হেফাজতে ইসলামের প্রতি বিনীত নিবেদন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ০৬ ২০২৫, ২২:০০

আহমদ যাকারিয়া


হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এ দেশের কোটি কোটি তৌহিদী জনতার ঈমান-আক্বিদা রক্ষার অপ্রতিরোধ্য, আধ্যাত্মিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। তাই এর প্রতি আবেগ, দায় ও দরদ রয়েছে সবার। আর এই জায়গা থেকে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই।
এখন আর নব্বই দশকের যুগ নয়। এটা মাথায় রাখতে হবে। আগের যুগের সভা, সমাবেশে কে কী বলল; এসব রেকর্ড থাকত না তাই অনেকে অনেক সময় বেহুদা বকওয়াস কথাবার্তা বললেও এর প্রতিক্রিয়া আসত না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সীমিত, আর তথ্য প্রবাহেরও ছিল সীমাবদ্ধতা। কিন্তু এখনকার যুগ গ্লোবালাইজেশনের যুগ। যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে আপনি সিলেটের অজপাড়া গাঁয়ে কথা বললেও আপনার শ্রোতা কিন্তু সারা বিশ্বের লোকজন। কারণ আপনার বক্তব্যের সময় সামনে সরাসরি একশো লোক থাকলেও ভিডিওর মাধ্যমে তার শ্রোতা কিন্তু লাখো মানুষে পৌঁছে যায়। একটা ভিডিও ডাউনলোড করে হাজারজন রীলস বানিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টেলিগ্রামে ছেড়ে দেয়। ভিডিওর আগ-পিছ কেটে আংশিকও প্রচার করে অনেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তখন মানুষ মন্তব্য করতে সুযোগ পায়। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে আলেম সমাজের বক্তব্যের মধ্যে শব্দ চয়ন হতে হবে মার্জিত শব্দে ও কথা বলার ধরণ হতে হবে  পরিশীলিত।
রাজনীতির সভা-সমাবেশে স্টেজে বসে কেহ সিগারেট খেলে সেটাকে আমরা অভদ্রতা বলি অথচ হুজুররা রাজনীতির মঞ্চে বসে পান খান দু’গাল ভরে এটাকে আমরা সংস্কৃতি বলি! এই চিন্তা থেকে বের হতে হবে। রাজনীতির মঞ্চে বসে পান খাওয়া এটাও অভদ্রতা এই বোধটুকু জন্মাতে হবে আমাদের মনোজগতে। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, শব্দ চয়ন, বাক্য প্রয়োগ, হাত নাড়ানো, বাচনভঙ্গি প্রতিপক্ষ মার্ক করে আপনাকে ও আপনার মিশন ও ভিশনকে কলুষিত করতে তারা ওঁত পেতে থাকে সবসময় এটা মাথায় রাখুন। এসব বিবেচনায় নিয়ে যুগ সচেতন লোক ছাড়া আপনাদের সভা, সমাবেশে বক্তব্য না দেওয়া ই হবে কল্যাণকর।
হেফাজতের সমর্থন তো অনেক আছে। কিন্তু সেটাকে কৌশলী উপায়ে কাজে লাগানোর সক্ষমতা কেউ দেখাতে পারছে না। এটাই আফসোসের বিষয়।
৩মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যেখানে দাবী তুলার কথা ছিলো ৫ই মে ২০১৩ সালের গনহত‍্যার বিচার কার্যকর ও সেটার জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা, সেখানে নারী কমিশনের টপিককে হাইলাইট করে প্রোগ্রামটাকে পুরাই হ-য-ব-র-ল করে ফেলা হল। তাও ঠিক ছিল কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয় তাদের সমাবেশ থেকে যখন বিদ্বেষ উগড়ে দেওয়া হয় তখন। এতো এতো সম্মানিত লোকেরা যখন খুব সহজেই গনহারে  কাওকে বা কোন গ্রুপকে “বেশ‍্যা” “পাগল” “হিজড়া” এসব ধরনের অপবাদ দিয়ে দেয়, তখন তো সাধারণ মানুষ মূখ ফিরিয়ে নিবে এটাই স্বাভাবিক।
আপনারা আলেম মানুষ, দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও সম্মানিত সম্প্রদায়। আপনাদের কাছ থেকে মানুষ ভদ্রতা শিখবে; এখন আপনারাই যদি তথ্য ভিত্তিক কথা না বলে ক্ষমতা আর জনশক্তির ভয় দেখিয়ে অযাচিত, অশোভন শব্দ চয়ন করে কাওকে কটাক্ষ করেন আপনাদের মঞ্চ থেকে, তখন তো বিপত্তি সৃষ্টি হবে অনায়াসেই। হুমকি-ধমকি দিয়ে একটা পক্ষকে যদি আপনার বক্তব্য দিয়ে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেন তাহলে বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তি ও আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কী থাকল?
রাজনীতির মাঠে সমালোচনা করতে হবে, আন্দোলন করতে হবে মার্জিত ভাষায়, মানুষের পালস বুঝতে হবে, নতুবা রাজনীতির মারপ্যাঁচে এই স্রোতে টিকা যাবে না। প্রগতিশীলদের ভণ্ডামি তুলে ধরা ভালো। কিন্তু সেটা করতে হবে নিজেদের বক্তব্যের সম্মোহনী শক্তি দিয়ে। এলোপাতাড়ি “পতিতা” “বেশ্যা” শব্দ প্রয়োগ করে নয়। আর এটাও মনে রাখা দরকার যে, নারী কমিশনের কেউও পতিতা নয়, তারা নারীবাদের আদর্শিক কারণে এই বিষয়টার স্বীকৃতি চেয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ডীল করতে হবে আদর্শিক জায়গা থেকে, অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করে নয়।
দেখুন মুফতি রুহুল আমীন এর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাহফিলে ব্যক্তিগত স্বার্থে কওমি জননী উপাধী দিয়ে সারা জীবনের জন্য কলঙ্কিত করেছে হেফাজত, কওমি ও ইসলামী অঙ্গনকে। ঠিক তেমনিভাবে ৩মে এর সমাবেশের অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য হেফাজতকে অ্যাটাকিং পজিশন থেকে ডিফেন্সিভ পজিশনে চলে যেতে হচ্ছে। পাশাপাশি  রাজনৈতিকভাবেও এটা কোন ফায়দা দেয়নি।
হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি হতে হবে প্ল্যানিং করে। হেফাজতের অবস্থান বা বক্তব্য দেখলে মনে যেন না হয়, ইসলাম নারীর অধিকার দিতে চায় না। শুধু নারীর জন্য গঠিত কমিশন বাতিল করতে হবে এটা জোরে না বলে বরং কোনটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং কেন করতে হবে এর একাডেমিক আলোচনা উপস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি জনমতকে প্রভাবিত করে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে নারীর প্রকৃত অধিকার কোথসয় এবং নারীর প্রতি যে বৈষম্য করা হয় সেটারও শক্ত প্রতিবাদ জানাতে হবে। এর সাথে সাথে কেন? কি কারণে? কোন যুক্তিতে নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও পয়েন্টগুলো বাতিলযোগ্য তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে যৌক্তিক মাধ্যমে।
ইসলাম কত সুন্দর এবং ব্যালান্স করে নারীদের সম্মান করেছে সে বার্তাগুলো পয়েন্ট আকারে সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে জানানো প্রয়োজন। মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করে টকশোতে অংশগ্রহণ করে একাডেমিক আলোচনা উপস্থাপন করতে হবে পরিকল্পিত ভাবে। সাধারণ মানুষ যারা শরিআ’হ বুঝেন না, তারা যেন কোনভাবে ভুল বার্তা না পান সেই উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়ার হলুদ সাংবাদিকতা ও আলেমদের অযৌক্তিক আচরণে তারা যেন মনে না করেন যে, হুজুররা তাদের অধিকার দিতে চায় না।
তেরো সালে হেফাজতের অন্যতম প্রধান দাবী ছিল, মুসলিম পারিবারিক আইনে ইসলাম বিরোধী কোন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। বারো বছর পরে, একই দাবীতে আবার মাঠে নামতে হল কেন? ২০০৮ সালে তৎকালীন মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলেও একই দাবীতে মাঠে নামতে হয়েছিল। প্রতিটা সরকার এক-দেড় বছরের মধ্যে  পারিবারিক আইনে হাত দিতে চায় কেন? সরকার বদলায় কিন্তু নারীবাদীদের এই পরিবার বিধ্বংসী এজেন্ডা বন্ধ হয় না কেন? এসব নিয়ে আলাপ তুলতে হবে। এর স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।
হেফাজতের যেই জনশক্তি আছে, হেফাজত যদি  একটু সময়ের সাথে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে সক্ষমতা দেখাতে পারে তাহলে তারা থাকবে বাংলাদেশের  সুপ্রিম পাওয়ার লেভেলে।
তারা যদি পান, জর্দা, হাদিয়া, এসবে না জড়িয়ে গলা ব্যবসায়ীদের প্রমোট না করে ইসলামকে সীমাবদ্ধ না করে প্রকৃত বোদ্ধাদের সামনে নিয়ে আসে এবং জীবন, জগৎ, আন্তর্জাতিক বিশ্ব সম্পর্কে অবগত তরুণ, দরদী আলেমদের প্রতিনিধিত্ব হেফাজতে নিশ্চিত করেন, পাশাপাশি তাদের চিন্তাশীল তরুণ আলেমদের একটা গ্রুপ তৈরি করেন, যারা হেফাজতের কাজের যৌক্তিক আলোচনা ও সমালোচনা উভয়টা করবে এবং হেফাজতেরও এসব চিন্তাশীল আলেমদের সমালোচনা সহ্য করার শক্তি থাকে তাহলে ইনশাআল্লাহ হেফাজতও হবে একটা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্যে।
হেফাজত যদি তাদের আন্দোলনকে মাদরাসার রিজার্ভ ছাত্রদের অংশগ্রহণ করিয়ে মনে করে যে, তাদের আন্দোলন সফল তাহলে সেটাও হবে ভুল। যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার দাবী একপেশে থেকে যাবে। তাই জনগণ কেন অংশগ্রহণ করতেছে না এর কারণ চিন্তা করে বের করে এর সমাধানে যেতে হবে। হেফাজতের পক্ষে একজন সুশীল ও সাংবাদিক সমাজের বা বুদ্ধিজীবী মহলের কেউ টকশোতে কথা বলতেছে? অথচ তেরো সালে তো পিয়াস করি ও ডক্টর তুহিন মালিক হেফাজতকে ডিফেন্স করলেন। এখন হচ্ছে না কেন?
এমনকি এবারে জুলাই আন্দোলনটাও দেখতে পারেন। এখানে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের শহীদ হওয়ার খবর নিয়ে যতটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, ফেসবুকের পোস্টগুলো ভাইরাল হয়েছে, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে পোস্টগুলো তেমন আলোচনাতেও আসেনি। যাত্রাবাড়ীতে প্রথম যে ছেলেটা শহীদ হয় সে ছিল কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। কিন্তু অনেক খুঁজেও পরবর্তীতে কোনো খবর বা স্ট্যাটাসে তার খোঁজ আমরা পাইনি। অথচ প্রথম শহীদ ছেলেটা যদি শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের অংশ হতো, তাহলে খোঁজাখুঁজি ছাড়াই তার সকল তথ্য আমরা পেয়ে যেতাম।
এই যে হুজুর হবার কারণে বাংলাদেশের সমাজে একটা বাইনারি তৈরি করা হয়, এর কারণে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম জুলাই আন্দোলনের আইকনিক শহীদ হয়, তাদের জন্য সংসদ ভবনের সামনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফানুস ওড়ানো হয় কিন্তু সেখানে থাকে না ৭৮জন শহীদ হওয়া কোন হুজুরের গল্প বা ছবি। শুধুমাত্র হুজুর হবার কারণে সমাজের আরবান মিডলক্লাস লোকেরা বাহ! বাহ! দিয়েছিল তেরো সালের গণহত্যার সময়। শুধুমাত্র হুজুর হবার কারণে বিবিসিসহ সকল মিডিয়া তেরো সালের নিউজ করে “হেফাজতের ভাষায় গণহত্যা সংগঠিত হওয়া” এটা বলে। এর অর্থ হচ্ছে এটা যে গণহত্যা এটা এসব মিডিয়া স্বীকার করে না। স্বীকার যদি করতো তাহলে সরাসরি গণহত্যা শব্দ ব্যবহার করতো। কিন্তু তারা তারা সেটা করে না। তাই এসব বাইনারি ও এককেন্দ্রিক করে রাখার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অপতৎপরতা থেকে নিজেদের বহুমাত্রিক ও বহুমুখী করতে হলে তরুণদেরকে হেফাজতের নেতৃত্বের জায়গায় স্থান করে দিতে হবে।
শেষ কথা হচ্ছে যে, হেফাজত এর পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে দেওয়া ঐ কয়জন অখ্যাত ব্যক্তির অশ্রাব্য কথার প্রতিবাদ করায় এবং এরকম শব্দ চয়ন সমর্থন না করার কথা উল্লেখ করে যে বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে এটার জন্য মন থেকে জাযাকুমুল্লাহ। আপনাদের প্রতি মানুষের সম্মান জন্মাবার জন্য এবং এসব অন্যায়, অশ্লীল, অশ্রাব্য ভাষার শব্দ আপনারা সমর্থন করেন না বা হেফাজতের এরকম দৃষ্টিভঙ্গি নয় বলে যে বিবৃতি প্রদান করেছেন এটার রাজনৈতিক শক্তি অনেক সুদূরপ্রসারী ইনশাআল্লাহ।
ইসলামের সৌন্দর্যকে, বিনয়কে, মানবতাকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে প্রজ্ঞা আর জ্ঞান দিয়ে। জবরদস্তি, ধমকি এবং গোয়ার্তুমি দিয়ে দাবী আদায় করা যায় না; আদতে এতে আরও শত্রুপক্ষ তৈরি হয়।
হেফাজত- হিকমাহ অর্জন করুক। এদিকে নারী কমিশনও ইসলাম বিদ্বেষ বর্জন করুক, নচেৎ দু’জনই ব্যর্থতার গ্লানি টানতে হবে। ধর্মবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ নিপাত যাক! ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয় নাই; তদ্রুপ ধর্মহীনতাও চাপিয়ে দিয়ে আমাদের সমাজকে কেউ নষ্ট করুক সেটাও নিশ্চয় দেশপ্রেমিক মানবহিতৈষী কেউ চায় না।