ইসলামী জ্ঞান যেভাবে জানা উচিত

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১১ ২০২১, ০১:২৪

মোঃ আব্দুল হাসিব:

প্রারম্ভিক আলোচনা: জ্ঞান বলতে আমরা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানকেই বুঝি। তাই সাধারণ জ্ঞান বা বিবেক এমনটাই বলে যে, কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে কুরআন সুন্নাহর নির্দেশিত পন্থায় বা পদ্ধতিতে অর্জন করাই উচিত এবং এটাই চিরন্তন সত্য। তাই, কুরআন সুন্নাহর নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা।

ইসলামের মৌলিক জ্ঞানসূত্র দুটি। ১.আল কুরআনুল কারিম।২.রাসুল সা. এর সুন্নাহ।উভয়টিই ওহি।একটি ওহিয়ে মাতলু।অপরটি ওহিয়ে গায়রে মাতলু।

আমাদের প্রিয় নবী সা.কে আল্লাহ তায়া’লা কুরআন শিখিয়েছেন জিবরাইল আ.এর মাধ্যমে।তিনি আরবি ভাষায় সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক ছিলেন।

কুরআন আরবি ভাষায় হওয়া সত্ত্বেও তাকে কুরআন শিখতে হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা ২৯ পারার সূরা ক্বিয়ামাহ এর ১৬-১৯ আয়াতে এই বিষয়ে বলেছেন।

সাহাবায়ে কেরামের অনেকে আরবিভাষি সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও কুরআন শিখতে হয়েছে হুযুর আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে।

আল্লাহ তায়া’লা ২৮ পারার সুরা জুমুআহর দ্বিতীয় আয়াতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিনটি গুণ ও দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।১.তিনি কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করে শেখাবেন। ২.মানুষের আত্মশুদ্ধি করবেন।৩.মানুষকে কুরআনের তালিম দিবেন এবং হিকমাহর শিক্ষা দিবেন।

# হুযুর আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের শিক্ষক হওয়ার কথা স্বয়ং বলেছেন। নিশ্চয়ই আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।যেন উত্তম আখলাকের পূর্ণতা দিতে পারি।( মুয়াত্তা মালিক)

# আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন,আমরা প্রথমে ঈমান শিখেছি, এরপর কোরআন শিখেছি। (বুখারী)

অতএব বুঝা গেল,কোরআন শিখতে হবে।শেখার জন্য মাধ্যম অবলম্বন করতে হবে।যেভাবে হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন।এরপর তাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন,পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর। প্রিয় নবী সা. এরশাদ করেন,আমার পক্ষ থেকে তোমরা পৌঁছে দাও সবাইকে এই দ্বীন।একটি আয়াত হলেও।(বুখারী-মিশকাতের সুত্রে,হাদিস নং১৯৮)

সাহাবায়ে কেরাম এই জ্ঞান শিখিয়েছেন তাবেইনদেরকে।তারা তাবয়ে’ তাবেইনদেরকে।এভাবে শিখা ও শিখানোর ধারাবাহিকতা আজ অব্দি বিদ্যমান।কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জন অনেক সাধনার বিষয়।অনেক গবেষণা ও পড়ালেখার বিষয়।গুটিকয়েক হাদিসের বই ও তাফসীর এর বই পড়লেই কেউ কোরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত জ্ঞানী হয়না।যেভাবে কিছু ডাক্তারির বই ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই পড়লেই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না।

মৌলিক আলোচনা:

সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনি কার কাছ থেকে দ্বীনি বিষয়গুলো জানবেন?

# আল্লাহ তায়া’লা এরশাদ করেন,তোমরা যা জান না সে ব্যাপারে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।(সূরা-নাহল,আয়াত-৪৩)

দ্বীনি বিষয় নিয়ে জানার ক্ষেত্রে আপনি এমন আলেম ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিবেন,যাকে আপনি ভালোভাবে চিনেন।সে কোথায় পড়ালেখা করেছে?কেমন ভাবে পড়ালেখা করেছে?সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সে কতটুকু অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে?যার ব্যাপারে এ বিষয়গুলো ভালোমতো জানেন তার থেকেই আপনার দ্বীনি সমাধানগুলো গ্রহণ করুন।

দেখতে সুন্দর,কথা সুন্দরভাবে বলতে পারে,অনেক কিতাবাদীর নামও উল্লেখ করে শুধুমাত্র এতটুকুর উপর ভিত্তি করে তাকে আস্থাভাজন বানাবেন না। ডাক্তার দেখানোর আগে যেভাবে ডাক্তারের ডিগ্রি,তার পরিচয় যাচাই করে নেন।তদ্রূপ দ্বীনী সমাধান জানতে চাওয়ার আগে বিষয়গুলো ভালোমতো যাচাই করে নিন।অন্যথায় নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ও বিভ্রান্তিতে পড়বেন।ফেতনাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

# প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি না জেনে কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করল অথবা উত্তর প্রদানকারী না জেনে উত্তর দিল।তাহলে উত্তরদাতার ভুল উত্তরের কারণে প্রশ্নকারী গুনাহগার হবে।(কোন ক্ষেত্রে উত্তর প্রদানকারীও গুনাগার হবে)(আবু দাউদ,মিশকাতুল মাসাবীহর সূত্রে,হাদিস নং২৪২)

# এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেন,প্রশ্নকারী গুনাহগার হওয়ার কারণ হল,সে উত্তর প্রদানকারীর ব্যাপারে সম্যক অবগত না হয়ে তাকে উত্তর প্রদান করার যোগ্য মনে করেছে।আর উত্তর প্রদানকারীর গুনাহগার হওয়ার কারণ হল,সে যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও উত্তর দিয়েছে। (মিরকাতুল মাফাতিহ,খন্ড১,পৃ-৪৫৮)

# হুযুর আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,যে ব্যক্তি কুরআনের (তথা দ্বীনী)কোনো বিষয় নিয়ে নিজ থেকে কিছু বলে,সে যদি (ঘটনাক্রমে) সঠিকও বলে তারপরও সে ভুল করলো।(তিরমিযী ও আবু দাউদ,মিশকাতের সূত্রে,হাদিস নং-২৩৫)

# বিখ্যাত মুহাদ্দিস,বহু সাহাবীর সংশ্রবপ্রাপ্ত তাবেয়ী’ মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রহ. বলেছেন,কুরআন-সুন্নাহর এই ইলম দ্বীন।অতএব তোমরা দেখো কার থেকে দ্বীন অর্জন করছো(অর্থাৎ ভালোমতো যাচাই-বাছাই করে নাও)। (মুসলিম,পৃষ্ঠা-১১)

#বিখ্যাত মুহাদ্দিস,মুসলিম শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা নববী রহ. বলেন,কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত, ইসলামি বিষয়ে পূর্বের প্রাজ্ঞদের লিখিত কিতাব ব্যাপকভাবে অধ্যয়নকারী,ইসলামি আইনের মূলনীতি আয়ত্বকারী ব্যক্তি দ্বীনি বিষয়ের সমাধান দিতে পারবে।তবে এর জন্য একটি শর্ত আছে।উল্লেখিত যোগ্যতা অর্জন হতে হবে সেই যোগ্যতার অধিকারী দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে।(শরহু উকুদি রসমিল মুফতি,পৃষ্ঠা-৭৫)

অতএব ইসলামি বিষয়ে যে কোনো কথা জানা,শেয়ার করা,অপরকে বলার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক। দ্বীনি জ্ঞানকে তুচ্ছ ও সাধারণ মনে করবেন না। যার যেভাবে ইচ্ছা জানলেন। তার উপর আমলও করতে লাগলেন। আবার তা প্রচারও করতে থাকলেন।আপনার অজ্ঞতাবশত এই অবস্থান আপনাকে গোমরাহির দিকে নিয়ে যাবে।

মৌলিকভাবে আরেকটি কথা বলে রাখি, শাখাপ্রশাখাগত বিষয়ে যে ইখতিলাফি মাসায়েল এখন আমাদের সমাজে খুব বেশি চর্চা হয় এগুলো সবই মীমাংসিত।এগুলো নিয়ে যারা নতুন করে আলোচনা করে।নতুনভাবে কোনো কিছু উপস্থাপন করতে চায় তারা ফিতনা তৈরি করা আর মানুষের মাঝে বিভাজন তৈরি করা ছাড়া ভালো কিছু উপহার দিতে পারছে না।

আপনি নামাজে হাত বাধবেন কোথায়,ইমামের পিছনে কিরাত পড়বেন কিনা ইত্যাদি এগুলো অনেক আগ থেকেই সমাধান হয়ে আছে। সকল প্রকারের আমলকারী বিশুদ্ধতার উপর আছে। যদি পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য সঠিক হয়।যেখানে অধিকাংশ মানুষের আমল নাভির নিচে হাত বাঁধা সেখানে ভিন্ন কিছু বলে তাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলা মোটেও উচিত না।আবার কোনো জায়গায় ইমামের পিছনে কিরআত পড়ার প্রচলন থাকলে সেখানে কেরাত না পড়ার কথা বলা বিভ্রান্তি তৈরি করা।যারা কোনো স্কুল অফ থটকে অনুসরণ করে ইমামের পিছনে কিরাত পড়ছে সে বিশুদ্ধতার উপর আছে।যেহেতু তার পদ্ধতি সঠিক।

একটি উদাহরণ দেই, বাসার দোতালায় ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে। আবার লিফটও আছে।সিঁড়ি দিয়ে ওঠাটাও ঠিক লিফট দিয়ে ওঠাটাও ঠিক।দুজনের পদ্ধতি ভিন্ন হলেও অনুমোদিত পদ্ধতিতে অভিন্ন উদ্দেশ্যের দিকে গিয়েছে।পক্ষান্তরে কেউ দোতালায় ওঠার জন্য পাইপ ব্যবহার করলে অনুমোদনহীন পদ্ধতি অবলম্বন করার কারণে তাকে দোষারোপ করা হবে।যদিও সে দোতলায় উঠতে সক্ষম হয়।

যেহেতু আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান হানাফি স্কুল অফ থট অনুসরণ করে তাই এখানে ভিন্নমত প্রচার করা ও প্রমোট করা সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে নিজ আমলের ব্যাপারে সংশয় তৈরি করে বিভ্রান্তিতে ফেলা।এতে ফেতনা তৈরি হবে।

আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ যেখানে ঈমান বিধ্বংসী ইরতিদাদি ফিতনায় আক্রান্ত। সেখানে অযথা মীমাংসিত বিরোধপূর্ণ বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা ফেতনাবাজি ছাড়া আর কি হতে পারে।

এই জন্যই দ্বীনি বিষয়ের প্রশ্নকারী ও উত্তরদাতা উভয়েরই সর্তকতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে আশা করি বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে পারবেন।ফেতনায় জড়াবেন না।ফেতনাবাজদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগী হওয়া থেকেও মাহফুজ থাকবেন। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সুমতি দান করুন। আমীন!

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাহিত্যিক