সাদাকাতুল ফিতর: খাদ্যদ্রব্য দিবেন? না মূল্য দিবেন?
একুশে জার্নাল
জুন ০৯ ২০১৮, ২০:৪৫
প্রথমেই আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সমপরিমাণ মূল্য দিলে যেমন ফিতরা আদায় হবে, ঠিক তেমনিভাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রধান খাদ্যদ্রব্য দিলেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে৷ যারা বলেন শুধু খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে, মূল্য দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে না, তাদের এই কঠোরতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, গরীবের স্বার্থের বিপরীত৷
যারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করেছেন, তাই আমরাও খাদ্যদ্রব্য দিয়েই আদায় করব৷ মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় হবে না মর্মে সর্বত্র প্রচারণা চালান, তাদের বোঝা উচিত ছিলো যে, রাসূলুল্লাহ (সা,)-এর যামানা, সাহাবায়ে কেরামের যামানা ও তৎপরবর্তী যামানায় যেরকম গম, আটা, খেজুর, কিশমিশ প্রধান খাদ্যদ্রব্য ছিলো, ঠিক তদ্রূপ এগুলোতে গরীবের স্বার্থ ও লাভালাভের ব্যাপারটিও সুনিশ্চিত ছিলো৷ এ সমস্ত ফসল-নির্ভর ছিলো তখনকার সমাজ৷ কারণ তখন তারা এগুলো দ্বারা অনায়াসে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারতেন৷ যেকোনো জিনিস খরিদ করতে পারতেন৷ তখনকার বাজারনীতিতে ফিতরার এই দ্রব্যগুলো বিনা লোকসানে ثمن তথা মূল্যের কাজ দিতো৷ কিন্তু বর্তমানে এই দ্রব্যগুলো শুধুই مبيع তথা পণ্যের কাজ দেয়, মূল্যের কাজে আসে না৷ কোনো ব্যবসায়ী বা দোকানদার এগুলোকে পণ্যের বিনিময়ে মূল্য হিসেবে গ্রহণ করবে না৷
অনেকেই বলেন, যেহেতু আমাদের দেশে প্রধান খাদ্যদ্রব্য চাউল (Rice) তাই বাংলাদেশীদের চাউল দিয়েই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে৷ প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের প্রধান খাদ্যদ্রব্য যে ‘চাউল’ একথাটিও সবার ক্ষেত্রে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ তাছাড়া সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে ‘চাউল’ গরীবের স্বার্থের অনুকূলও নয়৷
এখন প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে ‘চাউল’ গরীবের স্বার্থবান্ধব নয়? আমরা যদি ‘বাসমাতি’ বা ‘চিনিগুড়া’-জাতীয় ভালো চাউল দেই, তাহলে গরীবের স্বার্থের অনুকূল হবে না কেনো?
উত্তর: দেখুন, স্বচ্ছলদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে গরীব-দুঃস্থদের স্বার্থ-সংরক্ষণও শরীয়তের দাবি৷ এমতাবস্থায় শুধু নিজের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করে দায়মুক্তির তৃপ্তি লাভ না করে গরীবের প্রয়োজন মেটানোর প্রতি সবিশেষ খেয়াল রাখাও একজন দায়িত্ববান মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ সেই হিসেবে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা প্রদান করলে দেখা যাচ্ছে, গরীবের প্রয়োজন সারছে না৷ হয়ত তার ঘরে চাউল আছে, কিন্তু তরকারির ব্যবস্থা নেই৷ তেল নেই, ডাল নেই, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই৷ নিজের অবুঝ সন্তানের জন্যে ঈদের জামা নেই৷ শুধু চাউল দিয়ে তো এসব প্রয়োজন মিটছে না৷ আবার দোকানি এসব চাউল অন্য পণ্যের বিনিময়ে গ্রহণও করবে না৷
বলতে পারেন, চাউল বিক্রি করে তো প্রয়োজন মেটাতে পারে৷ প্রথমেই এই চাউল বিক্রি করতে গেলে আসল দাম পাবে না৷ যে মূল্যে চাউল খরিদ করা হয়েছে, সেই মূল্য থেকে অনেক কম দামে বিক্রি করতে হবে এই চাউল৷ বাংলাদেশের বাজারে কোনো জিনিসেরই খরিদ মূল্যে বিক্রি হয় না৷ এখানেই গরীবের স্বার্থে আঘাত এসে গেলো৷ গরীবের কিছু হক দোকানদারের ক্যাশে ঢুকে গেলো৷ দ্বিতীয়ত, বিক্রি করতে গেলে অনেক ঝামেলা আছে, অনেক খরচ আছে৷ এই খরচটুকুও তো তার গাঁট থেকে পোষাতে হবে৷ এটাও গরীবের স্বার্থ পরিপন্থী৷ তৃতীয়ত, অনেক লজ্জাশীল গরীব লোক কষ্ট করে চলবে, তবুও ফিতরার এই চাউল ভুলেও বেচতে যাবে না৷
দেখা যাচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা প্রদান করলে আপনার ফিতরা তো আদায় হয়ে যাবে এবং এই পদ্ধতিই প্রাথমিক যুগে ছিলো৷ কিন্তু এ যুগের গরীবরা পড়ে যাবে বিপাকে৷ তাই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায় গরীবের স্বার্থবান্ধব ফিতরা হচ্ছে- মূল্য তথা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা৷ আবার হাদীসে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আদায় করার কথাও এসেছে৷ আপনি যদি মৌলিক অন্তর্নিহিত বিষয় তালাশ না করে বাহ্যিক হাদীসের উপর আমল করতে চান, তাহলে করুন৷ তবে আমি মনে করি এ যুগে টাকাই আমাদের প্রধান খাদ্যদ্রব্যের স্থান দখল করে নিয়েছে৷