স্বামী না সঙ্গী

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৮ ২০১৯, ০৯:০১

আবুল কাসেম আদিল:: ‘স্বামী’ শব্দটা নারীর জন্য অবমাননাকর। ‘স্বামী’ অর্থ প্রভু, পতি, অধিপতি, মালিক, মনিব। এই অঞ্চলে নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেরকম, ভাষাও তৈরি হয়েছে সেরকমভাবে। এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। বরং এই অঞ্চলে পুরুষেরা নারীদের বিধাতা হয়ে বসে আছে। পুরুষের বিধাতারূপটা অনেকসময় শৈল্পিক সূরতে হতেও দেখা যায়। যেমন কবিতায় — শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী / পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী…। খারাপ কথা সুন্দর আকৃতিতে প্রকাশিত।

অন্যদিকে আরবীতে পুরুষকে নারীর প্রভুত্ব দেওয়া হয় নি। আরবীতে স্বামীকে বলা হয় ‘যাওজ’। কুরআন এবং হাদীসেও একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ জোড়া, যুগল, সঙ্গী। নারী-পুরুষ দুইয়ের জন্যই মর্যাদাপূর্ণ অভিধা।

ভাবছি, বাংলায় ‘স্বামী’ শব্দের স্থানে কোন শব্দটা প্রতিস্থাপন করা যায়। জানি, জোর করে ভাষায় শব্দসংযোগ করা যায় না, উচিতও নয়। তাছাড়া শব্দ সবসময় শাব্দিক অর্থের বাহক নয়। তবু মনে হচ্ছে, এর স্থলে অন্য একটা শব্দ হলে ভালো হতো। শব্দের মধ্য দিয়ে অমর্যাদাকর ইতিহাস বহন না করে পারলেই ভালো লাগত। তো, কী হতে পারে শব্দটি? প্রয়োজনে আরবী-ইংরেজি থেকে শব্দ ধার করা যেতে পারে। যে কোনো বিদেশি শব্দ আপন করার যোগ্যতা ও ঐতিহ্য বাংলার আছে।
আরবে পুরুষের মধ্যে একাধিক বিবাহ ব্যাপকতর। তবু সেখানে আমাদের এখানকার মতো পারিবারিক কলহ নেই। এর কারণ ধারণা করি, সেখানে পুরুষেররা বিয়ে যতগুলোই করুক আলাদা করে প্রত্যেক স্ত্রী পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ভোগ করে। মর্যাদাহীনতার কারণে হীনম্মন্যতাজাত আক্রোশ সেখানকার নারীদের মধ্যে নেই। ফলে পারিবারিক কলহ নেই। আমাদের এখানে একদিকে নারীদের মধ্যে মর্যাদাহীনতার কারণে হীনম্মন্যতাজাত আক্রোশ বিদ্যমান, অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে স্বামিত্ব বা প্রভুত্বের উপস্থিতি।

এই সমস্যা দূর করার জন্য পুরুষদের করণীয়ই বেশি। পুরুষদেরকে স্বামিত্ব বা প্রভুত্ব ছাড়তে হবে। পুরুষদেরকে হতে হবে নারীদের সঙ্গী, বন্ধু, সহচর। আর এটিই কুরআনের নির্দেশ। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী পারষ্পরিক বন্ধু।…’ [তাওবাহ ৭১] এই কুরআনী নির্দেশ মান্য করলে নারীদের মধ্য থেকে হীনম্মন্যতাজাত আক্রোশ এমনিতেই লুপ্ত হবে। ফলে আমাদের সমাজ হবে ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ।
পশ্চিমা স্টাইলে নারীর নামের সঙ্গে স্বামীর নাম বা পদবি ধারণ, আত্মমর্যদাহীনতার প্রমাণ। রোকেয়া কেন বিয়ের পরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন হয়ে যাবেন? দেখুন, আরব নারীদের মধ্যে এত আত্মমর্যাদার অভাব কোনোকালে ছিল না। স্বামীর নাম তারা নিজের নামে যোগ করে না। জন্মের পর থেকে নিজের নামের সঙ্গে জন্মদাতা পিতার নাম লেখে।

কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের কোন বিচ্যুতি হলে তাতে তোমাদের কোন গোনাহ নেই, তবে ইচ্ছাকৃত হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [আহযাব ৫]
সন্তান পিতা-মাতার পরিচয়ে বড় হবে এবং এই পরিচয় ধারণ করে জীবন চালনা করবে, এটিই যৌক্তিক। পিতা-মাতা হলেন শেকড়, তাদের পরিচয় ধারণ করা মানে শেকড়চ্যুত না হওয়া। ছেলেরা জন্ম থেকে আমৃত্যু পিতার পরিচয়ে বাঁচে, অন্যদিকে মেয়েদেরকে বিয়ের পর শেকড়ছিন্ন হতে হয় — তাদের জন্য এরচে দুঃখজনক আর কিছু নেই। তাছাড়া এটা তো সত্য যে, পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক প্রকৃতিদত্ত। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া বা করার মতো কায়দাকানুন নেই। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কয়েকটি শব্দজালে বন্দি। এটি প্রাকৃতিক নয়, স্বেচ্ছায় বরিত। স্বেচ্ছাগৃহীত সম্পর্কের স্বেচ্ছাবিসর্জন সম্ভব এবং যৌক্তিক।
আনন্দের কথা, শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীদের মতো গেঁয়ো নারীদের এতটা মর্যাদার পতন হয় নি। যদিও এই মর্যাদা চেতনে নয়, অচেতনে রক্ষিত। আবু বকর সিদ্দীকের স্ত্রী ছোটকাল থেকে মিনারা খাতুনই আছেন, মিনারা সিদ্দীক হয়ে যান নি। দুই পৃষ্ঠার কাবিননামা তার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে নি। শঙ্কার কথা, শহুরে নারীদের ভূত গ্রামের নারীদের মাথায় ইদানীং আসর করতে শুরু করেছে। এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক।

কোনাবাড়ি, গাজীপুর।
[email protected]