‘হেফাজতের ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন সাংবিধানিক অধিকার’
একুশে জার্নাল ডটকম
অক্টোবর ১৫ ২০২২, ১৫:২৭
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনকে সাংবিধানিক অধিকার বলে আদালতে দেওয়া একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পুরো প্রতিবেদন জুড়ে সাম্প্রদায়িক বার্তা ও রাষ্ট্রের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে। এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলার বাদী নারাজি দিয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী হেফাজতের আন্দোলনকে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উসকানি আখ্যা দিয়ে ২০২০ সালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় তৎকালীন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের তৎকালীন আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমকে।
এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল পিবিআই। পুলিশের এই তদন্ত সংস্থা মামলাটি তদন্ত শেষ করে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. তৈয়বুর রহমান মামলাটির আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাখিল করেন।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তিন জনকেই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ মেলেনি বলেও মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের পর কিছু মূল্যায়ন দিয়েছেন। তিনি চার্জশিটে উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদ ও মন্তব্য সাংবিধানিক অধিকার।’
তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিষদ বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘শতকরা ৯০ শতাংশ মুসলমানদের এই বাংলাদেশে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক শক্ত অবস্থান। তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ওয়াজ-নসিহত করে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচিত হয়েছেন। ভাস্কার্য স্থাপন প্রসঙ্গে তিন বিবাদীর (মামুনুল হক, সৈয়দ ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরী) দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই কোনও একটা ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ধর্মপ্রাণ এই মুসলিমপ্রধান দেশে তাদের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।’
তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেনি। তাদের বক্তব্যে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসমর্থনমূলক অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। আর এই অভিমতের বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মুসলিমপ্রধান দেশের জনমনে কুরআন-হাদিসের আলোকে তারা উপস্থাপন করেছেন। একটি স্বাধীন দেশে সরকারি কোনও কাজ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে তা যদি জনবিরোধী, ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, জাতি ও ধর্মবিরোধী হয়, তবে সেসব কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রত্যেক নাগরিক মত প্রকাশ করতে পারেন। এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কাজেই ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে ভাস্কর্য স্থাপন বিষয়ে তাদের এমন কার্য রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের আওতাধীন নয়। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নেতা ছিলেন। তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হলে, ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর আত্মা বা রুহকে এই ভাস্কর্যের জন্য মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুসলিম বিশ্বের কাছে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে তারাসহ দেশের বিশিষ্ট ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন আলেমরা ধর্মের প্রশ্নে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাজেই তাদের এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে বিবেচ্য নয়।’
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘মামুনুল হক, ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরী ব্যক্তি ও দলীয় কোনও কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে সরকারকে অমান্য করা কিংবা নিজেদের গড়া কোনও মতকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দেশের জনগণকে সরকার এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলে, রাষ্ট্রের মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্যে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের আওতায় আসে। কিন্তু মামলার ঘটনায় তাদের তিন জনের দেওয়া বক্তব্য, কর্মকাণ্ডে এমন কোনও বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে আনা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতির করা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি, এজন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।’
তবে পিবিআইয়ের এই চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী আমিনুল ইসলাম বুলবুল।