সৌদি রাজচক্র: গিনিপিগ হারামাইন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১৫ ২০২০, ১৪:২৮

অন্য অনেক দেশের তুলনায় সৌদি আরবে করোনাক্রান্তের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। ইরান ফেরত গুটিকয়েক সৌদি নাগরিকের দেহে করোনার আঁচ পাওয়া গেলেও—চীন, কোরিয়া, ইরান, ইতালির মতো মহামারীর আকার আদৌ নেয়নি। তবু কেন করোনা নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের এতো মাতামাতি, এই অতিসতর্ক ভাব! জনজীবনে খামোখাই বিধি-নিষেধের এতো এতো বেড়াজাল, জনমনে প্যানিক চাপিয়ে দেবার এই অপচেষ্টাই বা কেন—সেটা আমার আদতেই বুঝে আসছিলো না। বিশেষত হারামাইন শরিফাইন নিয়ে ওদের খেয়ালিপনা আমাকে ভীষণভাবে অষ্টপ্রহর তাড়িত করছিল।

যে মক্কাতুল মুকাররামায় কোনোদিন রাত নামে না—চিরসজাগ সেই মক্কাই আজ কেমন যেন খা খা নির্জন। মাসজিদুল হারাম প্রায় জনশূন্য, বিরাণ। বহির্বিশ্বের উমরাহ তো আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এখন সাফা-মারওয়া বন্ধ করে এই নিষেধাজ্ঞাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সার্বজনীন করা হয়েছে। মূল হারাম শরিফ তো বটেই, ফাঁকা হারাম আঙিনায় প্রবেশও এখন কতো কঠোর নিয়ন্ত্রিত! তাওয়াফের মাঠে দ্বিস্তরের সে সেকি কঠিন বেষ্টনি! রোগমুক্তির অমৃত পানীয় জমজমের প্রবাহও যে সর্বত্রই বন্ধ। সব ছাপিয়ে চরম হঠকারি ও হৃদয়বিদারক যে বিষয় আমাকে অস্থির করে তোলে—সেটা হলো, প্রতিদিন ইশার পরপরই সমগ্র হারাম শরিফকে অনেকটা জোরপূর্বক খালি করে দেয়া হয়। গেটবদ্ধ করে রাখা হয় পুরো রাত। খানায়ে কা’বাকে তাওয়াফশূন্য নিঃসঙ্গ রাখার সেকি কসরত! দেখলেই ক্রোধে কলজে ফেটে যায়।

অন্যদিকে মাসজিদে নববিরও একই দশা করে ছেড়েছে আলে সৌদের অযোগ্য গোয়াররা। সেখানেও চলছে ওদের চাপিয়ে দেয়া অপশাসন। মাসজিদের মূল অংশ এবং বাবুস্ সালামসহ রাওযা আতহার টোটালি ক্লোজ্ড। দশ সহস্রাধিক সাহাবির সমাধিস্থল বাকি আল গারকাদও পুরোপুরি বন্ধ। অথচ ওদের চিত্ত বিনোদনের স্পটগুলো যথারীতি ওপেন। আয়েশি জীবন-যাপনের বিলাসী মলগুলোর চাকচিক্য এতটুকোও মলিন হয়নি। সব নিষেধাজ্ঞা সব কাঠিন্য কেবল বিশ্বমুসলিমের হৃদপিণ্ড হারামাইন শরিফাইন নিয়েই। ভাবখানা এমন, যেন কেবল হারামাইন বন্ধ করে দিলেই করোনামুক্তির গ্যারান্টি রয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। এই খোদায়ি গজবে মানুষকে আল্লাহর ঘরের দিকে রুজু করা, বেশি বেশি তাওয়াফ-উমরাহ, কুনুতে নাজেলার প্রতি উৎসাহী করাটা হওয়ার কথা ছিল টপ প্রায়োরিটিযোগ্য।

এই তোড়জোরের শুরু থেকে শুধুই ভাবছি। ভাবছি, ওরা হঠাৎই কেন এমন করছে? কেন এমন মারমুখো? কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে নড়াচড়া করার মধ্যে? প্রথমে ভেবেছিলাম, যেহেতু ওরা গোলামের জাত—হয়তো মুনিবের ইশারাতেই ওরা নাচছে। ইহুদিবাদীরা আল আকসা নিয়ে প্রকাশ্যে যা করছে, একদল মুনাফিক দিয়ে হয়তো তাই করাচ্ছে পবিত্র বিলাদুল হারামাইনে। আর নেপথ্যে থেকে ওরা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। অবশ্য এই চিন্তাটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এবার নতুন আরেকটা ভাবনা মস্তিষ্কের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে! আর সেটা হচ্ছে—রাজচক্রের ঘুর্ণাবর্ত। হয়তো রাজ পরিবারের চলমান ক্ষমতার কামড়াকামড়ি থেকে জনগণের মনোযোগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই অবশেষে কা’বাতুল মুশাররাফাকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। চিরসজাগ বাইতুল্লাহকে উজাড় করেই ফোকাস ফেলা হচ্ছে করোনার প্রতি। তো কী চলছে রাজদরবারে? আসুন, একটু আলোকপাত করি।

৬ মার্চ, শুক্রবার। সকালবেলা সৌদির বাতাসে খবর চাউর হলো অভ্যুত্থানের অভিযোগে রাজ পরিবারের প্রভাবশালি তিন সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের একমাত্র জীবিত সহোদর এবং পরবর্তী বাদশাহ হবার দৌড়ে সবচে’ এগিয়ে থাকা ব্যক্তি—প্রিন্স আহমদ বিন আবদুল আজিজ। যিনি আমেরিকায় গ্র্যাজুয়েডেট হলেও শেষ সময়ে লন্ডনে বসবাস করছিলেন। তিনি আবার বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স (পরবর্তী বাদশাহ) ‘এমবিএস’খ্যাত মুহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক। এমনকি ‘এমবিএস’ সৃষ্ট ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতার সংকট, ইরানফোবিয়া, খাশোগি হত্যাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঘোরবিরোধীও। ইঙ্গ-মার্কিন মধ্যস্থতায় সদ্যই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। অন্যজন হলেন মুহাম্মদ বিন নায়েফ। যিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ২০১৫ সালে কিং সালমান ক্ষমতারোহনের সময় যাকে ক্রাউন প্রিন্স মনোনীত করেছিলেন। ২০১৭ সালে তাকে হটিয়েই ‘এমবিএস’ ক্রাউন প্রিন্সের আসনে বসেছিলেন। প্রায় টানা তিন বছর ধরে তিনি ছিলেন কার্যত গৃহবন্দী। তৃতীয় জন হলেন তারই ভ্রাতা নাওয়াফ বিন নায়েফ। অবশ্য শুধু এই তিনজনই নয়—এই ক’দিনে আরো প্রায় বিশজন প্রিন্সকে কারাবন্দী করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন ওঠছে, আচমকা কেন এই ধরপাকড়? ঠিক এই সময়েই কেন এই শুদ্ধি অভিযান? হ্যাঁ, রাজপরিবারের রীতি অনুসারে বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স হবার সবচে’ বড় দাবিদার হলেন বাদশাহ’র ভ্রাতা প্রিন্স আহমদ বিন আবদুল আজিজ। আর এরকমটাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে—এক ভাই কিং হলে পরবর্তী ভাই ক্রাউন প্রিন্স। তাই গায়ের জোরে এমবিএস’র ক্রাউন প্রিন্স বনে যাওয়াটা ছিল নীতিবিরুদ্ধ ও অনৈতিক। স্বাভাবিকভাবেই রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্য এ ব্যাপারটায় ছিলেন চরম অখুশি, ক্রুদ্ধ। এমবিএস–ও তাই প্রথম থেকেই বিরুদ্ধমতের ওপর ছিলেন প্রচণ্ডরকম মারমুখি। ক্রমান্বয়ে বাদশাহ’র সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বেছে বেছে নিজের পথের সব কাঁটা সাফ করে চলছেন প্রতিনিয়ত। এ তালিকায় প্রভাবশালি প্রিন্স থেকে নিয়ে সাধারণ নাগরিক—সবাই আছেন। আছেন ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী, ধনকুবের, আমলা, সোশ্যাল ওয়ার্কার, এমনকি সাংবাদিকও।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম মিডল ইস্ট আই’র সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, আসছে নভেম্বরে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–২০ এর সম্মেলন বসছে সৌদি আরবের রাজধানী শহর রিয়াদে। এমবিএস’র খায়েশ, স্বাগতিক হিসেবে এতে তিনি সৌদির বাদশাহ হয়েই অংশগ্রহণ করবেন। যেহেতু তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল, তাই এমবিএস চাচ্ছেন পিতার জীবদ্দশায় যে করেই হোক নিজের বাদশাহ হওয়াটা নিশ্চিত করতে ফেলতে। তিনি জানেন, বাদশাহ’র অবর্তমানে তার বাদশাহির দাবি নিতান্তই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। কারণ, বাদশাহ নির্ধারণের যে ‘অ্যালিজিয়েন্স কাউন্সিল’ রয়েছে, তার অধিকাংশ সদস্যই এমবিএস বিরোধী। সদ্য গ্রেপ্তার প্রিন্স আহমদও এই কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গ্রেপ্তারের আগে প্রিন্স আহমদকে শেষবারের মতো এ ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি সরাসরিই এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

অন্য একটি সূত্রমতে, আসছে নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজিত হবার আশঙ্কাতেই মূলত বিন সালমানের এই তরিঘরি। কেননা ডেমোক্রেটিক দলের সকল প্রার্থীই এমবিএস’র কড়া সমালোচক। মূলত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় ডেমোক্রেটরা তার ওপর বেজায় চটে আছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন বিশেষত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ হত্যাকাণ্ড থেকে তাকে অনেকটাই দায়মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন। এমনকি হত্যাকাণ্ডে বিন সালমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে সিআইএ এবং অন্যান্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন রিপোর্ট জমা দিলেও এফবিআই বা জাতিসংঘকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন। তাই এমবিএস চাচ্ছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকতেই তার বাদশাহির প্রতি মার্কিন প্রশাসনের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে। আগামী দিনগুলোয় সৌদি রাজপরিবারে ঠিক কী ঘটতে চলছে, সেটা জানতে অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। তবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করোনার প্যানিক ছড়াতে হারামাইন নিয়ে এই খেল নিঃসন্দেহে এমবিএস তথা পুরো রাজপরিবারের জন্যই আখেরে কাল হয়ে দাঁড়াবে।

সে যাই হোক, আমার কথা হলো নিজেদের পারিবারিক দ্বন্ধ আড়াল করতেই হোক, অথবা সত্যি সত্যি করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতেই যদি করোনাকে হাইলাইট করতে হয়, তবে হারামাইনকে কেন ব্যবহার করা হবে? যে দেশে কা’বা নেই, সেদেশে কি সরকারি উদ্যোগে গণসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না? যে কা’বার তাওয়াফ কোনোকালে কোনোদিনই মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি—সে ঔদ্ধত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত রাজকীয় ফরমান বলে উম্মাহ’র ঘাড়ে এরা চাপিয়ে দিল কোন দুঃসাহসে! পবিত্র হারামাইন নিয়ে আলে সৌদের এই খেল তামাশা আর কতো কাল চলবে!