সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী: একটি তুলনামূলক পাঠ -০২

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ৩১ ২০১৯, ২০:৪৬

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে। আজকের প্রসঙ্গ — কুর’আনের মৌলিক পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন ও বোঝাপড়া, এবং জাহিলিয়া — এ সম্পর্কে দুজনের মতামত উপস্থাপিত হল।

৩. কুর’আনের মৌলিক পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন ও বোঝাপড়া প্রসঙ্গে

মওদূদী – কুর’আনের মৌলিক পরিভাষা যেমন ইলাহ, রব, ইবাদাত এবং দ্বীন – এই চারটি শব্দের অর্থ আরবের জাহিলিয়া এবং নবী মুহম্মদ স. এর সময়কালে যেমন অনেকের কাছে বোধগম্য ছিল পরবর্তীকালে আর তেমন ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কুর’আনের এই শব্দগুলির অর্থে পরিবর্তন ঘটেছে। এই শব্দগুলির সম্পূর্ণ অর্থ ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেখানে আংশিক ও অস্পষ্ট অর্থ চালু হয়েছে বলে মওদূদী মনে করতেন।

এর ফলে কুর’আনের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে গেছে। এই কারণে কুর’আনের চার ভাগের তিন ভাগ অথবা আসল চেতনাই যেন বোঝাপড়ার বাইরে থেকে গেছে। এটি মানুষের ইমান ও আমলের সমস্যার অন্যতম প্রধান একটি কারণ বলে মওদূদী মনে করতেন।

নাদভী – কুর’আনের পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন প্রসঙ্গে মওদূদীর অভিমত বিষয়ে নাদভী যে গঠনমূলক সমালোচনাটি লেখেন সেখানে তিনি মূলতঃ পাঁচটি প্রতিযুক্তি উত্থাপন করেছিলেন –

 ক. মওদূদীর এই বয়ান কুর’আনের অর্থ শেখা ও বোঝার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি করে।

. মুসলিম উম্মাহ কখনোই কোন যুগে বা কালে সম্পূর্ণভাবে কুর’আনের অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত হয় নি।

গ. ইসলামের রয়েছে ইসলাহ ও তাজদিদের ধারাবাহিক ইতিহাস। মওদূদীর ব্যাখ্যা মেনে নিলে ইসলামের পরম্পরায় মহান সংস্কারক ও মুজাদ্দিদদের অবদানকে খাটো করা হয়।

ঘ. কুর’আনের চার পরিভাষার মওদূদীকৃত সংজ্ঞা ভারসাম্যপূর্ণ নয় বরঞ্চ এই সংজ্ঞায়ন একপেশে ও অতিরাজনীতিকরণের শিকার।

. ইকামাতে দ্বীন বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আলোকে মওদূদীর বয়ান দ্বীনের উদ্দেশ্য ও উপায়কে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। উদ্দেশ্যকে উপায় এবং উপায়কে উদ্দেশ্য রূপে উল্টো করে দেখার ফলে ইবাদাতের আধ্যাত্মিক অনুশীলনে ঘাটতি দেখা দেয়। শিরক ও বিদাত বিষয়ে অতি সংবেদনশীল হবার ফলে পর্যাপ্ত রুহানী ইরফান ও ইহসানের চর্চা অনুৎসাহিত হয়।

 ৪. জাহিলিয়া প্রসঙ্গে

মওদূদী – জাহিলিয়া প্রত্যয়টিকে মওদূদী ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি জাহিলিয়া বলতে অনেক ধরণের বিশ্ববীক্ষাকে চিহ্নিত করতেন; এইসব বিশ্ববীক্ষায় রয়েছে এমনসব চিন্তা, বিশ্বাস এবং কর্মকান্ড যা আল্লাহর হাকিমিয়া বা সার্বভৌমত্ব এবং দিব্য কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে। তিনি এইধরণের জাহিলিয়ার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনাকেও উন্মুক্ত রাখতে চান।

মওদূদীর প্রভাবে মিশরের সাইয়েদ কুতুব এই জাহিলিয়া প্রত্যয়টিকে আরো বিকশিত করে তোলেন। তিনি মনে করতেন যে জাহিলিয়া ও ইসলামের দ্বন্দ্বই হল বিশ্ব ইতিহাস। জাহিলিয়া মানে শুধু আরবের ইতিহাসের প্রাক-ইসলামী একটি সুনির্দিষ্ট যুগ নয়। জাহিলিয়া হল একটি আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। জাহিলিয়া হল যা কিছু ইসলাম তার বিপরীত। অর্থাৎ কুফর ও শিরক সহ যাবতীয় অনিসলাম।

জাহিলিয়ার কোন নির্দিষ্ট স্থান-কাল নেই। যে কোন যুগে যে কোন স্থানে এর উপস্থিতি হতে পারে। যেমন এখন এই উত্তরাধুনিক কালেও জাহিলিয়া বিদ্যমান। শুধু অমুসলিম দেশেই যে জাহিলিয়া রয়েছে তা-ও নয়। মুসলিম দেশে দেশেও জাহিলিয়া রয়েছে। এই যে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, উদারনৈতিক গণতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র ইত্যাদি সবই জাহিলিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

দুনিয়াবী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিপুল উন্নতি ও অর্জনের পরেও আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে জাহিলিয়া বহাল তবিয়তে থেকে যেতে পারে। সুতরাং উত্তরাধুনিক যুগের পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি আসলে জাহিলিয়ায় আক্রান্ত। মুসলিম বিশ্বেও ইসলাম ও জাহিলিয়া সমান্তরালভাবে বিরাজ করছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।

ইসলাম ক্রমাগত এই সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিক ও মানসিক জাহিলিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। আর সেটাই ইসলামের ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করে।

নাদভী – ইসলামী নিজামের বাইরে যা কিছু আছে সেসবকে ঢালাওভাবে জাহিলিয়া বলে আখ্যায়িত করাকে নাদভী প্রান্তিক চিন্তা বলে মনে করতেন। তিনি অন্য মতাদর্শের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার নীতির বিপক্ষে ছিলেন।

তিনি দৃঢ় ও আন্তরিকভাবে মনে করতেন যে ইসলাম একটি বিপ্লবী মতাদর্শ হিশেবে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতার অধিকারী। এক্ষেত্রে ইসলামের বর্তমান সম্ভাবনা সপ্তম শতাব্দীতে জাহেলী আরবের মতই উজ্জ্বল। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম এবং মতাদর্শিক বিজয়ের জন্য সংগ্রামের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্ণয় করতেন। যদিও প্রথম ধরণের সংগ্রামের ক্ষেত্রে হিংসাত্মক কর্মকান্ড অনুমোদিত হলেও দ্বিতীয় ধরণের সংগ্রাম সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে মানুষকে আশ্বস্ত করে পরিচালনা করতে হবে বলে অভিমত দিয়েছিলেন। কারণ সবাইকে মনে রাখতে হবে যে ইসলামে কোন জোর জবরদস্তির সুযোগ নেই। আর তিনি আরবদের নেতৃত্বের উপরে অনেক বেশি প্রত্যাশী ছিলেন।

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)