অবেলায় ঝড়ে পড়ে প্রস্ফুটিত গোলাপ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ০৬ ২০১৮, ১০:২৫

এক

হেমন্তের রাতে এখন মৃদু কুয়াশা; বাতাসে শীতের হিম হিম স্পর্শ। আমি অস্থির মনে বসে আছি ঢাকা-হবিগঞ্জগামী ‘দিগন্ত’ বাসে। গন্তব্য হবিগঞ্জ সদর। বড় বোন অসুস্থ। রক্তের প্রয়োজন। নিজের বোনকে রক্ত দেয়ার তাগিদেই ছুটেচলা।
গড়িতে তখন রাত দশটা বাজে ১২ মিনিট। হবিগঞ্জ টার্মিনালে পৌঁছলাম। শূণ্য টার্মিনাল জানান দিচ্ছে অন্যদিনের তুলনায় আজকের শীতের দাপট একটু বেশী। টার্মিনালের কয়েকটি নেড়ি-কুকুর শীতে কাতর হয়ে শুয়ে আছে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চাকার নিচে। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে যাত্রিবিহীন কয়েকটি রিকশা। আমি প্রথম রিকশা উঠে বসি। খানিক বাদে রিকশা আমাকে নামিয়ে দেয় হবিগঞ্জ “বদরুন্নেসা” হাসপাতালের সামনে। আমি ভেতরে প্রবেশ করি। বোনের অবস্থা জানতে চাই প্রথমে। একজন নার্স সিজারে বাচ্চা হয়েছে বলে জানান দেন। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকরিয়া আদায় করি। মামা হওয়ার আনন্দে। আমার চোখে মুখে বিরাজ আনন্দের ঢেউ৷ আমি হাসছিলাম পুষ্পের হাঁসি।

কিছুক্ষণ পর..

কর্তব্যরত নার্স এসে নবজাতককে শিশু বিভাগে ভর্তি করাতে বললে আমরা নিয়ে যাই হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। বাংলাদেশের সব সদর হাসপাতালগুলোর অবস্থা কম বেশ অনেকেরই জানা আছে। একজন নার্স আমাদেরকে শিশু কেবিনে নিয়ে যায়। রুমে ঢুকার আগে নাকে মুখে রুমাল চেপে ধরতে বাধ্য হই। মূল রুমের দরজায় একটু জায়গা।এখানে গ্রাম থেকে আসা রুগিদের ভিড়। নবজাতক নিয়ে বসে আছে সবাই। মূল কেবিনে জায়গা নেই।তবে নার্সদের আরাম আয়েশের বিশাল একটি রুম খালি। কিন্ত কাউকে ঢুকতে দেয় না তারা। আয়েশে ব্যাঘাত ঘটে যাওয়ার ভয়ে! আমরা নবজাতককে রেখে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি৷ রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মানুষের আগমন যেন আরও বাড়ছে। যে স্থানটিতে ১০-১৫ জন দাড়ানো অসম্ভবপ্রায় সেখানে শুয়ে-বসে আছেন ৩৭ জন মহিলা! সবার কোলে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় নবজাতক।

দুই

আমরা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম। ভেতরে রাখা নবজাতকদের কয়েকজনকে জালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল৷ কাছের ভেতর শুয়ানো। উপরে বিদ্যুৎতিক আলো৷ তাদেরকে ওম দেয়া হচ্ছে৷ রুমের বাহিরের চারপাশে অপেক্ষারত অনেককে আনমনা হয়ে বসে আছেন। হঠাৎ আমার দৃষ্টি যায় ছাদের এক কোনে। গ্রীল ধরে বসে আছে ছোট একটি বাচ্ছা ছেলে৷ শীতে কাপছে। নিচে নিল রঙের পলিথিন বিছানো। পাশে একটি একটি ব্যাগ। ব্যাগের উপর একটি কলা এবং পাউ রুটির কিছু অংশ। আমি কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করি, তার নাম রিয়াদ। রিয়াদের মা সিজারে দুটো বাচ্ছা জন্মদিয়েছেন। রিয়াদ তো বুঝে না ভাই হওয়ার আনন্দ কি? অনুধাবন করতে পারে না একজন নারীর মা হওয়ার আনন্দ। তবুও তো রিয়াদ মায়ের সাথে হাসপাতালে। ছাদের কোনে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছে রাত।
রিয়াদকে প্রথম দেখাতেই মনে হচ্ছিল সে কোন অজপাড়াগায়ের দরিদ্র পরিবারের সন্তান।পৃথিবীর আলো দেখার পর হয়তো তার কপালে সুখ জুটেনি। জীবনে পথে সে হয়তো এভাবেই যুদ্ধ করে চলছে প্রতিনিয়ত। আজ যদি দায়িত্বরত নার্সদের একটু হামদরদি থাকতো, তবে রিয়াদের মতো বাচ্ছা ছেলেদের শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে এভাবে থাকতে হতো না৷

তিন

শিশু বিভাগের বাহিরে দাঁড়িয়ে আমাদের রাত কেটে যায়৷ পূর্বের আকাশে সকালের সূর্য আস্তে আস্তে মাথা তুলতে থাকে। ডিমের কুসুমের মতো লাল সূর্য খোসা ছড়াতে ছড়াতে চারদিক আলোকিত করে। একজন চা বিক্রেতা প্লাক্সে করে চা নিয়ে হাজির। সোনামাখা রুদে বসে আছে অনেকেই। গা ছম ছম।আমি দৈনিকের পাতায় হাত বুলাচ্ছিলাম। অনেককেই দেখাগেল ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কাপে ওষ্ঠ মিলাতে। মিনিট দুয়েক বাদে আমার কয়েফিট দূরত্বে একজন মহিলা এসে বসে। মানুষজন গল্পগুজবে ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের সব কথায় ‘খ’ বর্ণের স্পষ্ট উচ্চারণ আমাকে আনন্দ দিচ্ছিল। সিলেটের লোকদের ‘খ’ উচ্চারণ সম্পর্কে কম-বেশ জানা আছে আমাদের। আমি এই ভাষার প্রতি দুর্বল৷ শুনতে ভালো লাগে।আমার পাশে বসা মহিলা ফোন করার প্রস্ততি নিচ্ছেন।আমি তার সিলেটি ভাষার কথাগুলো কাছ থেকে শুনতে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বসলাম। ভদ্র মহিলা তার মার কাছে ফোন করেই হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলো।

নার্সদের অবহেলায় তার বাচ্ছাটাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন তার সংসার ভাঙ্গার ভয়। স্বামীর সাথে বিবাদ হওয়ায় সে হাসপাতালে আসেনি৷ বাচ্চা মরে যাওয়ায় স্ত্রীকে সংসার ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি ধমকি দিচ্ছে। মহিলাটি যখন হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিল আমার কলজেটা ফেঁটে যাচ্ছিল। গর্ভপাতের পর একজন মহিলা তার সঠিক যত্নের প্রয়োজন অনুভব করে, কিন্ত ভাগ্যের বলে আজ হলো তার উল্টোটা। নিজের শরীর-স্বাস্থ্য থেকে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে তার সংসার। এই হলো স্বাধীন দেশের অবস্থা। যাদের কলজে ছেঁচা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা তারাই আজ অবহেলিত। আমরা বক্তব্যে বলে থাকি ৩০ লক্ষ্য মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের আজকের এই স্বাধীনতা। তাহলেই কী আমরা ধরে নেব সেই ৩০ লক্ষ্য মা-বোন শুধু দেশের নেতৃস্থানীয়দের মা বোন ছিল? অজপাড়াগায়ের, খেটে খাওয়া মানুষের এখানে কোন অবধান নেই? প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম সেই প্রভুদের কাছে যাদের কাছে স্বাধীন দেশের আপামার জনগনের কোন মূল্য নেই৷

প্রিয় পাঠক!

এই ধরণের কল্পকাহিনি নিত্যদিনের। আমরা গভীরভাবে চিন্তা করলে এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পারি।
সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা থাকতো, মানুষ রাসুলে আরবীর আদর্শ নিয়ে চলত, তাহলে মানুষ অন্যের প্রতি অবহেলা করার সু্যোগ পেত না। হাদীসের দিকে তাকালেই আমরা এর প্রতিকার পেয়ে যাই৷

কথায় আছে ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। আসলে বলা উচিত, ‘ব্যবহারে মুসলমানের পরিচয়’। কোরআনের পাতায় পাতায় এবং রসুল (সা.)-এর জীবনের বাঁকে বাঁকে এ সত্যটিই উঠে এসেছে নানাভাবে। সুন্দর ব্যবহার, ভালো আচরণ ছড়িয়ে দেওয়া ছিল রসুল (সা.)-এর নবুয়াতি মিশন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে পাঠানোই হয়েছে মানুষকে ভালো আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার খুটিয়ে খুটিয়ে শেখানোর জন্য।’ (মুআত্তা মালেক) ‘তাই যে মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, আচরণের মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেয়, সে আমার চোখে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উম্মত। কেয়ামতের দিন এ ধরনের উম্মতকে আমার শাফায়াত ও হাউজে কাওসারের পানি থেক

দূরে থাকতে হবে। আর আমি নবী থেকে যে দূরে থাকবে জান্নাত তার কপাল থেকে চিরতরে মুছে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ।) আল্লাহ সঠিক বুঝ দাতা৷ আমীন।

মাহমুদুল হাসান

লেখক : তরুন সাংবাদিক