সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর চাউল বিতরণ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, দায়ী কে?
একুশে জার্নাল
এপ্রিল ১৩ ২০২০, ০৭:০৯
নূরুজ্জামান সরকার নীহার বকুল, তারাকান্দা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য সংস্থান। খাদ্য ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ। এখনো প্রায় ৩০ শতাংশ লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। এসব মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক অধিকার খাদ্য নিশ্চয়তার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মানবতার মা নামে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জনকারী শেখ হাসিনা এর অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প ফেয়ারপ্রাইজের ১০ টাকা কেজি দরের খাদ্য কর্মসূচী।যা প্রতি তিনমাস অন্তর অন্তর হতদরিদ্র জনসমষ্টিকে প্রদান করা হয়। এ কর্মসূচির মূল প্রতিপাদ্য হলো “ক্ষুধায় এখন ভয় নাই, দশ টাকায় চাল পাই”।
কর্মসূচীটি বাস্তবায়ন করতে ইউনিয়নের লোকসংখ্যা অনুযায়ী ওয়ার্ড ভিত্তিক ডিলার নিয়োগ করা আছে।নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী তারা সরকারি গোদাম হতে বরাদ্দকৃত চাউল উত্তোলন করে সুবিধাভোগীদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এজন্য ডিলারদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন প্রদান করা হয়। এতো গেল প্রক্রিয়াগত দিক। এবার আসা যাক সমস্যা ও সমাধানকল্পে করণীয় বিষয়ের দিকে।
১. ডিলার নিয়োগের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার ভিতরে হয় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ডিলারের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে, নিয়োগের সময় উচ্চ মহলের অনেককে বেশ ম্যানেজ করতে হয়, দলীয় বিবেচনায় এবং আত্মীয় বিবেচনায়ও অনেককে ডিলারি প্রদান করা হয়। তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি এখানে অনেকটা গৌণ বিষয় বলে প্রতিয়মান।
২. সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রস্তুতির সময় সঠিক নিয়মকানুন বা নীতিমালা মানা হয় না। সুপারিশ ও আত্মীয়করণের কারণে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, আমলা, কিছু ক্ষেত্রে অর্থের বিষয়টিও মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। যদিও সুবিধাভোগী নির্ধারণের জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি আছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী অফিসার, জনপ্রতিনিধি, খাদ্য কর্মকর্তা, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ববৃন্দের সমন্বয়ে তা গঠন করার বিধিবিধান দেওয়া আছে।
৩. যেহেতু সুবিধাভোগীদের অর্ধেকই ভুয়া ( নীতিমালা বর্হিভূত) বা সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত নয়, স্বাবলম্বী হয়েছে, নেতাগোছের; তারা তাদের বরাদ্দকৃত কার্ডের মালগুলো ডিলারের কাছে বা গরীবদের কাছে অথবা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে সরকারের ক্ষতি হলেও এ কাজের সাথে জড়িত সবাই কিছু না কিছু বেনিফিট পেয়ে থাকে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে কড়াকড়ি আরোপ থাকায় এ কার্ডের চাউলগুলো নিয়েই সবাই বিপাকে পড়েছে। আগে তা খাদ্য গুদামে রাখা যেতো বা মিলারদের দেওয়া যেতো পূর্ণ বিক্রির জন্য অথবা চাউল ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করা যেতো, তারাও পূণরায় তা সরকার বা পাবলিকের নিকট বিক্রি করতো। অনেকটাই রি-সাইকেল প্রক্রিয়া!
৪. সুবিধাভোগীর কার্ডগুলো ডিলারগণ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কারণে কে কে সুবিধাভোগী তা নিশ্চিত হতে পারা যায় না। এ ক্ষেত্রে ট্যাগ অফিসাররা তাদের নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। বিনিময়ে কিছুটা সুবিধা তারাও নেয় এবং মাস্টাররোল ভুয়া বানানো হলেও তাতে সহি-সাক্ষর করে দেয়।
৫. দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও পুনরায় প্রশাসন কর্তৃক সুবিধাভোগীর কার্ডগুলোর যাচাই-বাছাই না করা এবং একই ব্যক্তিকে বারবার অনুদান প্রদানের কারণেই ব্যাপক দূর্নীতির সুযোগ হয়। আর তালিকাটি জনসম্মুখে কখনো আলোরমুখ দেখে না ডিলার ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়।
৬. সর্বোপরি নীতিনৈতিকতার অভাব ও অধিক মুনাফা লাভের আশায় কালোবাজারি করে দেশের সম্পদ হতদরিদ্র মানুষের হক ছিনতাই করার মানসিকতাই কারসাজিতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে ডিলার ও অবৈধ কার্ডধারীদের।
সমস্যা আরো আছে, তবে এগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে উপরোক্ত বিষয়ে যদি সরকার তাদারকি করে তবে থলের আসল বিড়ালটি খুব সহজেই বেড়িয়ে আসবে। এখানে কাউকে এককভাবে দোষী বা দায়ী করার কোন উপায় নেই। এ- টু-জেড এক্ষেত্রে আকণ্ঠ দূর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করা যেতেই পারে। তাই সরকারের মহৎ এই মেগা কর্মসূচিতে চিরুনি অভিযানেই শুধুমাত্র সফলতা পেতে পারে।সুবিধাভোগী যারা হওয়ার কথা, তারা এখনো দারিদ্র্যের নিচেই বাস করে যাচ্ছে, কিন্তু সুফল পাচ্ছে না। তাই সরকারের সম্পদ হচ্ছে অপচয়, টেক্সের টাকা হচ্ছে নষ্ট।
এবার আসা যাক ত্রাণ নিয়ে আলোচনায়। বাংলাদেশের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো দেশের সম্পদ লুন্ঠনের একটা প্রতিযোগীতা! যে দেশ ও জনগণের উপকারের জন্য তারা সব ভোটের সময় নির্বাচিত হয়, পাশ করার পর তারা তা বেমালুম ভুলে যায়। এক্ষেত্রে তাদের লোভ, শঠতা, লুটতরাজ নীতিতে নিজেকে গড়ে তুলে। কারণ ভোটের সময় তারা যে ইনভেস্ট করে তা তুলতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে এবং সে টাকা সুদে-আসলে পূরণ করতে চায়। আর এই বিষয়টির জন্য জনগণও কম দায়ী নয়। তারা সৎ, যোগ্য, আদর্শ দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের অবজ্ঞা করে কালোটাকার মালিক, পেশিশক্তি, অদক্ষ, দুর্নীতিবাজদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। চা, পান, বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, নগদনারায়ণ পেয়ে ৫ বছরের দায়িত্ব তাদের হাতে সোপর্দ করে। সে জন্যই পরবর্তীতে তারা সঠিক সেবা থেকে সদা সর্বদাই বঞ্চিত হয়। এধরনের মানসিকতা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে হবে। না হয় কখনো সুফল পাবেনা হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে সকল রাজনৈতিক নেতা যে খারাপ, তাও কিন্তু হলফ করে বলতে পারবো না। এরা সংখ্যায় অধিক হবে না। হলে এদেশ এতোটা এগিয়ে যেতো না। বিশেষ করে দলীয় প্রধানের সততার কারণেই এ সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সঠিকতর নেতৃত্বগুণের বিকল্প নেই।
ধান ভানতে শিবের গীত অনেক হলো, “শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ” এটাই হোক এ কর্মসূচির মূলমন্ত্র। অনেকেই বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আজ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী তারা চাউলের জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে। এর কাছে তার কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। আজ করোনার ভয়ের চেয়ে ক্ষুধাতুর মুখগুলো কেমন যেনো ফ্যাকাশে, তাদের জন্য ত্রাণ চেয়ে ইতি টানছি।