১২ রবিউল আউয়াল: ঈদে মিলাদুন্নবীর স্বরূপ
একুশে জার্নাল
অক্টোবর ২৬ ২০২০, ২৩:৫২
মাওলানা আবরারুল হক: ১২রবিউল আউয়াল।আরবি ৩য় মাস। আমাদের নবী স. এর জন্মের মাস। এ মাসের ১২ তারিখ এলে একদল মুসলিম ঈদে মিলাদুন্নবী নামে ব্যাপক উৎসব ও আনন্দমুখর আয়োজন করে থাকে।
এদিনে তারা জশনে জুলুস, ব্যানার-ফেস্টুন,গেট সাজানো, শোভাযাত্রা, সভা-সমাবেশ, মিষ্টান্ন-খিচুড়ি, তবারক ইত্যাদি বিতরণের ব্যবস্থা করে । সর্বোপরি তারা এটাকে মহাপূণ্যের কাজ মনে করে। তাদের উৎসবমুখরতা দেখলে মনে হয়, এটি মুসলিমদের অনেক বড় জাতীয় কোন উৎসব । আর তারা শ্লোগানও দেয় “সকল ঈদের সেরা ঈদ বিশ্বনবীর জন্ম ঈদ”। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছে সাইয়েদুল আইয়াদ শরীফ/সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ।
আসলে এ ঈদ কতটুকু ইসলাম সম্মত?
হযরত আনাস (র) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা:) যখন মদীনায় আসেন, তখন মদীনাবাসীরা দুটি দিবস উদযাপন করত, এগুলোতে তারা আনন্দ-ফুর্তি করত। রসূলুল্লাহ (সা:) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এদিন দুটো কী? তারা বললেন, আমরা ইসলামপূর্ব যুগে এ দিনগুলোতে আনন্দ-উৎসব করতাম। তখন আল্লাহর রসূল বললেন, আল্লাহ এগুলোর পরিবর্তে তোমাদের দুটি উত্তম দিন দান করেছেন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ( সুনানে আবু দাউদ:১১৩৪)
এ হাদীস থেকে বোঝা যায় রাসুল স. পূর্বের উৎসব বাতিল করে মুসলিমদের জন্য দুটি ঈদ নির্ধারণ করেছেন । এর অতিরিক্ত কোনো ঈদ যোগ করা হলে, সেটা আল্লাহ এবং রাসুলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা হবে। কিন্তু, তাদের ধৃষ্টতার মাত্রা দেখুন, তারা আল্লাহর দেওয়া ঈদের চেয়ে নিজেদের আবিষ্কৃত ঈদকে সেরা মনে করে।
ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা সুস্পষ্ট বিদআত: রসূলুল্লাহ (সা:) নবুওয়াত লাভের পর ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি কখনো নিজের জন্মদিন পালন করেননি। তার ইন্তিকালের পর তার খোলাফায়ে রাশেদীনরাও এটা পালন করেননি।এরপরও কোনো সাহাবী, কোনো তাবেয়ী বা কোনো তাবে তাবেয়ীও নবীজীর জন্মদিন পালন করেননি। হাদীস গ্রন্থসমূহে নবীজীর কথা, কাজ, আচার-আচরন, অনুমোদন, সাহাবী ও তাবেয়ীদের মতামত ও কর্ম সংকলিত হয়েছে। সহীহ হোক বা দুর্বল, এমন কোনো বর্ণনাই সেগুলোতে পাওয়া যায় না যে, নবীজীর জীবদ্দশায় বা তার ইনতিকালের পর তিনি নিজে বা অন্য কোনো সাহাবী, তাবেয়ী সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তার জন্মদিন উদযাপন করেছেন।
ইসলামে কোনো নবী, রসূল বা মহান ব্যক্তির জন্মদিবস পালনের বিধান নেই। রসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের এই ধর্মে এমন কিছু সৃষ্টি করে, যা এর অন্তর্ভূক্ত নয়, সেটা প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহীহ বুখারী:২৬৯৭, সহীহ মুসলিম:১৭১৮) এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা বিদআত। মূলতঃ ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের প্রথা মুসলিমদের মাঝে এসেছে বিধর্মীদের অনুসরনে।
আমরা বিধর্মীদের মাঝে এগুলোর ব্যাপক প্রচলন দেখতে পাই। যেমন, খ্রিস্টানদের বড়দিন,হিন্দুদের জন্মাষ্টমী, বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি। বিষয়টা আসলে নবীজীর এক ভবিষ্যতবানীর বাস্তবায়ন। তিনি বলে গিয়েছেন, রসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, তোমরা অবশ্যই প্রতিটি বিঘতে বিঘতে, প্রতি হাতে হাতে পূর্ববর্তীদের কর্মনীতির অনুসরণ করবে। এমন কি তারা যদি গুইসাপের গর্তেও ঢুকে থাকে, তোমরা তাদের অনুসরণ করবে। সাহাবীরা বললেন, তারা কি ইয়াহুদী-খ্রিস্টান? তিনি বললেন, তবে আর কারা? (সহীহ বুখারী:৭৩২০, সহীহ মুসলিম:২৬৬৯)
নবীজীর জন্মদিন কি ১২ রবিউল আউয়াল:
অনেকে মনে করেন, ১২ রবিউল আউয়াল নবীজীর জন্মদিন। এটি আসলে নিতান্তই দুর্বল একটি মত। এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, ৮ রবিউল আউয়াল। এ ছাড়া ২,৯ রবিউল আউয়াল ইত্যাদি বর্ণনা রয়েছে। বিজ্ঞ পাঠক, লক্ষ্য করুন, নবীজীর জন্মতারিখ নিয়ে অস্পষ্টতা ও মতভেদ থাকাই প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (সা:) ও তার সাহাবীরা তার জন্মদিনের বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেননি। আর যদি তারা সেদিন জাতীয় ঈদোৎসব পালন করতেন, তাহলে তো তার জন্মদিবস অজানা বা তা নিয়ে মতভেদ থাকতো না ।
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি সর্বপ্রথম শিয়া, রাফেযী সম্প্রদায় ৩৫৮ সন থেকে বিভিন্ন দিবস পালন করা শুরু করে। এরপর হিজরী ৭ম শতাব্দীতে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান ব্যাপকতা লাভ করে। ইরাকের ইরবিল প্রদেশের গভর্নর আবু সাঈদ মুযাফফর কুকবরী এটি কে আরো বিস্তৃত করে। এভাবে চলছে বর্তমান অবধি।
তাহলে আমরা কী করব? হাঁ! রাসুল স. এর জন্ম আমাদের জন্য রহমত স্বরুপ। এ জন্য আমরা অন্য মাসের তুলনায় এমাসে বেশি বেশি নবী স. এর সীরাত পাঠ করব। নবীজীর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নতুন ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হব। এটাই হোক আমাদের জীবনের পণ। আমিন!
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মদীনাতুল উলুম, কেরাণীগঞ্জ,ঢাকা।