সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতির ধারকরা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন- মাহবুব আহমদ রুমন
একুশে জার্নাল
জুন ১৬ ২০২০, ০৬:৪৮
পূণ্যভূমি সিলেট দেশের সম্প্রীতির রাজনীতির এক অনন্য উদাহরণ।সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতির অতীত ঐতিহ্য বহু পুরনো।কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বলা চলে সিলেটের রাজনীতির পরিবেশ সবসময়ই শান্তিপূর্ণ। সময়ের ব্যবধানে একে একে বিদায় নিচ্ছেন সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতির ধারকরা।তাদের বিদায়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বশূণ্য হয়ে যাচ্ছে সিলেট।
আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি আর বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে খুব কম লোকই আছেন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখেন। মাঝেমধ্যে রাজনীতির এই শক্ত রেওয়াজকে ধাক্কা দিয়েছেন কেউ কেউ।এদের মধ্যে অন্যতম হলেন জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। ৯৬-২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো তখন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সিলেটের উন্নয়নে কিছু করার চেষ্টা করলে বাঁধা আসে তার নিজ দল আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে।তার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা সিলেটের আধুনিক রেলস্টেশনের ভিত্তিপ্রস্তর খানাটি গুড়িয়ে দেয় সিলেটের উন্নয়ন বিমুখ আওয়ামী পরিবার।এরপরও তিনি চেষ্টা করেছেন,কিন্তু পারেননি।তার জীবদ্দশায় হাতেগোনা দু’একটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অন্যতম ছিলো নগরীর পুরানলেনস্থ ডায়াবেটিক হাসপাতাল।যার সূচনা হয়েছিলো ৯১-৯৬ সালে অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের হাতে।কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুজনকে দাওয়াত দিলে তারা উপস্থিত হন।উন্নয়নের বরপুত্র এম সাইফুর রহমানকে পাশে পেয়ে সেদিনকার প্রধান অতিথি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বলেন,আমরা অনেকেই কাজ করার কথা বলি কিন্তু সাইফুর রহমান করে দেখান।প্রকৃত সিলেটি যদি কেউ হন তিনি সাইফুর রহমান ছাড়া আর কেউ নন।
সিলেটের মুরব্বি সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর সাইফুর রহমান মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন প্রিয় নগরী সিলেটকে।নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনে বিরোধীদলের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে অনুদান দিতে কখনোই কার্পণ্য করেন নি।কামরানও সবসময় অভিভাবক হিসেবে শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন সাইফুর রহমানকে। সাইফুর রহমান বিরোধীদলের নেতা হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর নাম ফলককে শ্রদ্ধা দেখিয়ে সকলের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা কুড়িয়েছেন।আরেক বিপরীত রাজনৈতিক দর্শনের নেতা আবদুস সামাদ আজাদকে ভাইছাব সম্বোধন করে,সম্মান প্রদর্শন করে সিলেটবাসীকে করেছেন মহিমান্বিত। সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর তার লাশ সিলেটে নিয়ে আসতে হেলিকপ্টার ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি সম্প্রীতির রাজনীতিতে উজ্বলতার স্বাক্ষর রাখেন।
স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবর্তে ৯৬ সালে আরেক দফা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া আবদুস সামাদ আজাদ দৃশ্যমান উন্নয়ন না করলেও সিলেটবাসীকে সম্প্রীতির মন্ত্রে করেছেন উজ্জীবিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করলে তৎকালীন তরুণ বিএনপি নেতা,ছাত্রদলের সাবেক সাহসী সাধারণ সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী তার মাইক কেড়ে নেন।উপস্থিত প্রশাসন,দলীয় নেতাকর্মী ইলিয়াস আলীর বিরোদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললে সামাদ আজাদ প্রতিউত্তরে বলেছিলেন গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। এমন একজন সাহসী নেতা আমার সিলেটে আছে।যার নেত্রীর বিরোদ্ধে কথা বলায় আমার মাইক কেড়ে নিয়েছে। ইলিয়াসকে তোমরা কেউ কিছু বলবে না।আমার পরে সিলেটের নেতৃত্ব সে দিবে।
বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক,সাবেক এম.পি এম ইলিয়াস আলী দেশের রাজনীতিতে এক আলোচিত নাম।দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো তার।তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালে বালাগঞ্জে দলীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা হামলা করে। হামলারর প্রতিবাদে মামলা হলে সিলেটের আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ছুটে যান তার বাসাতে।গিয়ে অনুরোধ করেন মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে।তাদের অনুরোধে তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বললে তারা সে মামলা প্রত্যাহার করে নেন। ৯৬ সালে বালাগঞ্জের সংখ্যালঘু তরুণী তৃষা রানীকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধর্ষণ করে কুকুর দিয়ে কাঁমড়িয়েছিলো। সেদিন ধর্ষিতা তৃষা রানীকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো.নাসিমের কাছে নিয়ে গিয়ে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেছিলেন ইলিয়াস আলী। সেই ইলিয়াস আলী নিষ্ঠুর রাজনীতির করুণ পরিণতির শিকার হয়ে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে আজ অবধি নিখোঁজ।
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারি চাপা দিতেই ইলিয়াস আলী গুমের রহস্যের সৃষ্টি বলে এমন কথা চাউড় রয়েছে বাজারে। বহুল সমালোচিত নেতা,সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রয়াণের মধ্যদিয়ে জাতীয় নেতৃত্বে সিলেটের সর্বশেষ প্রতিনিধির অবসান হয়।সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ সিলেটে আসলে তার উপর গ্রেনেড হামলার মিথ্যা মামলার আসামি,সিলেটের মেয়র গুরুতর অসুস্থ আরিফুল হক চৌধুরী লাঠিতে ভর দিয়ে ছুটে যান তাকে শেষবারের মতো দেখতে।
সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র সিলেট পৌরসভার শেষ চেয়ারম্যান ও সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আজ দিবাগত রাতে মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। জনতার কামরানের বিদায়ের মধ্যদিয়ে সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতিতে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হলো তা পূরণ হওয়ার নয়।সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের লাশ সিলেটে আসলে লাশ গ্রহণ করা থেকে নিয়ে শাহী ঈদগাহর জানাজা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তৎকালীন সিটি মেয়র কামরান।একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফরে আসলে হযরত শাহজালাল রাহ.’র মাজার জিয়ারত শেষে বের হয়ে কামরানকে বলেন,সর্বত্র সাইফুর রহমানের নাম ফলক কেন?তোমরা কি করো?জবাবে কামরান বলেন,আপা সাইফুর স্যার সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে গেছেন।তাই সর্বত্র উনার স্পর্শ বিদ্ধমান।
আল্লাহপাক সিলেটের মরহুম স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের জান্নাতুল ফিরদাউন দান করুন এবং নিখোঁজ জাতীয় নেতা ইলিয়াস আলীকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন।আমীন।