ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দিন দিন গণমুখি দলে পরিণত হচ্ছে 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ২৮ ২০২৩, ২১:১২

সৈয়দ শামছুল হুদা: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি গণমুখি দলে পরিণত হচ্ছে। সারাদেশে তাদের গণমুখিতার চিত্র বেশ চোখে পড়ার মতো। এই ক্ষেত্রে তারা অসাধারণ কৌশলী। তারা প্রায়ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করছে। আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষকে তাৎক্ষণিক চিহ্নিত করতে পারে। ইসলামী আন্দোলনও রাজনৈতিক কাজে কে তাদের ক্ষতি করতে পারে তা বুঝতে তাদের দেরি হয় না। এর সর্বশেষ উদাহরণ, গাজীপুর সিটি নির্বাচন। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম তাদের নির্বাচনী প্রচারনায় বড় ধরনের ফ্যাক্টর ছিল। গাজী আতাউর রহমান সাহেব আরো বেশি ভালো করতেন যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নির্বাচনে না থাকতেন। একজন কর্মী বিষয়টি ফেসবুকে তুলেও ধরেছেন। জাহাঙ্গীর আলম তার মাকে প্রার্থী করায় জাহাঙ্গীর আলমকে জালেম হিসেবে আখ্যায়িত করতে কোনোরূপ সঙ্কোচবোধ করেননি।

আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে ক্ষমতার স্বার্থ বিবেচনায়। খাটি রাজাকারও কখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়, আবার কখনো কোনো বীর বিক্রমও রাজাকার হয়ে যায়। ঠিক তদ্রুপ ইসলামী আন্দোলনও রাজনীতিতে স্যাকুলার আদর্শ লালন করে। যখন যে পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন তা করতে সামান্য পরোয়া করেন না। পার্থক্য শুধুই পোশাকের। শক্তি প্রদর্শন, হুঙ্কার, অর্থব্যয় সকল ক্ষেত্রেই তারা লীগের প্র্যাকটিসটা অনুসরণ করছেন। তারা লীগের গণমুখিতা একদিকে অনসরণ করছে, অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘ দিনের যে রাজনৈতিক অর্জন এবং তাদের যে কৌশল তা তারা ষোল আনাই ফলো করছে। দলকে চাঙ্গা রাখতে, কর্মীদের ব্যস্ত রাখতে, জামায়াতের নানামুখি কর্মসূচীর হুবুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুহু কপি করে যাচ্ছে। দাওয়াতি পক্ষ পালন, তরবিয়াতি বৈঠক, এয়ানত আদায়, কর্মী বাড়ানোর পরিকল্পনা, সদস্য টার্গেট ইত্যাদি সবকিছুই। মাওলানা আবুল আলা মওদুদি রহ. যা দীর্ঘ শ্রমের মাধ্যমে জামায়াতকে উপহার দিয়ে গিয়েছেন তারা তা খুব সহজেই কাজে লাগাচ্ছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সামনে নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই। তাদের যারা কিছু সুশীল হিসেবে লেখালেখি করেন, তাদের লেখা থেকেই এর বাস্তবতা স্পষ্ট। ‘ভেদে মারেফতের’ মতো ছোট্ট একটি কিতাবই তাদের আলোচনায় আসে বারবার। তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য নেই, রাজনৈতিক গবেষণাপত্র নেই, অর্থনৈতিক কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা অগ্রগতির জোয়ারে ভাসছেন, যখন যে ধরনের কৌশল নিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে সেটাই অনুসরণ করতে সামান্য দ্বিধা করছেন না। এতে যতই বিতর্ক হোক, যতই সমালোচনা হোক, কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না। এক্ষেত্রে গাজীপুর থেকে শুরু করে বরিশালে গিয়ে নারী কর্মীদের ব্যাপক আকারে মাঠে-ময়দানে কাজে লাগানোর কৌশলটি উল্লেখযোগ্য।

তারা একসময় রাবেতাতুল ওয়ায়েজিনকে প্রতিপক্ষ মনে করেছে, সেটাকে তারা চরমভাবে ঘায়েল করে দিয়েছে। মামুনুল হক সাহেবের গ্রেফতারের পর যখন মাওনার পীর সাহেব রাবেতাকে বিলুপ্ত করলেন তখন তাদের খুশির কোনো সীমা ছিল না। হাটহাজারীর ছাত্র আন্দোলনে তারা চূড়ান্ত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পুর্ব পর্যন্ত আন্দোলনের অনেকটাই পক্ষ ছিলেন। আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে যখন তারা দেখলো যে, আন্দোলনকারীরা তাদের চিন্তার বিরোধী লোক, সাথে সাথে তাদের অধিকাংশকে খারেজি, মানহাজি আখ্যা দিতে বিলম্ব করলো না। আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর ইন্তেকালের পর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. এর নেতৃত্বে গঠিত হেফাজতকে তাদের প্রতিপক্ষ মনে হলো, সাথে সাথে সেই হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান, সমালোচনা করতে বিলম্ব করলো না। যার সাথে তারা কোনোভাবে সম্পৃক্তই না সেটাকে ‘পকেট কমিটি’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সেটাকে দুর্বল করতে সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক লেখালেখি শুরু হয়ে গেলো। ঠিক তদ্রুপ বেফাকে যখন তারা দেখলেন যে, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমি রহ. সাহেবদের নেতৃত্বে বেফাক থাকলে কওমী মাদ্রাসায় তারা প্রভাব বিস্তার করতে বাধাগ্রস্থ হবেন, তখন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ের দলীয় শক্তি ব্যবহার করে আল্লামা মাহমুদুল হাসান সাহেবকে বেফাকের মূল পদে নিয়ে আসলেন। এর আগে বেফাকের সহসভাপতির একটি পদ দিতে গিয়েও না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তখন দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব পদকে ‘লুম্বা আমাগো দরকার নেই’ আখ্যায়িত করতে বিলম্ব করেননি।

এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অবস্থান পরিস্কার করতে কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্ধে ভোগছেন না। এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে জনৈক হেফাজত নেতা কর্তৃক বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন করায় ইসলামী আন্দোলন এর পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়, তা এক কথায় ছিল অকল্পনীয়।অমার্জনীয়ও। কিন্তু তারা সেখান থেকেও পিছপা হননি। সেদিন ভাষার ব্যবহার ছিল চরম পর্যায়ের অশালীন। কিন্তু রাজনীতি বলে কথা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে- যে কোনো মুল্যেই হোক। হেফাজত নেতারা যখন একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছিলেন, তখন ভক্তদের সামনে তারা বললেন, আপনারা কাউকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাইবেন, টেনে-হিচড়ে নামাতে চাইবেন, আর তারা আপনাদেরকে চুমু খাবে এটা আশা করেন কীভাবে? মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী যখন মামুইন্যারে সাইজ করার সিদ্ধাত্ব চূড়ান্ত বলে অসর্তকতাবশত: ভেতরের কথা ফাঁস করে দিলেন, তখনও এটাই প্রমানিত হয়েছিল যে, শত্রু চিনতে তারা ভুল করেন না।

আর এসব কারণেই তারা উন্নতি করছে। জনবান্ধব দলে পরিণত হচ্ছে। যেহেতু তাদের সামনে রাজনৈতিক কোনো পরিস্কার দর্শন নেই, তারা যখন প্রকাশ্যেই বলেন, খেলাফত প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট নিয়ম কোথাও নেই, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তারা মনস্তাত্বিকভাবে দর্শন শুন্যতায় ভোগছেন। তারা ক্ষমতার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যখন যা করা লাগে সেটাই তারা করবেন। সেটাকেই তারা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বৈধ, ন্যায্য প্রমাণ করবেন। আর এ কাজে তারা নিজস্ব কিছু যোগ্য কওমী আলেমকে সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য নিয়োগও করে রেখেছেন। দলটি এসব চরিত্রের কারণে আরো অনেক পথ এগিয়ে যেতে পারবে। এদেশে জামায়াত গণমুখি দল নয়। তারা রাজনীতিতে পাগলামি করতে পারেন না। চরমোনাই এর কিছু অনুসারীদের অদ্ভুত আচরণকে নিয়ে আমরা যদিও ট্রল করি, কিন্তু এটাই তাদের গণমুখিতার একটা বড় নিদর্শনও।কর্মীদের তারা মাতিয়ে রাখতে পারছে। বিএনপি- ধর্মীয় ও জাগতিক রাজনীতির দর্শনের মাঝামাঝি অস্পষ্ট অবস্থান করছে। তারা নারায়ে তাকবীর বলতে লজ্জা পায়। আবার জয়বাংলাও বলতে পারে না। এ কারণে তারা কোনো প্রান্তিকতায় যেতে পারে না। বিপুল গ্রহণযোগ্যতা সত্ত্বেও রাজনীতির মাঠে এখনো তারা সুবিধা করতে পারছে না।

সবমিলিয়ে ইসলামী আন্দোলনের সামনে আরো কিছুদিন সুদিন থাকবে। রাজনীতিতে তারা বাইম মাছের মতো অবস্থান করছে। দুই বড় দলকেই আঙ্গুল দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো দলই তাদের প্রতিপক্ষ মনে করছে না। লীগ মনে করছে তাদের দিয়ে বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির বারোটা বাজাবেন, আর বিএনপি মনে করছে, ভবিষ্যতে তারা আমাদের কাজে আসতেও পারে। সুতরাং তাদের সাথে খোচাঁখুচি করে লাভ নেই। একটি পর্যায়ে গিয়ে তারাও হোচট খাবে। বরিশাল নির্বাচনে সেটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে যখনই তারা শক্ত অবস্থান নিতে শুরু করবে, তখনই শুরু হবে আসল খেলা। সেটা আরো কিছুদূর যাওয়ার পর। শুভকামনা তাদের জন্য। রাজনৈতিক রোষানল বড় মারাত্বক। যা আজ জামায়াত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।