আহমদ ছফা ও শাহবাগ প্রজন্ম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ০১ ২০২১, ১৯:৫০

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত: আহমদ ছফাও বাঙালি জাতিবাদী। তবে তার বাঙালি জাতিবাদ ঠিক হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মুনতাসির মামুনদের বাঙালি জাতিবাদের মত কেবল পাকিস্তানের প্রতি প্রবল ঘৃণা ভিত্তিক নয়। কলকাতার বর্ণ হিন্দু বাঙালি আধিপত্যের প্রশ্নেও আহমদ ছফা সোচ্চার ছিলেন। কাজেই তিনি বাঙালি মুসলমানকে হীনমন্য করে আঁকলেও সেটাই তার একমাত্র সনাক্তকারী চিহ্ন হয়ে ওঠেনি।

আর ছফার যে চারিত্র্যটি তাকে পরপর কয়েকটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এদেশের বিরলতম

কয়েকজন আইকনিক গণবুদ্ধিজীবির অন্যতম একজন করে তুলেছে সেটা হল তার সবরকম প্রাতিষ্ঠানিকতা অগ্রাহ্যকারী ভূমিকা। তিনি এদেশীয় বুদ্ধিজীবিদের সর্বাত্মক সুবিধাবাদীতা ও পদলেহনী মনোবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। যে কারণে তিনি যা সত্য বলে মনে করতেন তা অকপটে মেদহীন ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন।

আর লেখক হিশেবেও তো তিনি বহুমাত্রিক ও বহুপ্রজ ছিলেন। ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর আধুনিক সাহিত্যে অপরিহার্য পাঠে পরিণত হয়েছে। এছাড়া তার কথাশিল্পও যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে—যেমন ‘ওঙ্কার’, ‘অলাতচক্র’, ‘গাভীবিত্তান্ত’, ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ প্রভৃতি।

কাজেই আহমদ ছফা বাংলাদেশের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে বহাল তবিয়তেই হাজির আছেন। এখন তাকে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ অনুসারী উগ্র সেক্যুলার বাঙালি জাতিবাদী ও ইসলামোফোবেরা তাদের মতাদর্শিক গুরু বানাতে চাইছে কিনা সেটা একটা ভিন্ন আলাপ। আহমদ ছফার অতি উৎসাহী শিষ্য সলিমুল্লাহ খান ‘সর্বজন’ নামক সাময়িকী প্রকাশ করে তেমন একটা চেষ্টা করেছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে ছফার চিন্তা, কর্ম, জীবনবীক্ষা ও জীবনশৈলী—এর কোনো কিছুর সঙ্গেই শাহবাগী চেতনাকে মেলানো কঠিন। হ্যা, ছফা শেষ বিচারে বাঙালি জাতিবাদী, জাতীয় সমাজতন্ত্রীও বটে। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধবাদী হলেও কখনোই ভারতীয় আধিপত্যবাদকে অন্ধভাবে খোলা চেক দিয়ে দেয়ার মত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। সর্বোপরি তিনি উগ্র নাস্তিক্যবাদী বা অজ্ঞেয়বাদী এবং নোংরা ইসলামোফোব ছিলেন না।

ছফার সমস্যা ছিল অন্যত্র, অন্য কোনো খানে। সেটা ছিল তার বাঙালি মুসলিম পরিচয় নির্মাণে ইসলামিকতাকে এড়িয়ে যাবার প্রবণতায়। কারণ তিনি বৃহত্তর অর্থে তার সময়ের সন্তান ছিলেন। আর সেই সময়টি ছিল উত্তর-উপনিবেশিক সেক্যুলার জাতিবাদী সমাজতান্ত্রিকতার সময়। তিনি তার অনেক সততা ও উদারতা সত্ত্বেও তার সময়ের চারিত্র্য ও বৃত্তের বাইরে যেতে পারেন নি। যেটা আল মাহমুদ করতে পেরেছিলেন সেটা আহমদ ছফা করতে পারেন নি। ফরহাদ মজহারও পুরোপুরি ঘরে ফিরতে পারেন নি; এখনো তার এক পা পেছনেই রয়ে গেছে।