“সিলেটের ছক্কা ছয়ফুর” এক অনন্য সাধারন বাংলাদেশী। বাংলার ইতিহাসে হয়ত আর কখনো হবে কিনা সন্দেহ। !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
একুশে জার্নাল
জুন ১১ ২০১৮, ০৬:২৯
তাঁর নাম ছয়ফুর রহমান। পেশায় ছিলেন বাবুর্চি। খুব নামিদামি বাবুর্চি এমন নয়। সিলেটের সালুটিকর নামের একেবারেই গ্রাম্য বাজারের পাশের ছাপড়া ঘরের দিন আনি দিন খাই বাবুর্চি। তাঁর দ্বিতীয় পেশা ছিল ঠেলাগাড়ি চালনা। যখন বাবুর্চিগিরি করে আয় রোজগার হতো না, তখন ঠেলাগাড়ি চালাতেন। কিন্তু এই লোকটির ছিল অসম সাহস। যেকোনো ইস্যুতে তিনি একেবারেই জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করতেন। ধরুন সালুটিকর থেকে শহরে আসার বাসভাড়া আটআনা বেড়ে গেছে, ছয়ফুর রহমান কোর্ট পয়েন্টে একটা মাইক বেঁধে নিয়ে ঐদিন বিকালে প্রতিবাদ সভা করবেনই করবেন। বক্তা হিসেবে অসম্ভব রসিক লোক ছিলেন। ছড়ার সুরে সুরে বক্তৃতা করবেন, তারপর মূল ইস্যু নিয়ে অনেক রসিকতা করবেন, কিন্তু দাবি তাঁর ঠিকই থাকবে।
তার বক্তৃতা শুনতে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের ভিড় হতো। তো, বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই তিনি একটুকরো কাপড় বের করে সামনে রাখতেন, তারপর সবাইকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন, ‘আমি এই যে আপনাদের জন্য আন্দোলন করতেছি, আমার মাইকের খরচ দিবে কে? মাইকের খরচ দেন।’ অদ্ভুত ব্যাপার হল কোনোদিনই মাইকের খরচ উঠতে দেরি হয়েছে এমনটা হয়নি। দুই টাকা, এক টাকা করে তার সামনের কাপড়টি ভরে উঠত। তারপর যখন ৩শ টাকা হয়ে গেল তখন মাইকের খরচ উঠে গেছে, তিনি তার কাপড়টি বন্ধ করে দিতেন। অনেক সময় তার লেখা বই বিক্রি করেও জনসভার খরচ তুলতেন। অদ্ভুত কয়েকটি চটি সাইজের বই ছিল তার। একটির নাম – ‘বাবুর্চি প্রেসিডেন্ট হতে চায়।’ সেই বইটির পেছনে তার দাত-মুখ খিচানো একটা সাদাকালো ছবি, নিচে লেখা ‘দুর্নীতিবাজদেরকে দেখলেই এরকম ভ্যাংচি দিতে হবে।’
ছয়ফুর রহমান প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে। তখন দেশে সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। তো, সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নিরাপত্তার জন্যই সঙ্গে পুলিশ দেয়া হলো। ছয়ফুর তাঁর নিরাপত্তার জন্য দেয়া পুলিশ প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘এদেরকে খাওয়ানোর সাধ্য আমার নাই।’ তবু সরকারি চাপাচাপিতে তাকে নূন্যতম দুইজন পুলিশ সঙ্গে নিতে হলো। সে সময় দেখা যেত রিক্সায় দুইপাশে দুই কনেস্টবল আর ছয়ফুর রহমান রিক্সার মাঝখানে উঁচু হয়ে বসে কোথাও যাচ্ছেন। নির্বাচনে খারাপ করেননি, সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৬০/৬৫ জন প্রার্থীর মাঝে ৮ নম্বর হয়েছিলেন। তারপর এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমি দেশের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট। ইলেকশনের দিন বাকি ৭ জন মরে গেলে আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারতাম।’
অদ্ভুত এবং মজাদার সব নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তাঁর। যেমন, দেশের কোনো রাস্তাঘাট পাকা করার দরকার নেই। রাস্তা তুলে দিয়ে সেখানে খাল করে ফেলতে হবে। নদীমাতৃক দেশে সেই খাল দিয়ে নৌকায় লোকজন চলাচল করবে, খালের পানিতে সেচ হবে-সব সমস্যার সহজ সমাধান। তাঁর দলের নাম ছিল ‘ইসলামি সমাজতান্ত্রিক দল’। সেই দলে কোনো সদস্য নেয়া হতো না। এমনকি উনার স্ত্রীকেও সদস্য করেননি। উনি বলতেন, ‘একের বেশি লোক হলেই দল দুইভাগ হয়ে যাবে।’
ছক্কা ছয়ফুর বেশ কয়েকবার নির্বাচন করেছেন, কখনোই তাঁকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি, সবাই মজার ক্যান্ডিডেট হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে সিলেট সদর উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে এক কাণ্ড ছিল বটে।
যথারীতি ছয়ফুর রহমান প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতীক-ডাব। তিনি একটা হ্যান্ডমাইক বগলে নিয়ে একা একা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার লিফলেট কিছুই নেই। কিন্তু বক্তৃতা তীর্যক, বাকি প্রার্থীদেরকে তুলাধুনা করে ফেলছেন। এরকম এক সন্ধ্যায় সিলেটের টিলাগড়ে তার উপর অন্য এক প্রার্থীর কয়েকজন পান্ডা হামলা করে বসল।
পরের দিন সেই খবর গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলো-আহা, একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ, তাঁর সঙ্গে গুন্ডামি করার কী দরকার ছিল?
ঐদিন বিকালে স্কুল ছুটির পর প্রথম মিছিল বের হলো সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে। মিছিল লালদীঘির রাস্তা হয়ে বন্দর বাজারে রাজাস্কুলের সামনে আসার পর রাজাস্কুলের ছেলেরাও যোগ দিল। ব্যস, বাকিটুকু ইতিহাস। মুহুর্তেই যেন সারা শহরে খবর হয়ে গেল। সন্ধ্যার মধ্যেই পাড়া মহল্লা থেকে মিছিল শুরু হলো ছয়ফুরের ডাবমার্কার সমর্থনে। একেবারেই সাধারণ নির্দলীয় মানুষের মিছিল। পাড়া মহল্লার দোকানগুলোর সামনে আস্ত আস্ত ডাব ঝুলতে থাকল। রিক্সাওয়ালারা ট্রাফিক জ্যামে আটকেই জোরে জোরে ‘ডাব, ডাব’ বলে চিৎকার শুরু করে, সেই স্লোগান ম্যাক্সিকান ওয়েভসের মতো প্রতিধ্বনি হয়ে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় চলে যায়। অনেক প্রেসমালিক নিজেদের সাধ্যমতো হাজার দুইহাজার পোস্টার ছাপিয়ে নিজেদের এলাকায় মারতে থাকলেন। পাড়া মহল্লার ক্লাব-সমিতিগুলো নিজেদের উদ্যোগে অফিস বসিয়ে ক্যাম্পেইন করতে থাকল।
অবস্থা এমন হলো যে ছয়ফুর রহমানকে নির্বাচনী সভায় আনার এপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেল।
ছয়ফুর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাঁদের অফিস ছেড়ে দিল ছয়ফুরের নির্বাচনী প্রচার অফিস হিসেবে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা তাঁর নির্বাচনী জনসভার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে আনতে হলেও আগে মূল অফিসে গিয়ে ৫শ টাকা এডভান্স করে আসতে হয়, নইলে ছয়ফুর রহমান আসেন না, কারণ তাঁর বাবুর্চিগিরি বন্ধ হয়ে গেছে, ফুলটাইম নির্বাচন করতে হলে সংসার খরচ দরকার। আমার মনে হয় উনিই একমাত্র প্রার্থী যাকে তাঁরই নির্বাচনী জনসভায় নিয়ে আসার জন্য উল্টো টাকা দিতে হচ্ছে।
নির্বাচনের দিন কী হলো, সেটা এখানে নিশ্চয়ই বলার প্রয়োজন নেই।আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইফতেখার হোসেন শামীম জামানত রক্ষা করেছিলেন, আর মেজর জিয়ার দল সহ বাকি সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। দক্ষিন সুরমার এক কেন্দ্রে ছয়ফুর রহমানের ডাব পেয়েছিল ১৮০০+ ভোট, ঐ কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রজাপতি মার্কা পেয়েছে কুল্লে ১ ভোট।
নির্বাচনের পরে ছয়ফুর রহমানের নাম পড়ে গেল ছক্কা ছয়ফুর। তিনি হাসিমুখে সেই উপাধি মেনে নিয়ে বললেন, ‘নির্বাচনে ছক্কা পিটানোয় মানুষ এই নাম দিয়েছে।’
উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ছক্কা ছয়ফুর সফল ছিলেন। তাঁর মূল ফোকাস ছিল প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা ঠিক করা। হুটহাট যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে পড়তেন। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই শোকজ করে দিতেন। সেই সময় প্রাইমারি স্কুলগুলো উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রনে ছিল অনেকটাই।
তবে ছয়ফুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ নিতে হয় বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কারণে। ইউনিয়ন পরিষদের দুর্নীতি বন্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যানরা একজোট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিলে যতদূর মনে পড়ে তাঁর উপজেলা চেয়ারম্যানশিপ স্থগিত করে মন্ত্রনালয়। পরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বাতিল করে দিলে ছক্কা ছয়ফুরের স্বল্পমেয়াদী জনপ্রতিনিধিত্বের চিরতরে ইতি ঘটে।
শেষ জীবনে তিনি অসুস্থ ও চিরকালীন দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেই তার জীবনাবষান হয়।সরল প্রাণ এই সমাজ বিপ্লবীর প্রতি জাবেদ মিয়ার বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্য : সংগৃহিত।