ইসলামি প্রকাশনীর অংশগ্রহণ ছাড়া একুশে বইমেলা সর্বজনীন হতে পারে না

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ২৬ ২০১৯, ১৮:৩৮

চলছে একুশে গ্রন্থমেলা। ব্যস্ত সময় পার করছেন লেখক-প্রকাশকরা। আসছে নতুন নতুন বই। আনন্দ-বেদনার মধ্যদিয়েই শেষ হচ্ছে দিনের বই বিক্রি। কিন্তু চোখে পড়ার মতো ইসলামি কোনো প্রকাশনী নেই মেলায়। এসব নিয়েই ‘বিহান’-এর কথা হয়েছে কালান্তর প্রকাশনীর প্রকাশক আবুল কালাম আজাদের সাথে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আবু তালহা মিহরাব

বিহান’ ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারটি অনলাইন পাঠকদের জন্য ‘একুশে জার্নাল’-এ পাবলিশ করা হলো।

শুরুতেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।
আবুল কালাম আজাদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

কালান্তর প্রকাশনীর শুরুটা কীভাবে হলো?
আবুল কালাম আজাদ : সেটা তো অনেক লম্বা ইতিহাস! সংক্ষেপে বলি; ২০১২-১৩ সালের দিকে রশীদ জামীল ভাইয়ের সম্পাদনায় ‘কালান্তর’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ হতো। তাঁর যুক্তি ছিল ‘যুগ থেকে যুগান্তর হতে পারলে কাল থেকে কেন কালান্তর হতে পারবে না।
ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল ম্যাগাজিনটি তার ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের জন্য। কিন্তু একপর্যায়ে নিবন্ধন-সংক্রান্ত আইনী জটিলতায় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়।
২০১২/১৩-এর দিকে অনলাইন জগতের তরুণ লেখকরা একটি সৃজনশীল প্রকাশনীর প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। তারা সবাই রশীদ জামীল ভাইকে চেপে ধরলেন কিছু একটা করতে। নেপথ্যে থেকে দেখাশোনা করার আশ্বাস দিয়ে আমাকে দিয়ে প্রকাশনী দাঁড় করালেন তিনি। ‘কালান্তর প্রকাশনী’ নাম ঠিক করা হলো। এবং প্রথম বছরই; মানে একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩-এ ২৫টি বই প্রকাশ করা হয়। তবে শুরুটা অনেকটা সৌখিন আদলেই ছিল। পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিশেবে ভাবা হয়নি।

এখন তো কালান্তর পুরোপুরি প্রফেশনাল একটি প্রকাশনী। তাহলে শখটা কীভাবে পেশাদারিত্বে রূপ নিল?
আবুল কালাম আজাদ: ২০১৫/১৬-তে শ্রদ্ধেয় বড়ভাই খতিব তাজুল ইসলাম প্রফেশনাল একটা প্রকাশনী দাঁড় করানোর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কালান্তরের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথাও জানালেন। তখন রশীদ ভাই দেশের বাইরে। তাঁর সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি উৎসাহিত করলেন তবে ব্যবসায়িক পার্টনার হিসাবে কালান্তরের অংশ হতে চাইলেন না। অতঃপর খতিব তাজুল ইসলাম এবং সালমান বিন মালিক ভাইকে সাথে নিয়ে শুরু হলো কালান্তরের যাত্রা।

এ পর্যন্ত কী কী বাধা পেরোতে হয়েছে আপনাকে?
আবুল কালাম আজাদ : বাধার তো শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটা বলি। তবে চরম ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম, ক্রিয়েটিভিটি, দূরদর্শিতা, সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা থাকলে এবং মিশন ঠিক করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনভেস্ট করতে পারলে অনেক বাধা সহজেই পেরোনো যায়।

উদ্যোক্তাদের বিরাট চ্যালেঞ্জ থাকে। কঠোর পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁদের। একসময় অনেকে আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেন। তো কখনও কি মনে হয়েছে প্রকাশনা ছেড়ে দিই?
আবুল কালাম আজাদ : মনে হয়েছে মানে? ছেড়েই তো দিলাম একসময়। ২০১২-১৪ সাল মিলে প্রায় ৬০টি বই প্রকাশ করি। এর পর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় কার্যক্রম বন্ধ করে দেই। এখনও মাঝে মাঝে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা আসে। তবে কম। আমি আশাবাদী।

ইসলামি প্রকাশনা নিয়ে একদল লোক প্রশ্ন তুলে সবসময়। বইয়ের গুণগত মান, বানান ভুল, প্রচ্ছদ, মুদ্রণ সমস্যা ইত্যাদি কারণে। এ বিষয়ে একটু বলুন।
আবুল কালাম আজাদ : যারা প্রশ্ন তুলেন; তারা কয়েক ধরনের। একধরনের লোক উদ্দেশ্যমূলক বা হিংসা থেকেই এসব করেন। ওদের আমরা গোনায়ই ধরতে চাই না। কারণ, ওরা আমাদের বই না-দেখেই এসব ঢালাও মন্তব্য করে। তবে হ্যাঁ, একসময় এই অভিযোগটা অনেকাংশে সঠিক ছিল। এখন আর সেই দিন নেই। দিন বদলাইছে। তবে আমাদের আরও উন্নতি করা উচিত। আমাদের কাজের মান আরও বাড়ানো উচিত, সৃজনশীল কাজে এগিয়ে আসা উচিত। কনটেন্ট নির্ধারণে আরও কৌশলী হওয়াটা সময়ের দাবি। মার্কেটিংয়েও নতুনত্ব নিয়ে আসা উচিত।
আশার কথা হলো, এখন নতুন কিছু প্রকাশনী ময়দানে এসেছে; তারা অনেক অনেক ভালো কাজ করছে। আগামীতে আরও আসবে ইনশাআল্লাহ। তবে কিছু প্রকাশনী বইয়ের কোয়ালিটি ভালো করলেও তাদের সেকেলে ভাষা আর বানানরীতি জেনারেল ঘরানায় ওইভাবে পৌঁছুতে পারছে না।

দেশের বিপুল পরিমাণ পাঠক বইমেলায় ইসলামি বই খুঁজেন। মেলা ছাড়াও এবং এর চাহিদাও প্রচুর; তবু ইসলামি প্রকাশনীগুলোকে বাংলা একাডেমি বাঁকা নজরে দেখে। স্টল দিতে চায় না। এর কারণটা কী?
আবুল কালাম আজাদ : কেউ চায় না; তার মাথায় আরেকজন কাঁঠাল ভেঙে খাক। বাংলা একাডেমি টপ টু বটম ওই ঘরানার লোকদের নিয়ন্ত্রণে। তারা এটাকে তাদেরই সম্পত্তি মনে করে। এই মনে করা থেকেই কাঁঠালের কথা বললাম। যদিও আমরা জানি যে, এটা সরকারি বইমেলা বা জাতীয় গ্রন্থমেলা। রাষ্ট্রের টাকায় এই মেলার আয়োজন করা হয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই এর ব্যয়ভার নির্বাহ করা হয়। আবার যারা স্টলের জন্য আবেদন করে; তারা মোটা অঙ্কের অফেরতযোগ্য ফি দিয়েই আবেদন করে।
তো এই মেলায় যদি ইসলামি ঘরানার প্রকাশনীগুলো অংশগ্রহণ করে, তারা যে একচেটিয়া ব্যবসা করে; সেটায় একটা ভাটা পড়ার আশঙ্কা থাকে তাদের। তারা হয়তো ভাবে; একসময় টোটাল মেলাটাই ইসলামপন্থীদের দখলে চলে যাবে। এতে তাদের আদর্শিক একটা বড় প্লাটফর্ম হারানোরও ভয় থাকে এবং একচেটিয়া ব্যবসায়িক দখলদারির অবসানেরও আশঙ্কা থাকে। আর এই আশঙ্কা থেকেই হয়তো তারা ইসলামি ঘরানার প্রকাশনীগুলোকে স্টল বরাদ্দ দিতে চায় না।

প্রকাশনী খোলার সময় কোন বিষয়টা মাথায় ছিল; শিল্প নাকি বাণিজ্য?
আবুল কালাম আজাদ : কথাটি আগেও বলেছি। ব্যবসার তেমন চিন্তাই ছিল না তখন। শখের বশেই শুরু। তবে একসময় ভাবলাম; ব্যবসা না-হলে তো প্রকাশনীই ধরে রাখা যাবে না।

বই বিক্রি হয় না, ব্যবসা মন্দা, পাঠক নেই; এসব কথা প্রকাশকেরা প্রায়ই বলে থাকেন। এবং লেখকদের অভিযোগ; তাঁরা ঠিকমতো রয়্যালিটি পান না। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
আবুল কালাম আজাদ : বই বিক্রি হয় না যে একেবারে; তা ঠিক নয়। পাঠকও যে নেই; বিষয়টা এমন নয়। তবে কথাটি অনেকাংশে সত্য। ইউরোপ-আমেরিকায় একটা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা যে প্রডাকশন চিন্তায় রাখে; আমরা সেটা হয়তো কল্পনাও করি না। আমরা ৫০০-১০০০ বিক্রি হলেই এটাকে সফলতা মনে করি। বেস্টসেলার মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। এটা ইসলামি ঘরানায় যতটুকু সত্য; জেনারেল ঘরানায় তারচেয়েও বেশি সত্য। আমি তো যতদূর জানি; ওই ঘরানার শতকরা ৯৫% বই গড়ে ২০০ কপি করে প্রিন্ট করা হয়। আমরা সাধারণত ১ হাজার থেকে ৩ হাজার প্রথম মুদ্রণেই প্রিন্ট করি।
তবে হ্যাঁ, আমাদের ইনভেস্ট, শ্রম, মেধা আর সময় যেভাবে যতটুকু ব্যয় হয়, আমার মনে হয় না সেভাবে বই বিক্রি হয়। আপনি চিন্তা করে দেখুন; এদেশের শতকরা ৭০% লোক শিক্ষিত হলে ১৭ কোটি জনগণের ১১ কোটি ৯০ লাখ লোক শিক্ষিত। তো আপনি বইই প্রকাশ করলেন ২০০ থেকে ৩ হাজার কপি। তাহলে বোঝা গেল আসলেই আমাদের পাঠক কম।
আর এটাও সত্য যে, যে পরিমাণ বই প্রকাশ হয়, বাংলা একাডেমির হিসাবেই বেশিরভাগ বই মানসম্মত নয়। এটা তাদেরই বইয়ের হিসাব। আবার ইসলামি ঘরানার বইয়ের মূল্য একটু বাড়ানো হলেই পাঠক হইচই শুরু করে। তারা বলে দীনের নামে বই প্রকাশ করলে ব্যবসাকে কেন প্রাধান্য দেওয়া হবে? তো এই যারা না-জেনে আর না-বুঝে এসব বলেন; তাদেরকে যদি একটি বই কাজ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন বা কোনো কাজ দেন; তাহলে দেখা যায় প্রায় ৯৯%ই ব্যর্থ। এটা আমার অভিজ্ঞতা। আমি কয়েকজনকে এরকম পরীক্ষা করেছি। যদিও তারা জানে না যে, আমি কীভাবে তাদের থেকে এমন পরীক্ষা নিলাম। আর হ্যাঁ, এটা আমার একান্তই জরিপ। কারও সাথে মিলতেই হবে; এমন কোনো কথা নেই।
আর রয়্যালিটির ব্যাপার নিয়ে যারা কথা বলেন; তারা অনেকেই ঠিক বলেন। এখানে আমার পরামর্শ হলো, এসব বিষয় শুরুতেই ক্লিয়ার করে নেওয়া। তাহলে আর পরে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ ঘটনাই ভুল বোঝাবুঝি থেকে সৃষ্টি হয় বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ, এই লেখক যখন একসময় প্রকাশক হন, তখন দেখা যায় এই অভিযোগটা তার উপরও আসছে। তার মানে কী দাঁড়ালো? মানে দাঁড়ালো তিনির সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতায় সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে হবে।

নবীন লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলুন; বিশেষ করে যারা লেখালেখিতে আসতে চায়।
আবুল কালাম আজাদ : আমি উপদেশ দেওয়ার যোগ্যতা রাখি না। এরকম কিছু বলার মতো লোক এখনও হইনি। তাই বিশেষ কিছু বলতে পারছি না। তবে সাধারণভাবে সবাই যেটা বলে আমিও সেটা বলব যে, লেখালেখি করতে হলে পড়তে হবে। অধ্যয়ন করতে হবে। নিয়মিত চর্চা করতে হবে। গাইডলাইন মেনে কারও তত্ত্বাবধানে এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সমালোচনা সহ্য করতে হবে। ফেসবুকে দুই-চার লাইন স্ট্যাটাস লিখে আর লাইক-কমেন্টে বাহবা পেয়ে নিজেকে আহামরি কিছু মনে করে বসে থাকলে জীবনটা এই ফেসবুকেই থাকবে। বাস্তবে কিছু্ই হবে না ।

ধন্যবাদ আপনাকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ায়।
আবুল কালাম আজাদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।