হালুয়াঘাটের তিনজন আলেম মুক্তিযোদ্ধা
একুশে জার্নাল
ডিসেম্বর ১৮ ২০১৮, ১০:২২
ইলিয়াস সারোয়ার
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ৷ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচে’ বড় পরিচয় ৷ বাংলার আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এটা ছিল সর্বব্যাপী জনযুদ্ধ ৷ স্বাধীনতার পর প্রায় চার যুগ পার হলেও আমরা সর্বগৌরবের মুক্তিসংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারিনি ৷ অবশ্য আমাদের প্রয়াসও থেমে নেই ৷ অনেকেই ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিসংগ্রামের নায়কদের পরিচিত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন ৷
আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির যে সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল তাতে অংশগ্রহণ করেছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ৷ বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ে এদেশের আলেম সমাজও পিছিয়ে ছিলেন না ৷ তারা যেমন অস্ত্র হাতে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় জনমত গঠনেও বড় ভূমিকা পালন করেছেন ৷ অথচ তাদের এ অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটা অজানা ৷ তাই আজকের প্রবন্ধে স্থানীয় ক’জন আলেম মুক্তিযোদ্ধার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি ৷
এক. কারী মফিজ উদ্দীন
বীর মুক্তিযোদ্ধা কারী মফিজ উদ্দীন হালুয়াঘাট উপজেলাধীন নড়াইল ইউনিয়নের বটগাছিয়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা ৷ জন্ম ১৯৩২ সালে ৷ তাঁর পিতা জাফর আলী ও মাতা রূপজান ৷ তিন ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি।
ত্রিশালের নিগুড়কান্দার কারী জাকারিয়া রহ. এর কাছে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি ৷ এই প্রখ্যাত ওস্তাদের মাদরাসা থেকেই তিনি কেরাতে সাবয়া শেষ করে কারী তরিকুল্লাহ রহ. এর কাছ থেকে পাগড়ি ও সনদপত্র গ্রহণ করেন ৷ দরিদ্রতার কারণে এরপর আর উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ হয়নি তার।
এরপর ৭ বছর মকতবের শিক্ষকতা করেন ফুলপুর কুলিরকান্দা মসজিদে ৷ এরপর কৈচাপুর মাইজপাড়া মসজিদে ইমামতি ও শিক্ষকতা করেন ১৩ বছর ৷ এসময়ই সামনে উপস্থিত হয় মুক্তিযুদ্ধ ৷
ছোট ভাই আবদুর রউফের অনুপ্রেরণায় ভারতের ডালু ক্যাম্পে ২৬ দিন ট্রেনিং নেন ভারতের সিং বাবাজি, হালুয়াঘাটের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবিরুল ইসলাম বেগ ও ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের কাছে ৷ তার কমান্ডার ছিলেন আলী হোসেন ৷ ট্রেনিং শেষে দেশের জন্য জান বাজি রেখে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেন কাশিগঞ্জ, চিলাগাই ও দারাকপুরে ৷
মুক্তিযোদ্ধা স্মারকে কারী মফিজ উদ্দিনের পিতার নামের বানানে ভুল থাকায় স্বাধীনতার ৪৫ বছরে ১ টাকাও ভাতা পাননি। আবার হয়নি কোনও ছেলেমেয়ের চাকরিও। শেষ পর্যন্ত ভাঙা একটি টিনের চালাঘরে দরিদ্রতার সাথে জীবন সংগ্রাম করে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ইহলোক ত্যাগ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সনদপত্রের স্মারক নং মুবিম/সা/ময়মনসিংহ/১৪/৩৫৫২ ও পরিচয়পত্রের নম্বর ৬১১২৪৮১৫২৬২৩১ ৷
দুই. মুন্সী মোঃ ফজলুল হক
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মোঃ ফজলুল হক ১৯৪৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্দুল হক, মা সায়েরা খাতুন। তিন ছেলে ও এক মেয়ের পিতা তিনি।
বাড়ির পাশে মাজহারুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আব্দুর রাজ্জাকের কাছে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। সেখান থেকে তিনি কোরআন খতম করে তারাবীর নামাজে ইমামতি করেন। তিনি সহীহ পড়নেওয়ালা একজন কারী হলেও সেভাবে কারও কাছে পরিচয় দেন না।
কোরআন পড়ার পর স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে অভাবী সংসারের হাল ধরতে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হলেও শেষে তিনি ধানের ব্যবসা শুরু করেন।
পাকিস্তান আমলে তিনি একজন আনসার ও মুজাহিদ ছিলেন। যদ্দরুণ তাঁর কোনও ট্রেনিং নিতে হয়নি। তার সঙ্গে আনসার ও মুজাহিদ ট্রেনিংয়ের দু’টি সনদপত্র ছিলো। এগুলো দেখে সুবেদার জিয়াউল হক বললেন, তোমার কোনও ট্রেনিং নিতে হবে না। তুমি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে চলে যাও।
তিনি তখন বাড়ি এসে দুই ছেলে ও স্ত্রীসহ পরিবারের সবাইকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে রেখে সুবেদার জিয়াউল হকের নেতৃত্বে রাইফেল নিয়ে এমএফদের সঙ্গে ডুমনি ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানেই যুদ্ধ অবস্থায় তিনি ৯ মাস কাটিয়েছেন।
ক্যাম্পের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি যুদ্ধ করতেন। বান্দরকাটাসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধকালীন তাঁর আরও একটি কাজ ছিলো, তিনি গোপনে সন্ধান নিতেন কে কে পাকিস্তানী হানাদারদের সহায়তা করছে। রাতে এলাকায় ঢুকে এইসব লোকদের ধরতেন।
একবার বালুয়াকান্দা গ্রামের নুরুল হক ও আরেকবার আবুল কাসেমকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে সাবেক এমপি মরহুম কুদরত উল্লাহ মন্ডলের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মোঃ ফজলুল হকের তিন ছেলে ও এক মেয়ের কারও কোনো চাকরি হয়নি। তারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও দিনমজুর ও গার্মেন্টসকর্মী। তাঁর স্ত্রীও হাঁটতে পারেন না। বসবাসের তেমন কোনো ঘর নেই বললেই চলে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুন্সী মোঃ ফজলুল হকের স্মারক নং মুবিম/সা/ময়মনসিংহ /১৪/৩০৩৭, মুক্তিবার্ত নং০১১৫১০০২৬১, গেজেট নং ৩২৬০ ও জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৬১১২৪৪৭৪৭৮৬৮১।
তিন. মোঃ আঃ মান্নান পাঠান
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মোঃ আঃ মান্নান পাঠান ১৯৫৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার তেলিখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সাহেদ আলী পাঠান, মা মোছাঃ হারিছা। দুই ছেলে ও চার মেয়ের পিতা তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর সময়ে তিনি ছাত্র ছিলেন ৷ কিশোরগঞ্জের আউলিয়াপাড়া মাদরাসা থেকে দাখিল, মহিষলেটি আলিম মাদরাসা থেকে আলিম, ধামতি মাদরাসা থেকে ফাজিল ও ফুলপুরের কাজিয়াকান্দা মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করে মাওলানা ডিগ্রি লাভ করেন ৷ শিক্ষানুরাগী এ আলেম আলিয়ার পাশাপাশি জেনারেল এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন৷
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতের আমপাতিতে ২০দিন ট্রেনিং নেন তিনি ৷ তাঁর কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন হাসিম মিয়া ৷ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন গোয়েন্দা বিভাগে ৷ নালিতাবাড়ি থানায় পাক হানাদার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ফরেস্ট অফিস যুদ্ধ, বি.ও.পি তেলিখালী ও বি.ও.পি কড়ইতলী যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন ৷ মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন ৷ পড়াশুনা শেষে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত হন ৷ বাঘাইতলা হাইস্কুলে ৪ বছর শিক্ষকতার পর তিনি ভুবনকুড়া আলিয়া মাদরাসায় ৩৫ বছর শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহণ করেছেন ৷
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এত বছর কোন সুযোগ সুবিধা তিনি পাননি ৷ ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম তালিকাভূক্তির আবেদন করেছেন ৷ সেটি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ৷
তথ্যসূত্র:
১. দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ এর বিভিন্ন সংখ্যার ‘ধর্ম ও সমাজ’ পাতা ৷
২. মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজ, রচনা: মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, প্রকাশনায়: মাকতাবাতুল ইসলাম, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা ২০১৬
৩. সাক্ষাৎকার, মাওলানা মোঃ আঃ মান্নান পাঠান, ০৮৷১২৷২০১৮, ০৬:১১