১৯৭৫ এর ১৬ আগস্টে বর্তমান বনমন্ত্রীর লেখা সম্পাদকীয় নিয়ে বিতর্ক
একুশে জার্নাল
আগস্ট ১৬ ২০১৮, ০৫:২৮
আজ ১৬ আগস্ট! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পরের দিন। এই দিনে তখনকার ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় পাতায় ছাপানো বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পত্রিকা ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে সমালোচনা। কী ছিলো সেই কলামে? একুশে জার্নাল’র পাঠকদের জন্য নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো।
তারিখ: ১৬ আগস্ট ১৯৭৫
সম্পাদকীয়
#ঐতিহাসিক নবযাত্রা
দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববতী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাবগম্ভীর অথচ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তাহার নূতন সরকারের প্রতি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর অধিনায়কগণ তাহাদের স্ব স্ব বাহিনীর পক্ষ হইতে অবিচল আস্থা ও আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ যথা বাংলাদেশ রাইফেল, পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীর প্রধানগণও নূতন সরকারের প্রতি তাহাদের অকুন্ঠ আনুগত্য জ্ঞাপন করিয়াছেন এবং সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার পবিত্র দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিরবর্তনের এক বিষাদময় পটভূমি রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়। কিন্তু বিগত সাড়ে তিন বছরেরও ঊর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তবক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় গভীর হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। নয়া রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে তাহার বেতার ভাষণে এই দুর্ভাগ্যজনক পটভূমির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়াছেন। গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্খায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নিমর্মভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে। সুজলা সুফলা সোনার বাংলার সোনার মানুষদের চরম হতাশার কবলে ঠেলিয়া দেয়া হইয়াছে। ফলে বাংলার মানুষের নিত্যসঙ্গী হইয়াছে ক্ষুধা, বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও অসহনীয় অর্থনৈতিক নির্যাতন। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠুর অবহেলার ফলে একদিকে চরম অর্থনৈতিক বঞ্চনা, অপরদিকে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির নজিরবিহীন অগ্নিমূল্যের ফলে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে বিপর্যয় নামিয়া আসে। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া পড়ার উপক্রম হয়, বিশেষত পাটশিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়ায়। স্থায়ীভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আকাঙ্খায় একটি ক্ষুদ্র কোটারী দেশে একটির পর একটি রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি চালিতে থাকে। ফলে অব্যক্ত বেদনায় গুমড়িয়া মরে সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তর।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকারের আশা-আকাঙ্খা রূপায়ণে খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে যে আগাইয়া আসিতে হইয়াছে তাহারও কারণ ছিল। পূর্ববর্তী শাসকচক্র সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়া সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসের গতিকে কোনদিন ক্ষমতালিপ্সা বাঁধ দিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায় না। বাংলাদেশের যে বীর জোয়ানরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া একদিন লড়িয়াছে, রক্ত দিয়াছে, তারা দেশের এ ঘোর দুর্দিনে নিশ্চুপ বসিয়া থাকিতে পারে নাই। জাতির প্রতি, দেশের নির্যাতিত ও নিপীড়িত জনগণের প্রতি তাহাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করিয়াছে অকুতোভয় সাহস লইয়া। কিন্তু জনগণের প্রতি যে তাহাদের কোন বিদ্বেষ নাই, রহিয়াছে শুধু মমতা, তাহা ফুটিয়া উঠিয়াছে জনগণের সঙ্গে তাহাদের বন্ধুত্বপূর্ন আচরণে।
আজকের এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে আমাদের দায়িত্ব অনেক। বাংলাদেশের এক মহাক্রান্তিলগ্নে জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনী যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে তাহাকে সুসংহত করিতে হইলে জনগণের প্রতি অর্জিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সকলকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া যাইতে হইবে। জাতীয় জীবনের প্রচলিত মহৃল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর যে সুযোগ অতীতে একবার হেলায় হারানো হইয়াছে পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহে সেই সুবর্ণ সুযোগ আবার আমাদের সামনে সমুপস্থিত। সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতে হইবে আমাদের। সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখা ও আইন রক্ষাকারী সংস্থাসমুহ যেইভাবে একযোগে দেশ গড়ার এই নূতন দায়ত্বে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন জনগণকেও একতাবদ্ধ হইয়া অনুরূপভাবে তাহাদের পবিত্র দায়িত্ব পালনে আগাইয়া আসিতে হইবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সর্বপ্রকার অনাচারের মূল্যোৎপাটন করিতে হইলে আমাদের অনেক সংগ্রাম সাধনা করিতে হইবে। কিন্তু এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শান্তি-শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখা, আইনের প্রতি অবিচল আনুগত্য প্রদর্শন, সর্বোপরি দেশ গড়ার এক পবিত্র দায়িত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আত্মনিয়োগ করা। সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ অতীতের ন্যায় এবারও এ মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিবে, এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
বিশ্বের বিভিন্ন শান্তি ও কল্যাণকারী দেশসমূহহ, বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের যথার্থতা শিগগিরই উপলব্ধি করিবেন বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ সকলের বন্ধু থাকিতে চায়, কাহারো প্রতি তাহার শত্রুতা নাই। এমনকি যাহাদের সাথে বাংলাদেশের এতদিন বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই নয়া সরকার তাহাদেরও বন্ধুত্ব প্রয়াসী। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং অপরের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বাসী। ইহুদীবাদ, বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার আপোষহীন থাকিবে। জাতিসংঘের সনদের প্রতি আমাদের আস্থা অটুট। জোট নিরপেক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মৈত্রী, উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণ ও বিশ্বশান্তির নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশ। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ ও জোট নিরপেক্ষ ফোরামের সদস্য থাকিয়া বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করিয়া যাইবে।
নবগঠিত সরকার শুধু দেশের অভ্যন্তরেই এক কলুষমুক্ত নয়া সমাজ গড়িতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নয়, বিশ্ব শান্তি নির্মাণেও তাহারা ঐতিহাসিক অবদান রাখিতে প্রয়াসী। বলাবাহুল্য, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অনাবিল আশা-আকাঙ্খাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে নয়া সরকারের ঘোষিত নীতির মধ্যে। এ পবিত্র সংকল্প জয়যুক্ত হোক, ইহাই এ মুহুর্তে আমাদের সকলের কামনা।
( সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: আনোয়ার হোসেন)