সংক্রামক রোগ, ইসলামের দৃষ্টিতে করণীয় কী?
একুশে জার্নাল ডটকম
জুন ২০ ২০২০, ১৭:৪৯

মুফতি আহমদ যাকারিয়া
মানুষের শরীরে রোগ-ব্যাধি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে আবার আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ করে। কোন বস্তুর বা কারো শক্তি নেই কাউকে রোগ দেয়া বা তা থেকে নিরাময় প্রদান করা। বরং তা একমাত্র আল্লাহ পাকের ক্ষমতা। তিনি যাকে ইচ্ছা রোগ দেন এবং এর নিরাময় তিনিই করেন। আল্লাহ পাক যেভাবে রোগ সৃষ্টি করেছেন তেমনি রোগ থেকে আরোগ্য পেতে এর যথাযথ ব্যবস্থাপনাও দিয়ে রেখেছেন।
আবু হুরায়রা রাঃ সূত্রে নবী সাঃ বলেছেন, আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি।(বুখারী)
হযরত আবু দারদা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাকই রোগ ও ঔষধ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক রোগের চিকিৎসাও তিনি সৃষ্টি করেছেন। অতএব তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর।(আবু দাউদ:৩৮৬৪)
মূলত পৃথিবীতে যত বিপদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তার মূল কারণ মানুষের সীমালঙ্ঘন এবং অন্যায় কৃতকর্ম। তাই আল্লাহ পাক মাঝেমধ্যে সৃষ্টির মধ্যে তার শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটান, যেন আল্লাহর অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘণকারী মানুষ সচেতন হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে।
আল্লাহ বলেন: “স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।” (রুম: ৪১)
রাসূল সাঃ বলেন: “যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী এবং এমন সব রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো প্রকাশ পায়নি।
যাহোক, বর্তমানে কারো অজানা নেই যে, চীন থেকে উৎপত্তি ‘করোনা’ নামক এক ভাইরাস আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত। এতে আবারও প্রমাণিত হলো যে, সত্যি মানুষ আল্লাহর অতিশয় দুর্বল সৃষ্টি। যার কারণে তারা আল্লাহর খুব সামান্য এক সৃষ্টি (যা খালি চোখে দেখা যায় না) ভাইরাসের কাছে আজ অসহায়। যথার্থই আল্লাহর ভাষায় মানুষ ‘অতীব অবিচারী এবং মূর্খ।’ (আহযাব:৭২)
এ বিষয়ে ইসলাম আমাদেরকে কী নির্দেশনা প্রদান করে?
রাসূল সাঃ বলেন, ‘‘কিছুকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা শিরক। কিছুকে অপয়া মনে করা শিরক। কিছুকে কুলক্ষণ মনে করা শিরক। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার অন্তরে কুধারণা জন্মে না। তবে আল্লাহর উপর ভরসার ফলে আল্লাহ তা আমাদের হৃদয় থেকে দূর করে দেন।’’ (মুসনাদ আহমাদ ১/৩৮৯, ৪৪০, সুনান আবু দাউদ ৩৯১২,)
রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘‘রোগের সংক্রমণ ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে শুভ লক্ষণ মানা আমার নিকট পছন্দনীয়।” সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘‘শুভ লক্ষণ কী?’’
উত্তরে রাসূল সাঃ বললেন, ‘‘উত্তম বাক্য।’’ এই হাদীসে বলা হচ্ছে যে, রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই। এটা দেখিয়ে অনেকে বলতে চান যে, আধুনিক বিজ্ঞান বলে জীবাণুর বিস্তারের দ্বারা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের সংক্রমণ ঘটে; কাজেই হাদীসের বক্তব্য সঠিক নয়। আমরা যদি এ বিষয় সংক্রান্ত আরো হাদীস সামনে আনি তাহলে দেখবো যে, এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের জীবাণু ছড়ানো – এই প্রাকৃতিক নিয়মকে ইসলাম অস্বীকার করে না।
আরেক হাদীসে রাসূল সাঃ বলেন; “ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই।” হাদীসের এ কথা দ্বারা মূলত ইসলাম ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করেনি। এক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে ভ্রান্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে তা হচ্ছে যে, কোনো ব্যাধিকে এমন মনে করা যে, তা নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। যেমনটি জাহেলী যুগে মনে করা হত। উপকার ও অপকারের একমাত্র মালিক আল্লাহ। জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা-অসুস্থতা সবই তাঁর হুকুমে হয়ে থাকে। মোটকথা, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত হওয়া একটি বাস্তব বিষয়। তবে সংক্রমনের এই ক্ষমতা রোগের নিজস্ব নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত। তাই তিনি চাইলে সংক্রমণ হবে নতুবা হবে না এবং এটি যেহেতু রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি বাস্তব কারণ তাই রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ থেকে বেঁচে থাকতে যেমনিভাবে কোনো দোষ নেই তেমনি এক্ষেত্রেও উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা দোষের নয়। বরং কিছু হাদীসে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
(বাযলুল মাজহূদ ১৬/২৪২; শরহুন নববী ২/২৩০; ফয়যুল কাদীর ৬/৪৩৩; তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৪/৩৭০;
আরেক হাদীসে আছে, আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, নবী সাঃ বলেছেন; “রোগ সংক্রমণ, কুলক্ষণ, পেঁচা এবং সফর মাস বলতে কিছু নাই।” (বুখারী-৫৭০৭) উক্ত হাদীসে মূলত পেঁচা ও সফর মাসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি বরং জাহেলী যুগে পেঁচার ডাক এবং সফর মাসকে কুলক্ষণে মনে করা হতো, তাই এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে এ কথার দ্বারা। মূলত ইসলামের কোনো বিষয়ই বাস্তবতার পরিপন্থী নয়। কেননা, এ বিশ্বজগত যিনি সৃষ্টি কছেন তিনিই শরীয়ত দিয়েছেন। অতএব ইসলামের কোনো বিষয়ের সাথে বাস্তবতার সংঘর্ষ হতে পারে না। এ বিশ্ব জগতে যা কিছু হয় সবই আল্লাহর সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে। এর পেছনে যেসব উপকরণকে বাহ্যিক কার্যকারণ হিসেবে দেখা যায় এগুলো যদিও বাস্তব, তবে এসবের কার্য ও ক্রিয়া করার ক্ষমতা আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহ ক্রিয়া করার ক্ষমতা না দিলে এগুলো ক্রিয়া করতে পারবে না। সুস্থতা-অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। সুস্থতার যেমন বিভিন্ন কারণ রয়েছে তদ্রূপ অসুস্থতারও বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন-মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় সর্দি বা জ্বর হয়। তেমনিভাবে রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি কারণ এটিও যে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া। এটি একটি বাস্তব বিষয়। শরীয়ত একে অস্বীকার করেনি। তবে অন্যান্য উপকরণের ব্যাপারে যে কথা এখানেও একই কথা। “কার্য ও ক্রিয়া করার ক্ষমতা আল্লাহপ্রদত্ত।” রোগের মধ্যে ক্রিয়া করার নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। তাই আল্লাহ চাইলে রোগাক্রান্ত হবে নতুবা হবে না। এজন্যই দেখা যায়, সংস্পর্শে যাওয়ার পরেও অনেকে রোগাক্রান্ত হয় না। ইসলামে অনুরূপভাবে সংক্রমন রোগের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা হয়নি বরং একটি ভ্রান্ত বিশ্বাসের অপনোদন করা হয়েছে। তা হল, জাহেলী যুগে কোনো কোন রোগকে এমন মনে করা হতো যে, তা নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো যে, রোগ কখনও নিজে নিজে সংক্রমিত হতে পারে না। বরং তা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সংম্পৃক্ত। তার লিখিত তাকদীর ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না।
হাদীসের বিষয়ে এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নবী সাঃ যে যুগের মানুষ ছিলেন, সে যুগে পুরো পৃথিবী ছিলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিভিন্ন প্রকার কুলক্ষণ, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস সে যুগে প্রচলিত ছিলো। জাহেলী যুগে আরবরা “হাম্মাহ” বলতে কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসকে বুঝে থাকতো। তাদের ধারণামতে ‘হাম্মাহ’ ছিলো “হুঁতুম পেঁচা”, যা গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার উৎসাহ দেয়। তাদের কেউ কেউ ধারণা করতো যে, নিহত ব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। তৎকালীন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করতো। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করতো যে, সে মৃত্যুবরণ করবে। ঠিক তেমনিভাবে আরবরা সফর মাসকে অপয়া একটি মাস মনে করতো। কোনো জিনিস দেখে, কোনো কথা শুনে বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘ত্বিয়ারাহ’ বলা হয়। নবী সাঃ এর যুগে এই সমস্ত ভ্রান্ত জিনিস আরবরা বিশ্বাস করতো।
এই হাদীসগুলোতে মূলত প্রাচীন আরবদের এই সমস্ত কুসংস্কারের অপনোদন করা হয়েছে। ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ভুল তথ্য থাকা তো দূরের কথা, এই হাদীসগুলোতে মূলত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এমনকি কুলক্ষণ বিশ্বাস করার মতো জিনিসকে ইসলামে শিরক বলে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক নিয়মকে যে ইসলাম অস্বীকার করে না তার প্রমাণ হচ্ছে নিচের হাদীসগুলো।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ‘‘সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। সফর মাসকেও অশুভ মনে করা যাবে না এবং পেঁচা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে তাও অবান্তর।’’ তখন এক বেদুঈন বললো, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উটের পাল অনেক সময় মরুভূমির চারণ ভূমিতে থাকে, মনে হয় যেন নাদুস-নুদুস জংলী হরিণ। অতঃপর সেখানে কোনো একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এসে আমার সুস্থ উটগুলোর সাথে থেকে এদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দেয়।’’ এ কথা শুনে রাসূল সাঃ বললেন, ‘‘প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?’’ অতঃপর আবূ হুরাইরা রাঃ সূত্রে বর্ণিত, তিনি নবী সাঃ কে বলতে শুনেছেন যে, ‘‘রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়।’’
আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাঃ বলেন; “কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।”
এক উট থেকে অন্য উটে রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয়। এছাড়া কুষ্ঠ রোগীর নিকটে গেলে এর জীবাণু সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি থাকে। উপরের হাদীসগুলো গবেষণা করলে বুঝতে পারতেছি যে, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই” একথা বলার সাথে সাথে এটাও বলা হচ্ছে যে, রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের কাছে না আনা হয় এবং কুষ্ঠ রোগীর থেকে যেন দূরত্ব বজায় রাখা হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রোগের জীবাণু সংক্রমিত হবার প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়া হাদীসে অস্বীকার করা হয়নি। এ প্রক্রিয়া যদি হাদীসে অস্বীকারই করা হতো, তাহলে নবী সাঃ কেন কুষ্ঠ রোগীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বললেন? আর কেনই বা রোগাক্রান্ত উটকে সুস্থ উটের কাছে আনতে নিষেধ করলেন?
এ বিষয়ে আরো একটি হাদীস আছে;
রাসূল সাঃ বলেন; “যখন তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোনো, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য শহরেও যেয়ো না।”
কতই না উত্তম ও কার্যকর একটি ব্যবস্থা। মহামারী আক্রান্ত অঞ্চল থেকে রোগীরা যদি বেরিয়ে না যায় এবং সে অঞ্চলে যদি বাহির থেকে লোক না আসে, তাহলে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেক কমে যায়। এসব হাদীস পর্যালোচনা করলেই তো বুঝা যায় যে, ইসলামে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যাবার প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করা হয়নি।
এখন কথা হলো যে, হাদীসে কেন বলা হলো যে, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই”? এর উত্তর হাদীসের মধ্যেই রয়েছে। সাহাবীগণ যখন এক উটের সংস্পর্শে অন্য উটের রোগাক্রান্ত হবার ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন, তখন নবী সাঃ বললেন, “প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?” অর্থাৎ এই রোগের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। যখন কেউ রোগাক্রান্ত ছিলো না, তখন এই রোগ তিনি সৃষ্টি করেছেন। প্রথম রোগাক্রান্ত প্রাণী তো কারো নিকট থেকে সংক্রমণের শিকার হয়নি। রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয় বটে, কিন্তু জীবাণু সংক্রমিত হওয়া মানেই রোগ সংক্রমিত হওয়া না। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সুস্থ রাখেন, যাকে ইচ্ছা রোগাক্রান্ত করেন। যদি আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি না থাকে, তাহলে জীবাণু সংক্রমিত হলেও রোগ হয় না। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত জীবাণুর সংক্রমিত হবারও যেমন সামর্থ্য নেই, আবার সংক্রমিত হয়েও কারো দেহে রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। বিষয়টি মূলত সম্পূর্ণ তাকদিরের সাথে সম্পর্কিত।
নবী সাঃ যে বলেছেন: ‘সিংহের ভয়ে তুমি যেমন পলায়ন কর, কুষ্ঠ রোগী দেখেও তুমি সেভাবে পলায়ন কর।’ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নবী সাঃ কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এখানে রোগের চলমান শক্তির কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে রোগ নিজস্ব ক্ষমতাবলে অন্যজনের কাছে চলে যায়, এ কথা অনিবার্য নয়। নবী সাঃ সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন; “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।” (বাক্বারাহ-১৯৫)
এটা বলা যাবে না যে, নবী সাঃ রোগের সংক্রমণ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। কেননা বাস্তব অবস্থা ও অন্যান্য হাদীসের মাধ্যমে এরকম ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে।
যদি বলা হয় যে, নবী সাঃ যখন বললেন, ‘রোগ সংক্রমিত হয় না,’ তখন একজন লোক বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মরুভূমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ উট বিচরণ করে। উটগুলোর কাছে যখন একটি খুজলিযুক্ত উট আসে, তখন সব উটই খুজলিযুক্ত হয়ে যায়।’ তিনি বললেন, ‘প্রথম উটটিকে কে খুজলিযুক্ত করলো?’
উত্তর হলো:— নবী সাঃ এর উক্তি ‘প্রথমটিকে কে খুজলিযুক্ত করলো?’ এর মাধ্যমেই জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগের জীবাণু অসুস্থ ব্যক্তির নিকট থেকে সুস্থ ব্যক্তির নিকট গমন করে থাকে। তাই আমরা বলবো যে, প্রথম উটের উপরে সংক্রামক ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগ নাযিল হয়েছে। কোনো ঘটনার পিছনে কখনো প্রকাশ্য কারণ থাকে। আবার কখনো প্রকাশ্য কোনো কারণ থাকে না। প্রথম উট খুজলিযুক্ত হওয়ার পিছনে আল্লাহর নির্ধারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উট খুজলিযুক্ত হওয়ার কারণ যদিও জানা যাচ্ছে, তথাপি আল্লাহ চাইলে খুজলিযুক্ত হতো না। তাই কখনো খুজলিতে আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভালোও হয়ে যায়। আবার কখনো মারাও যায়। এমনিভাবে প্লেগ, কলেরা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই ঘরের কয়েকজন আক্রান্ত হয়। কেউ মারা যায় আবার কেউ রেহাই পেয়ে যায়। মানুষের উচিৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা।
বর্ণিত আছে যে, ‘একজন কুষ্ঠ রোগী লোক নবী সাঃ এর কাছে আসলো। তিনি তার হাত ধরে বললেন, আমার সাথে খাও।’ রাসূল সাঃ তখন কুষ্ঠরোগীর সাথে বসে খাবার খেয়েছেন আর বলেছেন; “আল্লাহর উপর আস্থা রেখে আল্লাহর নামে খাওয়া শুরু করো।” (তিরমিযী)
এটা তিনি এ জন্য করেছেন যে, কুষ্ঠ রোগীর কাছে গেলেই যে, ঐ রোগে আক্রান্ত হতে হবে তা জরুরি নয়। বরং কখনও হতে পারে আবার কখনও নাও হতে পারে। এটা আল্লাহ ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা থাকার কারণেই তিনি তাকে খানায় শরীক করেছিলেন।”
প্রাচীন কালের সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে একটি বিখ্যাত রোগের নাম ‘অবা’ যাকে ‘তাউনও’ বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, মহামারী, কলেরা প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগ। ইসলামের খেলাফত যুগে হজরত উমর রা. এর শাসনামলে হিজরী ১৮ মোতাবেক ৬৩৯ সালে ‘তাউন আমওয়াস’ নামক মহামারী সিরিয়া, মিশর, ইরাক প্রভৃতি আরব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক মাস ব্যাপী স্থায়ী এ ভয়ানক মহামারীতে পঁচিশ হাজার মুসলমান মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিলেন বলে ইতিহাসে বর্ণিত। এসব মোজাহেদ সৈনিক তৎকালীন বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জয় করার জন্য যথেষ্ট ছিলেন বলেও ইতিহাসের বর্ণনা। এ মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্ণিত দেশগুলোতে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় বিজয়মালার সময় লাখ লাখ রোমক সৈন্য নিহত হয় এবং মুসলমান শহীদানের সংখ্যাও ছিল বিপুল। মুসলমানগণ তাদের লাশগুলো অবিলম্বে দাফন করে ফেলেন। পক্ষান্তরে যুদ্ধে নিহত লাখ লাখ রোমক সৈন্যের লাশ রণাঙ্গণে যত্রতত্র বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকে এবং পচে গলে একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে অবর্ণনীয় দুর্গন্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
‘তাউনে আমওয়াসে’র বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় এ সংক্রামক রোগ নিয়ে। এ সর্ম্পকে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। ১৭ হিজরীতে শুরু হওয়া এ মহামারীর ফলে খলিফা হজরত উমর রা. দামেশক ও সিরিয়ার বিভিন্ন শহর সফর করতে পারেননি। তাকে এ সফর হতে বিরত রাখা হয়। আল্লামা শিবলী নোমানী ঘটনাটি বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:
‘তাউনে আমওয়াস’ ছড়িয়ে পড়ার খবর পেয়ে হজরত উমর রা. প্রথমে এর প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য যাত্রা করেন এবং ‘সারা’ নামক একটি স্থানে পৌঁছেন। তাকে স্বাগত জানাবার উদ্দেশ্যে হজরত আবু উবায়দা রা. প্রথমে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। মহামারী দ্রæত ভয়াবহ রূপ ধারণ করার খবর পেয়ে তিনি মোহাজেরীন ও আনসারগণকে ডেকে তাদের মতামত অবহিত হন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেন। মোহাজেরীন এক বাক্যে বললেন, ‘আমিরুল মোমেনীন! আপনার এখানে অবস্থান করা উচিত হবে না।’ হজরত উমর রা. হজরত আব্বাস রা. কে প্রচার করতে বলেন যে, ‘আগামী কাল যাত্রা।’ তকদীরে কঠোর বিশ্বাসী হজরত আবু উবায়দা রা. অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘আ ফেরারুন মিনকাদরিল্লাহ’, অর্থাৎ “এটা কি ‘তকদীরে এলাহী’ হতে পলায়ন নয়?” হজরত উমর রা. এরূপ কড়া উক্তি হজম করে গেলেন এবং বললেন, ‘নাআম! আফিররু মিন কাযায়িল্লাহি ইলা কাযায়িল্লাহ’, অর্থাৎ হ্যাঁ! “আমি ‘তকদীরে এলাহী’ হতে পালিয়ে তকদীরে এলাহী’র দিকেই পলায়ন করছি।” এরপর খলিফা খোদ মদীনায় চলে আসেন এবং আবু উবায়দা রা. কে লিখলেন যে, ‘তুমি কিছু দিনের জন্য চলে এসো, তোমার সাথে কাজ আছে।’ আবু উবায়দা রা. মনে করলেন যে, মহামারীর ভয়ে তাকে ডাকা হয়েছে। তিনি জবাবে লিখলেন, মুসলমানদেরকে ছেড়ে তিনি আত্মরক্ষার জন্য সেখান থেকে সরে যেতে পারেন না। তকদীরে যা কিছু লেখা আছে তাই হবে। হজরত উমর রা. জবাব পাঠ করে কাঁদলেন এবং তাকে লিখলেন, ‘ফৌজ যেখানে অবতরণ করেছে, তা নিচু ও স্যাঁতস্যাঁতে স্থান, তাই কোনো উত্তম স্থান দেখে সেখানে চলে যাও।’
হজরত আবু উবায়দা রা. খলিফার নির্দেশ অনুাযয়ী মনোরম আবহাওয়ার স্থানে তাঁর সেনাবাহিনী সমেত ‘জাবিয়া’ নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করেন। আমওয়াস মহামারী যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন লোকদেরকে সমবেত করেন এবং এক হৃদয়গ্রাহী ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, তাতে মূল্যবান উপদেশ ছিল। হজরত মাআজ ইবনে জাবাল রা. কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। যেহেতু জোহরের নামাজের সময় ছিল, তাই তিনি হজরত মাআজ রা. কে নামাজ পড়াতে বলেন। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে হজরত আবু উবায়দা রা. ইন্তেকাল করেন। মহামারী এতই মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে, সৈন্যদের মধ্যে দারুণ বিশৃংখলা দেখা দেয়। এ সময় হজরত আমর ইবনুল আস রা. লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এ মহামারী ও বালাগুলো বনি ইসরাইলের উপরও নাজেল হয়েছিল। তাই এখান হতে সরে যাওয়া উচিত।’ তার বক্তব্য শুনে হজরত মাআজ রা. মিম্বরে উঠে ভাষণ প্রদান করেন এবং বলেন, ‘এটি মহামারী নয়, আল্লাহর রহমত।’ খুতবা শেষে তিনি শিবিরে আগমন করেন, তখন দেখতে পান যে, তার ছেলে অসুস্থ। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘ইয়া বুনাইয়া! আল হক্কু মির রাব্বিকা ফালা তাকুনান্না মিনাল মোমতারীন।’ অর্থাৎ ‘হে বৎস! এটাকে আল্লাহর পক্ষ হতে দেখ, সন্দেহ পোষণকারীদের মধ্যে হবে না।’ ছেলে এর জবাবে বললেন, ‘সাতা জিদুনি ইনশাআল্লাহু মিনাসসাবেরীন’ অর্থাৎ ‘আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ এ কথা বলে ছেলে ইন্তেকাল করেন। ছেলের দাফন কাজ শেষ করে আসার পথে হজরত মাআজ রা. অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি হজরত আমর ইবনুল আস রা. কে তার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং ইন্তেকাল করেন। ‘তাউনে আমওয়াস’ মহামারীকে হজরত মাআজ ইবনে জাবাল রা. আল্লাহর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই তিনি এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
কিন্তু হজরত আমর ইবনুল আস রা. মাআজ রা. এর ইন্তেকালের পর দায়িত্বভার গ্রহণ করে সাধারণ সভা ডেকে ভাষণ দেন এবং বলেন যে, মহামারী যখন শুরু হয়েছিল তখন আগুনের ন্যায় বিস্তার লাভ করতে থাকে। তাই সকল সৈন্যকে এখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে পর্বত মালায় চলে যাওয়া উচিত। এতে মতভেদ সত্তেও হজরত আমর ইবনুল আস রা. সৈন্যদেরকে নিয়ে পর্বত মালায় উঠে যান। অতঃপর মহামারীর আশংকা দূর হয়ে যায়।
বাস্তবতা হচ্ছে যে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত হওয়া একটি বাস্তব বিষয়। তবে সংক্রমনের এই ক্ষমতা রোগের নিজস্ব নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত। রোগ-ব্যাধী নিজে নিজে সংক্রমিত হয় না যদি আল্লাহর হুকুম না থাকে। তাই তিনি চাইলে সংক্রমণ হবে নতুবা হবে না। আর এটি যেহেতু রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি বাস্তব কারণ তাই রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ থেকে বেঁচে থাকতে যেমনিভাবে কোনো দোষ নেই তেমনি এক্ষেত্রেও উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা দোষের কিছু নয়। বরং কিছু হাদীসে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করাই শ্রেয়।