আল্লামা শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একনিষ্ঠ শিক্ষক ও সময়ের অন্যতম শিক্ষাবিদ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ০৯ ২০২২, ১২:৫৮

আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ শিক্ষক ও সময়ের অন্যতম শিক্ষাবিদ। জীবনের প্রায় ৬০ বছর সময় তিনি হাটহাজারী জামিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নানামুখী দায়িত্ব পালন করেছেন। একবারে মকতব জামাত থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদিসের বুখারি পর্যন্ত তিনি এ মাদরাসার ছাত্রদের শিক্ষাদান করেছেন। এই ৬০ বছরে কত সহস্র ছাত্রকে তিনি ইলমে নববি শিক্ষা দিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের যে প্রান্তেই যাওয়া হোক না কেন, সেখানে একজন হলেও আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শাগরেদ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে তার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ইলমে নববির শিক্ষাধারা।

শনিবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর হোটেল রয়েল প্যালেসেল হল রুমে ‘বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ও সংকটের ৫০ বছর; আল্লামা আহমদ শফীর অবদান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন- ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়েদ আসআদ মাদানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ছেলে ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের মরণোত্তর সম্মাননা পদক গ্রহণকারী মাওলানা সায়্যিদ মওদুদ আসআদ মাদানী।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, উজানীর পীর মাওলানা মাহবুবে এলাহী, মাওলানা রুহুল আমীন খান, বেফাকুল মাদারিসিদি দ্বীনিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ সভাপতি মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী, বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র ইমাম মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভি, জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল ঊলূম ফরিদাবাদের মুহাদ্দিস মুফতি ইমাদুদ্দিন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-একাংশের মহাসচিব ড. মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, মাওলানা সদরুদ্দিন মাকনুন, মাওলানা মনিরুজ্জামান রব্বানীসহ দেশের প্রতিনিধিত্বশীল আলেমরা।

বক্তারা বলেন, আল্লামা আহমদ শফী কেবল চার দেয়ালের মাঝে গণ্ডিবদ্ধ কোনো শিক্ষক ছিলেন না, ধর্মীয় শিক্ষার যেকোনো সংকটে তিনি এগিয়ে আসতেন একজন সেনাপতির মতো। তিনি প্রায় ৩৬ বছর বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তার সময়কালে হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা, অবকাঠামো, উন্নয়ন ও পরিচিতি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ইসলামি দরসগাহ হিসেবে হাটহাজারী মাদরাসার সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। হাটহাজারী মাদরাসা পরিণত হয়েছে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ হিসেবে। হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদিস হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন বুখারি শরিফের দরস দান করেছেন। শুধু তাই নয়, শাইখুল হাদিস হিসেবে তিনি দেশের অসংখ্য মাদরাসায় খণ্ডকালীন শাইখুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নব্বই-ঊর্ধ্ব বয়সেও তিনি হাদিসের দরস ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শিক্ষা নিয়ে বহুমুখী ধারায় কাজ করেছেন। ধর্মীয় শিক্ষার যেখানে সংকট পরিলক্ষিত হয়েছে তিনি সেখানে তাঁর মেধা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা করেছেন।

তারা বলেন, কওমি মাদরাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির অবদান বিষয়ে আপনারা সকলেই অবগত আছেন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া-বেফাক এবং হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি মাদরাসা শিক্ষার মান ও উন্নয়নে নিরলস ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত কওমি সনদের স্বীকৃতি অর্জনে তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। লাখ লাখ কওমি শিক্ষার্থী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণের দাবিকে তিনি বাস্তবে রূপদান করেছিলেন। শিশুদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আল্লামা আহমদ শফী রহ. প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ড। দেশব্যাপী কয়েক হাজার শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মকতব, স্কুল পরিচালিত হচ্ছে এই বোর্ডের মাধ্যমে। নারীশিক্ষা বিষয়েও তিনি ছিলেন অগ্রদূত। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বপ্রথম বালিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। পরবর্তী সময়ে আরও শতাধিক বালিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় তিনি পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেন। সেসব মাদরাসায় আজ হাজার হাজার মেয়ে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইসলাম ও দেশের সাক্ষরতায় নিরব ভূমিকা রাখছে।

তারা আরো বলেন, মদিনা ইউনিভার্সিটি, আল-আজহার ইউনিভার্সিটি, দারুল উলুম দেওবন্দসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আল্লামা আহমদ শফী রহ. ছিলেন বরাবরই উৎসাহী। তার কাছে কোনো শিক্ষার্থী সহযোগিতার জন্য গেলে তিনি তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করতেন। তাঁর প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় দেশের অনেক কওমি শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। এভাবে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিটি সংকটকালে আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এগিয়ে এসেছেন সবার আগে। একজন সিপাহসালারের মতো তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষার অগ্রযাত্রায়। এ দেশের শিক্ষা বিপ্লবে তার অবদান তাই চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে অযুত কাল ধরে। আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আজ আমাদের মাঝে নেই। তার ইন্তেকালের পর দীর্ঘ দুটি বছর পার হয়ে গেছে। তাঁর অভাব ও শূন্যতা বিগত দুটি বছর আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তার অবর্তমানে বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গন ও ধর্মীয় শিক্ষার অনেক অর্জন আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তাকে ছাড়া আমরা যেন নাবিকহীন জাহাজের মতো উত্তাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই আজ তার দেখানো পথ অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই।