সারাবিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ; শরীয়াহ কী বলে
একুশে জার্নাল ডটকম
এপ্রিল ২৩ ২০২০, ২০:০৪
•মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ•
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন এলাকার স্বাধীন চিন্তাধারার কিছু লোকদের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে । কিন্তু বাস্তবে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করা শরী’আতের দৃষ্টিতে এর মধ্যে কী ফায়দা আছে এবং এব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল,সে সব বিষয়ে একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন ।
তাছাড়া একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কোন প্রমাণ আছে কিনা,বা থেকে থাকলে তার প্রকৃত অর্থ কী সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন ।
محمد بن زياد قال سمعت أبا هريرة رضي الله عنه يقول
قال النبي صلى الله عليه و سلم أو قال قال أبو القاسم صلى الله عليه و سلم ( صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غبي عليكم فأكملوا عدة شعبان ثلاثين ) )كتاب الصوم- باب قول النبي صلى الله عليه و سلم ( إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا –( صحيح البخاري)
وبإسناده سمعت أبا القاسم صلى الله عليه وسلم يقول صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فعدوا ثلاثين (مسند أحمد )
(১) আবু হযরত হুরায়রা(রা:)বলেন,আল্লাহর নবী
(সা:) বলেছেন,তোমরা (চাঁদ) দেখে রোযা রাখ ও (চাঁদ) দেখে রোযা ভঙ্গ কর । (বুখারী শরীফ-২/৬৭৪)
(২) নবী সা: বলেছেন-তোমরা (চাঁদ) দেখে রোযা রাখ ও (চাঁদ) দেখে রোযা ভাঙ্গো, আর যদি তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে তোমরা ৩০ দিন পূর্ণ কর। ( মুসনাদে আহমাদ-১৬ /৯১)
উক্ত হাদিসে নববীতে আল্লাহর নবী আমাদের মূলনীতি নির্ধারিত করে দিলেন যে,চাঁদ দেখা গেলে বুঝা যাবে মাস শেষ, নতুন মাস শুরু হয়েছে। তাই রমযানের চাঁদ দেখা গেলে রোযা রাখবে,আর শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে রোযা ভেঙ্গে ফেলবে।
দ্বিতীয় হাদিসটির দ্বারা বুঝা গেল ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা না গেলে ৩০ দিন পূর্ণ হলে মাস শেষ হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে । এর কোন ব্যত্যয় গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং যে এলাকায় রোযা বা ঈদের চাঁদ দেখা যাবে, সেই এলাকা ও তার পাশের এলাকা যার উদয়াচল এক (তথা উক্ত এলাকার সাথে সময়ের এত পার্থক্য নয় যে,সেখানে কখনো এ এলাকার মাসের হিসেবে কখনো ২৮ বা ৩১ তারিখ হয়ে যায়)তাদের জন্যই কেবল রোযা ও ঈদ আবশ্যক হবে।
উদায়াচল ভিন্ন অন্য এলাকার জন্য উক্ত চাঁদ দেখার দ্বারা শরয়ী হুকুমের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়বেনা।
তাই এ দুই এলাকার মাঝে এক এলাকায় চাঁদ উঠলে অন্য এলাকায়ও চাঁদ উঠেছে বলে শরয়ী বিধান কার্যকর হবেনা।
(১) একই দিনে রোযা ও ঈদ করার নির্দেশ সম্বলিত কোন আয়াত বা সহীহ হাদীস কিংবা ফুকাহায়ে কেরামগণের ইজমা কেউ পেশ করতে পারবেন না।
যেমনভাবে জুমআ ও ওয়াক্তিয়া নামায সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে হচ্ছে,এব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়না বা প্রস্তাব পেশ করে না যে, এগুলো একই সময় কীভাবে করা যায়? কারণ,এগুলো এমন ইবাদত,যা ওয়াক্ত মুতাবিক হয় । নামায হোক, রোযা হোক সারা বিশ্বে একই সময় হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা শরী’আতে নেই,আর এটা সম্ভব না ।
(২) সাহাবায়ে কেরাম একই দিনে রোযা বা ঈদ করাকে জরুরী মনে করতেন না,বরং তারা মনে করতেন প্রত্যেক এলাকার লোকেরা তাদের নিজ নিজ দেখা অনুযায়ী রোযা ও ঈদ করবে । সকল এলাকায় এক সময় করা জরুরী নয় ।
যেমন :- মুসলিম শরীফের হাদীসে দেখা যায় যে,ইবনে আব্বাস (রা:) হযরত কুরাইব (রা:) থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, শামের লোকেরা মদীনা বাসীদের একদিন পূর্বে রামাযানের চাঁদ দেখেছে । সেই হিসেবে হযরত মুআবিয়া (রা:) শামবাসীকে একদিন পূর্বে রোযা রাখতে বলেছেন । এ তথ্য জানার পরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) শামের ঘটনা তাহকীক করে মদীনাতেও একই দিনে রোযা রাখার কোন ব্যবস্থা করেননি । অথচ তিনি ইচ্ছা করলে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন । আসলে একই দিনে রোযা বা ঈদ করাকে তারা জরুরী মনে করতেন না । তাই এব্যাপারে কোন গুরুত্ব দেননি।
ইসলামের শুরু লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন সময় রোযা ও ঈদ পালিত হয়ে আসছে । কিন্তু কোন ফকীহ বা ইমাম এক দিনে রোযা ও ঈদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি । জরুরতও মনে করেননি ।
এখন হঠাৎ করে কিছু লোকের মাথায় এ খেয়াল কীভাবে চাপল যে, এত বছর যাবৎ সকল উলামায়ে কেরাম ও ফুকাহায়ে কেরাম ভুল করে এসেছেন আর তারা সহীহ বুঝতে পেরেছেন?
কাজেই এখন থেকে সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ শুরু করা দরকার? বাস্তবে উলামাগণ ভুল করেননি,বরং এসব মাথা পাতলা মুক্তমনা ব্যক্তিগণ কুরআন হাদীস না বুঝে বা না বুঝার বাহানা করে উল্টা পাল্টা ব্যাখ্যা দিচ্ছে । এব্যাপারে তাদের একমাত্র পূজি মুতাকাদ্দিমিন ফুকাহায়ে কেরামগণের দু একটা উক্তির অপব্যাখ্যা।
উক্তি দুটি এই:
(১) উদয়স্থল বিভিন্নতার কোন ধর্তব্য নেই ।
(২) এক প্রান্তে যদি চাঁদ দেখা যায়, তাহলে অপর প্রান্তেও রোযা ও ঈদ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে । (আল-বাহরুর রায়িক ২:২৭০)
বস্তুত: উক্তি দুটি না কুরআনের আয়াত না হাদীস । বরং ফুকাহায়ে কেরাম গণের বচন কওল।
সুতারাং উক্ত কওলের এমন ব্যাখ্যা দিতে হবে,যাতে আয়াত,হাদীস সাহাবায়ে আমল ও বাস্তবতার সাথে মিল থাকে । এবং এমন কোন ব্যাখ্যা দেয়া যাবেনা, যে ব্যাখ্যা অনুযায়ী উক্ত দুটি কওল কুরআন ও হাদীসের বাস্তবতার বিরুদ্ধে চলে যায়।
এসব দিকে লক্ষ্য রেখে উলামায়ে মুতাআখখিরীন যেমন:- আল্লামা কাসানী( রাহ 🙂 তার বিশ্ববিখ্যাত ফাতাওয়ার কিতাব বাদায়িউস সানায়ি,এ উল্লেখিত উক্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, চন্দ্রের উদয়স্হলর পার্থক্য নিকটবর্তী শহরের জন্য গ্রহণ যোগ্য হবেনা ।
উদায়াচলের ভিন্নতা বলা হয়, সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয়ের সময়ের ভিন্নতার কারণে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার সময়ের মাঝে একদিন বা তারচে’ বেশি দিনের পার্থক্য হয়ে যাওয়া । অর্থাৎ এক এলাকায় যখন মাসের ৩০ বা ২৯ তারিখ হয়ে চাঁদ উঠছে তথা মাস শেষ হচ্ছে দূরবর্তী অন্য দেশে তখন মাসের ২৮ বা ৩১ দিন হয়ে যাচ্ছে। এরকম যদি কোন এলাকার সাথে অন্য দেশের দূরত্ব হয়,বুঝা যাবে যে,এ দুই এলাকার উদয়াচল ভিন্ন,এক নয় । সুতরাং এ দুই এলাকার মাঝে এক এলাকায় চাঁদ উঠলে অন্য এলাকায়ও চাঁদ উঠেছে বলে শরয়ী বিধান কার্যকর হবেনা।
নিকটবর্তী শহর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐসব এলাকা যেখানে চাদ দেখার ব্যাপারে ১/২ দিনের পার্থক্য হয়না ।
যেমন: বাংলাদেশ বা পার্শবর্তী দেশে যদি চাঁদ উঠে, যাদের সাথে বাংলাদেশের উদায়াচলের পার্থক্য নেই (ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ইত্যাদী) তবে সে দেশের চাঁদ উঠার সংবাদ যদি আমাদের কাছে শরয়ী মানদন্ডে নির্ভরযোগ্য সুত্রে পৌঁছে, তবে আমাদের দেশের হেলাল কমিটি তা গ্রহণ করে সারা দেশে প্রচার করবে।
আর যেসব শহরের চাঁদ দেখার ব্যাপারে ১/২ দিনের পার্থক্য হয় সে সমস্ত এলাকাকে দূরবর্তী এলাকা বলা হয় ।সেসব শহরে বা দেশে চাঁদ দেখা উদয়স্হলের পার্থক্য ধর্তব্য হবে। সেক্ষেত্রে এক শহরে বা দেশে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে, অন্য এলাকার জন্য প্রযোজ্য হবেনা ।যেমন : সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের উদায়াচলের পার্থক্য আছে,অর্থাৎ সৌদির মাস আমাদের একদিন আগে বা পড়ে শেষ হয় । সুতরাং সে দেশে রোযা বা ঈদের চাঁদ উঠলে বাংলাদেশে রোযা বা ঈদ করা যাবেনা । (বাদায়িউস সানায়ি ২:৫৭৯)
هذا إذا كانت المسافة بين البلدين قريبة لا تختلف فيها
المطالع فأما إذا كانت بعيدة فلا يلزم أحد البلدين حكم الآخر لأن مطالع البلاد عند المسافة الفاحشة تختلف فيعتبر في أهل كل بلد مطالع بلدهم دون البلد الآخر بدائع الصنا ئع 2/579كتاب الصوم / فصل وأما شرائطها)
তেমনিভাবে আল্লামা ইবনে আবেদীন(রাহ:) মিনহাতুল খালিক আলাল বাহরির রায়িক গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
পশ্চিম এলাকার চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে, পূর্ব অঞ্চলের লোকদের জন্য রোযা ও ঈদ করা জরুরী হবে এর অর্থ সম্পূর্ণ পৃথিবীর পশ্চিম ও পূর্ব এলাকা নয় । বরং একই শহরের পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চল উদ্দেশ্য।(মিনহাজ ২:২৭০)
قوله : ويلزم أهل المشرق بروية أهل المغرب إذ ليس المراد
بأهل المشرق جميعهم بل بلدة واحدة تكفي كما لا يخفى. ) (منحة الخالق على البحر الرئق ٢/٢٩٠ )
এধরনের একই কথা হানাফী মাযহাবের প্রচুর কিতাব বিদ্যমান রয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ :- (তাবয়ীনুল হাকায়িক ১:৩২১ – মজমাউল ফাতাওয়া ২৫২ – মারাক্বিল ফালাহ ৫৩৩, ফাতাওয়ায়ে তাতাখানিয়া ২:৩৫৫-৩৫৬ – ফাতহুল মুলহিম ৩:৩১৩ – মাআরিফুস সুনান ৬:৩১ – জাদীদ ফিকহী মাসায়িল ২:৪০)
পক্ষান্তরে কতিপয় স্বাধীন খিয়ালের লোক এসমস্ত কিতাবাদীকে উপেক্ষা করে নিজের মনগড়া এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যা কুরআন হাদীস এবং বাস্তবতার বিরুদ্ধে ।
●সারা পৃথিবীতে একই সময়ে ঈদ করার দাবী হাস্যকর
পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে যার সাধারণ জ্ঞান রয়েছে, সে কখনো একথা বলতে পারেনা যে, সারা পৃথিবীতে এক সময়ে ঈদ করা সম্ভব। কারণ আমরা জানি পৃথিবীতে রাত দিনের পার্থক্য কেন হয়?
পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, নিজ অক্ষের উপর ও আবর্তিত হয়। পৃথিবী তার মেরু রেখার উপর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। পৃথিবী তার মেরু রেখার চারদিকে এভাবে ঘুরে আসতে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় লাগে। এ চব্বিশ ঘন্টাকে বলা হয় এক দিন। পৃথিবীর এ দৈনিক গতির নাম আহ্নিক গতি। এ আবর্তের সময় পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে থাকে সে অংশে তখন দিন এবং অপর অংশে রাত হয়। আর একারণেই বাংলাদেশে যখন দিন তখন আমেরিকাতে রাত হয়। সুতরাং বাংলাদেশে চাঁদ উঠলে আমেরিকাতে ঈদ করতে হলে ঈদের জামাত গভীর রাতে করা ছাড়া কোন পথ আছে কী? আর ঈদের নামায দিনের বেলা না পড়ে রাতে পড়ার বিধান আল্লাহ প্রদত্ব না নিজে বানানো? সৌদিতে বাংলাদেশে অফিস টাইম হয়েছে বলে যে সকল রাষ্ট্রে এখনো রাত বা অফিসের সময় হয়নি,তাদের ও অফিসে যেতে হবে’ এ দাবী যেমন পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়, ঠিক তেমনি সৌদিতে বা বাংলাদেশে আল্লাহ তা’য়ালার নির্দিষ্ট কোন ইবাদতের সময় হয়েছে বলে,তা যে রাষ্ট্রে এর সময় হয়নি তাদেরও তা “পালন করতে হবে” বলার কথা মানসিকভাবে সুস্থ্য মানুষ বলতে পারে ?
সুতরাং শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে এ অদ্ভূত দাবী তথা সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা হাস্যকর ছাড়া অন্য কিছু বলে মনে হয়না। আল্লাহ পাক আমাদের সহায় হোন । এবং ফিতনাবাজদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করুন । আমীন