শেষ বিকেলে ছন্দপতন -হুসাইন আহমদ মিসবাহ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১২ ২০২০, ২০:০৬

একটা বয়সে উপনীত হলে মানুষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। মস্তিষ্ক যথার্থ কাজ করেনা। শারীরিক সামর্থ প্রায় চলে যায়। অন্যের সাহায্য ব্যতিত চলতে পারেন না। স্বভাবত আন্দোলিত হন অন্যের দ্বারা।

কেউ নিজ যোগ্যতা ও কর্মগুনে অগাধ আস্তা ও বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন। কিন্তু কারোর ক্ষেত্রে জীবনের শেষ বিকেলে ছন্দপতন ঘটে। কাছের মানুষ তাঁর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে। মিসডগাইড করে তাঁকে সমালোচনার পাত্রে পরিণত করে। এমনি ৩জন শীর্ষ আলেমের কথা বলতেই আজকের প্রয়াস।

এক: আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফিজ্জী হুজুর রাহিমাহুল্লাহ।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জল নক্ষত্র, আলেম সমাজের অহংকার আল্লামা হাফিজ্জী হুজুর রাহিমাহুল্লাহ। আমাদের জানামতে তিনি দেশের একমাত্র আলেম, যিনি এরশাদ সাহেবের সাথে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদন্ধিতা করেছিলেন। সে সময় দেশে প্রেসিডেন্টশীপ গণতন্ত্র চালু ছিল। শীর্ষ রাজনীতিবিদের পাশাপাশি তিঁনি একজন বড়মাপের আলেম ও পীর ছিলেন। অগনন আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ উনার ছাত্র ও মুরিদ ছিলেন। তিঁনিই দেশে “তাওবার রাজনীতি” শুরু করেছিলেন। সে সময়ের গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ইসলামি সংগঠন “বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন” এর আমীর ছিলেন তিঁনি। সার্বিক বিবেচনায় তিঁনিই ছিলেন সে সময়ে দেশের শীর্ষ আলেম। কিন্তু আফসুস! তিঁনি যখন জীবনের শেষ বিকেলে উপনীত হন, স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, তখন উনার ছাজেবজাদা ও কাছে লোকেরা তাঁকে মিসডগাইড করে। বয়সিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, নিজ স্বার্থে বা হীণস্বার্থে উনার মাধ্যমে ভুল সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করান, বা বাধ্য করেন। ফলে তাঁর অনেক শিষ্য, ভক্ত, অনুরক্তরা উনার সংস্পর্শ ত্যাগ করেন। সারা জীবনের অর্জিত জনপ্রিয়তা ও গ্রনণযোগ্যতা বিলিন হয়ে যায়। নিরঙ্কুশ আস্তার প্রতীক হাফেজ্জী হুজুর রাহিমাহুল্লাহ পরিণত হন সমালোচনার পাত্রে। অনিবার্য ফল হিশেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে কবরে যেতে পারেননি। শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন উনার অধিন খেলাফত আন্দোলনের একজন সিনিয়ার দায়িত্বশীল। সে সময় শায়খুল হাদীসসহ বেশ কিছু শীর্ষ নেতারা হাফিজ্জী হুজুরের সংস্পর্শ ত্যাগ করে দল থেকে বেরিয়ে আসেন।

দুই: শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ।
বাংলাদেশের ইলমী ও রাজনীতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি নাম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ। বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদক আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ যেভাবে ছিলেন হাজার হাজার আলিম-উলামার উস্তাদ, সেভাবে ছিলেন একজন সফল জাতীয় রাজনীতিবিদ। তিঁনি সর্ব প্রথম এই দেশের ত্রিমুখী শিক্ষায় শিক্ষিতদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে এসে “খেলাফত মজলিস” নামক সার্বজনীন ইসলামী দল গঠন করতে অগ্রণি ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে বাংলাদেশে লংমার্চ হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বই তুমুল আন্দোলনে নাস্তিক ‘তাসলিমা’ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এরকম অসংখ আন্দোলনের সফল নেতৃত্ব দিয়ে আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ আলেম-উলামাসহ আপামর জনতার হৃদয়ে সম্মান ও আস্তার শীর্ষস্থানে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ বিকেলে এসে উনারও গ্রহণযোগ্যর ছন্দপতন ঘটে। তখন তিঁনি খেলাফত মজলিসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আমীর ছিলেন।  বার্ধক্যে উপনীত হবার পর উনার ছাহেবজাদা ও কাছের লোকেরা তাঁকে মিসডগাইড করে। ফলে তাঁর সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে দলের নায়বে আমির অধ্যক্ষ মাওলানা ইছহাক, শায়খুল হাদীস আল্লামা শওকত আলী, অধ্যাপক আখতার ফারুক, অধ্যাপক ডক্টর আহমদ আব্দুল কাদের, প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যক্ষ মাসুদ খান, মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারীসহ প্রায় ৮৫% নেতা কর্মী উনার সংস্পর্শ ত্যাগ করে দল থেকে বেরিয়ে আসেন। এক শ্রেণির মানুষের কাছে এই মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব হয় সমালোচিত। কিছু দিনের ব্যবধানের তাঁর দলের লোকেরাই তাঁকে আমীর থেকে অব্যাহতি দেয়। যার জন্য তিঁনিও অর্জিত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে কবরে যেতে পারেননি।

তিন: আল্লামা আহমদ শফি দামাত বারাকাতুহুম।
বাংলাদেশের দেশের ইতিহাসে আরেক অবিস্মরণীয় নাম, আলেম সমাজের গর্ব, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি দামাত বারাকাতুহুম। দেশের সর্ববৃহৎ কওমি মাদরাসা ‘হাটহাজারী’র মহা পরিচালক আল্লামা শফিকে দেশজ জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে আসীন করে হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালে হেফাজত বাংলাদেশে যে জনজোয়ারের চমক দেখিয়েছে, দেশের ইতিহাসে তা বিরল। ফলে নিমিষেই আমীরে হেফাজত আল্লামা শফি দামাত বারাকাতুহুম উঠে যান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রধামমন্ত্রীর থেকে দাওয়াত পান গণভবনে। বসেন প্রধানমন্ত্রীর পাশে। বক্তব্যের প্রাক্কালে সয়ং প্রধানমন্ত্রী পিতৃতুল্য এই প্রবীণ আলেমের মাইক্রোফোন ঠিক করে দেন। বিনাবাক্যে সবাই উনাকে দেশের শীর্ষ আলেম হিশেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু বর্তমানে শেই বিপদজনক শেষ বয়সের সুবাদে উনার ছাহেবজাদাসহ কাছে লোক উনাকেও বিতর্কিত করে ফেলেছে। উনার আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তায় গ্রহণ লাগিয়েছে। কষ্ট লাগে যখন দেখি, যারা শফি সাহেবের প্রসংশায় পঞ্চমুখ ছিল, তাদেরই কেউ কেউ আজ উনার সমালোচনা করছে। জানিনা, তিনি নিজের হারানো সম্মান ফিরে পাবেন কি না?

বাস্তবে এই ৩জন শীর্ষ আলেমের ছন্দপতনে উনারা দায়ী নন। তাদের একান্ত কাছের মানুষ তাঁদের বার্ধক্যের সুযোগ নিয়েই এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আল্লাহ প্রথম দুইজনকে জান্নাতে উচু মাকাম দান করুন এবং তৃতীয় জনকে হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিন।