হেফাজতে ইসলাম আগে নাকি হেফাজতে ইনসান? -কাজী কামরুল হাসান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ১১ ২০২০, ২০:০৯

করোনার মত একটি দ্রুত সংক্রমণশীল ও অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে গোটা পৃথিবী আজ লকডাউনে। প্রতিটি দেশের মানুষ নিজ নিজ দেশে আবদ্ধ। শহরের মানুষ নিজ নিজ শহরে আবদ্ধ। মহল্লার মানুষ নিজ নিজ মহল্লায় আর ঘরের মানুষ নিজ নিজ ঘরে আবদ্ধ। ভয় একটাই, কাকে, কখন, কোন মূহুর্তে এবং কিভাবে এই গুপ্ত ভাইরাসটি আক্রমণ করে বসে!

এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে দ্বীন-ইসলামের ইজতেমায়ী ইবাদতগুলো যেমন, জুমু’আ-জামাত, হজ্জ-উমরাহ প্রভৃতি আদায় করতে গেলে ইনসানী জানের হেফাজত হয় না, আবার জানের হেফাজতের উদ্দেশ্যে ঘরে বসে থাকলে দ্বীনের হেফাজত হয় না। এমতাবস্থায় কোনটা হেফাজতের চিন্তা আগে করতে হবে? দ্বীন-ইসলামের হেফাজত অগ্ৰাধিকার পাবে নাকি জানের হেফাজত অগ্ৰাধিকার পাবে? এমন‌ই একটি দোলাচলে আজকে আমাদের আলেম সমাজ।

সকল আসমানী দ্বীন বিশেষ করে ইসলামী শরীয়া এসেছে মানব জীবনের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক কাঠামোগুলোকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য। এগুলোকে মানুষের মৌলিক অধিকারও বলা যেতে পারে। এগুলোকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘মাক্বাসিদুশ-শারিয়াহ’ বলে। ফুক্বাহা ও উসূলবিদগণ কুরআন-সুন্নাহের নুসুস তাতাব্বু-তালাশ করে পাঁচটি মৌলিক ‘মাক্বসাদে শরীয়াহ’ তথা শরীয়তের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ ছয়টিও বলেছেন। এগুলো নিম্নরূপ—

১— حفظ الدين (দ্বীনের হেফাজত)
২— حفظ النفس (ইনসানী জানের হেফাজত)
৩— حفظ العقل (মানুষের বিবেক-বুদ্ধির হেফাজত)
৪— حفظ النسل (মানব বংশের হেফাজত)
৫— حفظ العرض (মানুষের ইজ্জত-আবরুর হেফাজত)
৬— حفظ المال (মানুষের ধন-সম্পদের হেফাজত)

প্রকৃত পক্ষে মাক্বাসিদে শরীয়ার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুখি ও সমৃদ্ধশালী করে তাঁর আখেরাতের জীবনের কামিয়াবি নিশ্চিত করা।

অতীত ও বর্তমানের ফুক্বাহা ও উসূলবিদ তা ইসলামী আইনবিদগণ উল্লেখিত পাঁচ/ছয়টি মাক্বাসিদে শরীয়ার ক্রমবিন্যাস নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তাঁদের আলোচনার মূল নির্যাস হল, মাক্বাসিদে শরীয়ার প্রতিটি বিষয় স্বাভাবিক অবস্থায় তার নিজ নিজ স্থানে গুরুত্বের দাবি রাখে। অগ্ৰাধিকারের প্রশ্ন আসে যখন দুটি মাক্বসাদ একই সময়ে সমান্তরালে চলে আসে তখন উদ্ভুত পরিস্থিতির আলোকে একটিকে প্রাধান্য দিতে হয়।

অতীতের অধিকাংশ ফুক্বাহা সর্বাবস্থায় “হিফযুদ্দীন” -কে “হিফযুন-নাফস” এর উপর ‘মুক্বাদ্দাম’ করে সিরিয়ালে প্রথম স্থান দিয়েছেন। অনেকে আবার “হিফযুন-নাফস“ -কে “হিফযুদদীন” এর উপর প্রাধান্য দিয়ে সিরিয়ালে প্রথম রেখেছেন। এই ইখতেলাফের মূল কারণ হচ্ছে , “দ্বীনের” দ্বারা কী অর্থ বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি হল- দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য ঈমান-ইসলাম তথা পুর্ণাঙ্গ ইসলাম। দ্বিতীয়টি হল- দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য ইসলামের হুকুম-আহকাম ও ইবাদতসমূহ। যারা দ্বীন দ্বারা পুর্ণাঙ্গ ইসলাম উদ্দেশ্য নিয়েছেন তাঁরা হিফযুদ্দীনকে হিফযুন-নাফসসহ সকল মাক্বাসিদে শরীয়ার উপর অগ্রগণ্য করেছেন। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ও ঈমানের হেফাজতের জন্য জিহাদ এবং মুরতাদকে ক্বতলের বিধান জারি করেছেন ।

আর যারা দ্বীন দ্বারা ইসলামের হুকুম-আহকাম ও ইবাদতসমূহ উদ্দেশ্য নিয়েছেন তাঁরা “হিফজুন-নাফস” -কে “হিফজুদ্দীনের” উপর অগ্রগণ্য করেছেন। ইমাম রাযী রহ. এই অর্থেই হিফজুন-নাফসকে হিফজুদ্দীনের উপর অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। পরবর্তী অনেক ফুক্বাহা শেষোক্ত মতকেই গ্ৰহণ করেছেন।

এজন্যই দেখা যায় ইসলাম সাধারণভাবে তার শরয়ী বিধান পালনের ব্যাপারে মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। যখন আল্লাহ্ তায়ালা বললেন:
يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله حق تقاته ولاتموتن إلا و أنتم مسلمين – ( ال عمران – 102 )
অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনি ভাবে ভয় কর । এমনভাবে যে, তাঁকে মান্য কর এবং অবাধ্য হয়ো না। তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় কর এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না। তাঁকে সর্বদা স্মরণ কর এবং তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল থেক না। অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।”

এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের নিকট এভাবে আল্লাহকে ভয় করা অত্যন্ত কঠিন মনে হল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন– এমনভাবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আদায় করে তাঁকে ভয় করার কারো সাধ্য নাই। তখন আল্লাহ তায়ালা মানুষের সাধ্যানুযায়ী আমল করার কথা বললেন: فاتقوا الله ما استطعتم অর্থাৎ তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর”। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা শরীয়তের যাবতীয় হুকুম আহকাম মানুষকে তার শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করার আদেশ দিলেন, যাতে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন নিরাপদ থাকে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনের ব্যাপারে মানুষকে তার স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে সাধ্যানুযায়ী আমল করার জন্য আদেশ করেছেন। তিনি বলেন—
ما نهيتكم عنه فاجتنبوه ، و ما أمرتكم به فأتوا منه ما استطعتم – ( رواه البخاري ومسلم )
অর্থাৎ “আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করেছি তা থেকে তোমরা বিরত থাক এবং যা করতে আদেশ করেছি তা যথাসাধ্য আমল করার চেষ্টা কর”।

কাজেই বুঝা গেল, ইসলাম সাধারণভাবে শরীয়তের হুকুম-আহকাম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের শারীরিক, মানসিক সামর্থ্যের প্রতি নজর রেখেছে। এতে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, যেখানে মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি রয়েছে, প্রাণনাশক রোগ-বালাইয়ের সম্ভাবনা আছে সেখানে নিঃসন্দেহে ইসলামী অনুশাসনে শিথিলতা থাকবে এবং হেফাজতে ইনসানকে হেফাজতে ইসলামের উপর অগ্রগণ্য করা হবে, আর বাস্তবেও তাই করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তায়ালা হিফজুন-নাফসকে হিফজুদ-দীনের উপর অগ্ৰাধিকার দিতে গিয়ে কিছু ইবাদত ও আহকামকে শিথিল করে দিয়েছেন। যেমন, মুসাফিরের জন্য চার রাকাতের পরিবর্তে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা এবং রমজানের রোজা না রাখা।
অসুস্থ ব্যক্তির জন্য দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার পরিবর্তে বসে নামায পড়ার বিধান করে ইনসানী মুসলেহাত তথা মানুষের প্রয়োজনকে দ্বীনের মুসলেহাতের ‍উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে নামায ভেঙ্গে ডুবন্ত ব্যক্তিকে বাঁচানোর বেলায়ও নামাজের উপর হেফাজতে ইনসানকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে ঝড়-বৃষ্টি, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও ভয়-ভীতির কারণে ইসলাম মুসলমানদেরকে জুমু`আ ও জামাতের আবশ্যকতাকে শিথিল করে মসজিদে যাওয়া থেকে ছাড় দেয়া, হেফাজতে ইসলামের উপর হেফাজতে ইনসানকে অগ্রগণ্য করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সম্মানিত পাঠক! যখন ইসলাম ও শরীয়তের মাক্বসাদ এবং মেজাজ বুঝা গেল যে, যখন হেফাজতে ইসলাম (حفظ الدين) ও হেফাজতে ইনসান (حفظ النفس) পারষ্পরিক সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে তখন حفظ النفس অর্থাৎ হেফাজতে ইনসানকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। কারণ ইনসানই হচ্ছে শরীয়তের ‘তাকালীফ’ বহনের কেন্দ্রবিন্দু। সে হচ্ছে ‘মুকাল্লাফ’। এই মুকাল্লাফ ইনসানী জানের যদি খতরাহ হয়, সে যদি বেঁচে না থাকে তাহলে তো মুকাল্লাফই থাকল না, তখন কে বহন করবে শরীয়তের তাকালীফ, কার মাধ্যমে হবে حفظ الدين বা দ্বীনের হেফাজত। এজন্যই আগে মুকাল্লাফ ইনসানের হেফাজত প্রয়োজন, তারপর হেফাজতে দ্বীন বা ইসলাম ।

উপরের আলোচনায় এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আমাদের আজকের প্রেক্ষাপটেও হেফাজতে ইসলামের উপর হেফাজতে ইনসানকে অগ্রগণ্য করতে হবে। জুমু`আ ও জামাত মসজিদে না গিয়ে ঘরে আদায় করতে হবে। কারণ করোনাভাইরাস এমন একটি অদৃশ্য ও প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে ভাইরাস যা আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও স্পর্শের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির নিকট সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাস বিস্তারের উর্বর জায়গা হচ্ছে সব ধরনের গণজমায়েত। কাজেই যখন ইসলামের হেফাজতের চেয়ে ইনসানের হেফাজত অগ্রগণ্য বেশী তখন ইনসানের হেফাজতের জন্য সব ধরনের গণজমায়েত বিশেষ করে ধর্মীয় গণজমায়েত থেকে বিরত থাকতে হবে এবং জুমু`আ-জামাত ঘরে আদায় করতে হবে ।

আজকে যারা দ্বীন-ইসলামের হেফাজতের নামে মসজিদে জুমু`আ-জামাত কায়েম রাখার জন্য ‘ইসরার’ করছেন তাঁরা মূলত ইনসানী জানকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। লা সামাহাল্লাহ, তাঁদের এই জাতীয় হঠকারী ভুমিকার কারণে যদি করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়ে অসংখ্য মানুষ মারা যায় তাহলে তাঁরা যেমন ইসলামকে কলঙ্কিত করবেন তেমনি তাঁরা মানুষ হত্যার দায়ভারও বহন করবেন ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সহীহ সমঝ দান করুন এবং করোনাভাইরাস থেকে হেফাজত রাখুন। আল্লাহুম্মা আমীন।