সেটুকু আমার নিঃসঙ্গতা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০৪ ২০১৯, ২৩:১৭

শাহীন বিন শফিক

বন্ধু আর বন্ধুত্ব দখল করে রাখে হৃদয়ের সবটুকুন ভূমি। জিবন গল্পের প্রতি পর্বে সুখের নিশানা উড়াতে বন্ধুর বিকপ্ল নেই। আমাদের সবার বন্ধু থাকে। আমারও একজন বন্ধু আছে। শুধু একজন না, বহুজন শত শত। জিবন নদীর প্রতি বাঁকেই দু-একজন বন্ধু জোটে। আমারও আছে বহুবন্ধু। তবুও একজন আলাদা। সে আর আমি, আমি আর সে; দু-জন মিলে আমরা স্বতন্ত্র এক জগতের অধিবাসী। সে জগতের প্রত্যেক মোড়ে টানানো আছে আমাদের বন্ধুত্বের বিলবোর্ড। দেয়ালে দেয়ালে লিখা আমাদের খুনসুটি আর ভালবাসার গল্প।

তার নাম ছিল রোমান। প্রাইমারির গন্ডিতেই তার সাথে পরিচয়। জে.ডি.সি’র পর কাকতালীয় ভাবে কাছে আসা। সেখান থেকেই সখ্যতা। অতঃপর দু-জন একসাথে কাটিয়েছি জীবনের অপূর্ব কিছু সোনালী সময়। একই মেস, একই সিটে কেটেছিল স্মৃতিময় অমূল্য দিন গুলো। জীবন নদীর জোয়ার-ভাটায় মেঘ তাকে স্পর্শ করত না কভু। সে ছিল সূর্যের মত দীপ্যমান। চির হাস্যরতি। সতেন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়-লাস্যগতি, হাস্যরতি সিন্দু তুমি বন্দনীয়। একদিন সে দীপ্যমান সূর্যের মুখে জমাট বাঁধে নিকষ কালো অন্ধকার। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে অন্ধকারে ঢেকে যায় বন্ধুত্বের শহর। যে শহর থেকে বের হবার পথ আজো আমি হাতড়ে বেড়াই।

আমার লাইফে কোন বন্ধু আমার জন্য দু-ফোঁটা অশ্রু বিসর্জিত করছে কিনা জানা নেই। তবে রোমান করেছিল। সামান্য রাগ-অভিমানেও তার আখিঁদ্বয় অশ্রুসিক্ত হত। কুয়াশাচ্ছান্ন এক নীশির পুরোটা সময় ঠুনকো বিষয়ে মেসের পাশ্ববর্তি শিমুলতলায় অশ্রু ঝরিয়েছিল। নিভৃত নির্জন এই শিমুল তলা ছিল আমাদের প্রিয়। এখানে জড়িয়ে আছে সন্ধ্যা ও রাতদুপুরের অসংখ্য গল্পের দৃশ্য। শিমুল গাছের ফাঁকে কোন কোন দিন উঠে আসত নিটোল পূর্ণিমা চাঁদ।ঝোপ-ঝাড়ে জ্বলত অগনিত জোনাকি। শেষ শরতের হিম বাতাস কভু ছুঁয়ে যেত। রোমান আর আমার রাত কাটতো গল্প করেই। অইদিকে কার্তিকের অজস্র শিশির কনা ভিড় জমাতো আমাদের সাথে।

আমাদের সেই অতিতে আছে কত গান, প্রেম, নদী আর প্রিয় কথা। গল্প অসমাপ্ত রেখেই আমরা চলে আসছি আজ আরেক জীবন, আরেক পৃথিবীতে। যেখান থেকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়না আমাদের গল্প।

তবে সেসব স্মৃতি এখনো স্পষ্ট ভাসমান। হৃদয় উজার করে ভালবাসতো আমায়। আবার ভয়ও পেত। নিস্তব্ধ মরুতে শুধু রোমান পাশে থাকলেই হবে। হাসি আনন্দে ভরে যাবে চারদিক। এই বিশাল পৃথিবীতে তার শুণ্যতা আমার কাছে বিশাল অপূর্ণতা।

আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল রেলষ্টেশনে। সে বহুদিন আগের কথা। যাবার বেলায় রোমান একা দাড়িয়ে ছিল প্লাটফর্মে। যে ট্রেন আমাদের আলাদা করে দেয়, সেটি আর ফিরে আসেনি জোড়াতে। মাস শেষে আমি ফিরে তার আর খোঁজ পাইনি। সে হারিয়েছে। ভিন্ন গ্রহে। তার আর আমার মধ্যে দাঁড়িয়েছে হিমালয় সম পর্বতমালা। যা পাড়ি দেয়া কোন আরোহীর পক্ষে সম্ভব না।

রোমান এখন কোথায় আছে জানিনা। কোন ঠিকানা দিয়ে যায়নি। বেঁচে আছে না পরপারে, তাও জানিনা। শুধু অদৃশ্য শক্তি কিছু চিত্র দাঁড় করিয়েছে মনের কম্পাসে। রোমান আর নেই। সে থাকতে পারেনা। থাকলেও এ রোমান সে নয়, যে আমার বন্ধুছিল। আমিবিহিন কিছুদিন যার পক্ষে থাকা অসম্ভব, সে কি করে এক জীবন কাটাবে আমিহীনা। না! রোমান আর নেই।

 

স্বার্থান্ধ জগতে আমি এখন অনেক জনের বন্ধু হলেও, কেউ আমার বন্ধু না। আমি কাউকে বন্ধু মনে করিনা।

নিভৃত আলোয় চোখ মেলে যেটুকু পথ পাড়ি দেয়া যায় তার সবটুকুই তো আমরা পাড় করে এসেছি। নতুন করে চলার মতো আর কোনো পথ নেই বাকি। হাতে হাত রেখে যেটুকু পথ চলতে পেরেছি তার নাম দিয়েছিলাম ‘অসমাপ্ত গল্প।’ অবশিষ্ট যেটুক পথ রয়েছে সেটুক আমার নিঃসঙ্গতা। সেই পথে তোমার কোনো পীছুটান নেই। আমার আছে অমাবস্যার রাত। সেখানেই আমার ঘর-বাড়ি।