবহেলা করাও ঠিক হচ্ছে না। দেখা যাক কী হয়। তবে, বিএনপির প্রতি পরামর্শ থাকবে, ডান ছেড়ে অন্ধভাবে বামে নয়। এদেশে এটা ঝুঁকিপূর্ণ। ডান-বামের যথার্থ ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বিত নেতৃত্বই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা শক্তির পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। এছাড়া গোপন পথে হাঁটার কোন সুযোগ নেই।