আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ও ইসলাম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

সেপ্টেম্বর ২৫ ২০২১, ২২:০২

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত: আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ও ইসলামের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতা রয়েছে। এই কারণে পোস্ট-কলোনিয়াল মুসলিম দুনিয়ায় আধুনিক সেক্যুলার-লিবারেল-গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়নি। এমনকি এসব মুসলিম দেশে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোতে কথিত “ইসলামী রাষ্ট্র” গঠনের উদ্যোগও সফল হবার সম্ভাবনা অনেক কম।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এইসব দেশে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র একটা অসম্ভব বিষয় হিশেবে দেখা দিয়েছে। এর মূল কারণ ইসলাম। এইসব দেশের সমাজে ইসলামের শিকড় এত গভীরভাবে প্রোথিত যে এসব দেশে বৈধতা তৈরি করার যে কোনো বিকল্প সেক্যুলার গঠনমূলক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। তা সে যে কোনো রকমের সেক্যুলার বয়ানের উপরেই সেটা গঠনের উদ্যোগ হোক না কেন—যেমন জাতীয়তাবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী কিংবা বাম-আন্তর্জাতিকতাবাদী—এসব বয়ানের কোনোটিই এই ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি।

লিবারেল গণতন্ত্র পুঁজিতন্ত্রের জান্তব আগ্রাসন থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করে না। এই ব্যবস্থা ধর্মীয় অঙ্গীকার, সম্প্রদায়গত ন্যায়নীতি এবং পরিবেশগত স্বয়ম্ভূতার সঙ্গে স্ববিরোধী সম্পর্ক রচনা করে। আধুনিক রাষ্ট্র ইসলামের সঙ্গে স্ববিরোধী ও সাংঘর্ষিক হবার কারণে সমকালীন স্কলার ওয়ায়েল হাল্লাক একে মুসলিম বিশ্বের জন্য ‘অসম্ভব রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র একটি বিনৈতিক, যদি না অনৈতিক প্রতিষ্ঠান—যা ইসলামকে ধারণ করতে অক্ষম কিংবা অসমর্থ। সর্বগ্রাসী আধুনিক রিপাবলিকান জাতিরাষ্ট্র থেকে ইসলামের পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য তিনি ইসলামে এই ধরনের রাষ্ট্র ধারণা নেই বলে উল্লেখ করেছেন। বরঞ্চ তিনি বলেছেন যে ইসলামে আসলে যা রয়েছে তাকে “রাষ্ট্র” না বলে “শাসন” (Government/Governance) বললে তা সঠিক হবে। এটিই হল ইসলামে বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রাক-আধুনিক ধারণা ও অনুশীলনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের এই ইউরোপীয় উৎস ও চারিত্র বিবেচনায় নিয়ে ওয়ায়েল হাল্লাক

দেখাতে চেয়েছেন যে—আধুনিক ইসলামিস্ট বয়ান অনুমান করে যে আধুনিক রাষ্ট্র যেন

শাসনের একটি নিরপেক্ষ উপায়, যা এর নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশের ভিত্তিতে যে কোনো উদ্দেশ্য ও কার্য সম্পাদন করাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা মনে করে যে কুরআনে বিধৃত মূল্যবোধ ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য এই উপায়কে প্রয়োজনমত ব্যবহার করা যেতে পারে। রাসুল স. মদীনার “প্রত্ন-রাষ্ট্রে” যে শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন সেটির আলোকে এই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে অভিযোজিত করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ওয়ায়েল হাল্লাক মনে করেন যে এটি অসম্ভব কিংবা অমূলক একটি প্রকল্প। তিনি মনে করেন যে এই আধুনিক জাতিরাষ্ট্র নিজেই এমন এক সুনির্দিষ্ট জ্ঞান-ব্যবস্থা তৈরি করে যা ব্যক্তিক ও সামষ্টিক কর্তাসত্তার পরিসরকে নির্ধারণ করে ও আকৃতি দেয়; এর মাধ্যমে নাগরিক সম্প্রদায়ের জীবনের তাৎপর্যকে গঠন ও রূপায়িত করে তোলে।

ইসলামীয় কাঠামোতে আধুনিক রাষ্ট্রের এই “অসম্ভাব্যতা” নিহিত রয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রের টমাস হবস কথিত দানবীয় লিভায়াথান চারিত্রে। আধুনিক রাষ্ট্র সংজ্ঞাগত দিক থেকেই কেন্দ্রীভূত অতিক্ষমতাশালী। কাজেই ধর্মীয় অভিমত এবং প্রতিষ্ঠানগুলি আধুনিক রাষ্ট্র কর্তৃকই অনুমোদিত হয়; এর উল্টোটা সত্যি নয়। এমনকি যদি রাষ্ট্রের এলিটরা “মুসলিম” কিংবা “ইসলামী”ও হয়ে থাকে, তবুও কাঠামোগতভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের “ইসলামী রাষ্ট্র” হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। আধুনিক রাষ্ট্র শেষ বিচারে সেক্যুলার এবং নিরন্তর সেক্যুলারায়নে লিপ্ত। কাজেই “ইসলামী রাষ্ট্র”-এর ধারণা একটি অক্সিমোরন বা সোনার পাথর বাটি বা স্ববিরোধী ধারণা। বিগত কয়েক দশকে “ইসলামী” বলে দাবীদার বাস্তব রাষ্ট্রগুলির বাস্তব অভিজ্ঞতা এই বিবেচনা ও মূল্যায়নকেই নিশ্চিত করে।