শরিয়াহ’র আলোকে বিবাহের বিধান
একুশে জার্নাল
আগস্ট ৩০ ২০২০, ২০:৫৩
মুফতি আহমদ যাকারিয়া
সৃষ্টিগতভাবেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী ছাড়া পুরুষ আর পুরুষ ছাড়া নারীর জীবন মরুবালুর চর। হতাশার অতল সাগরে হাবুডুবু খায় পুরুষ ছাড়া নারী আর নারী ছাড়া পুরুষ। এ কারণেই তো পৃথিবীর প্রথম মানব আদম আঃ চরম ঔদাসীন্য ও অতৃপ্তিতে ভুগছিলেন অনিন্দ অতুলনীয় সুখের বাসর জান্নাতে থেকেও। সেই চরম অতৃপ্তি ও ঔদাসীন্য দূর করার লক্ষ্যে তাঁর জীবন সঙ্গিনীরূপে সৃষ্টি করলেন আল্লাহ্ হাওয়া আঃ কে। আবদ্ধ করলেন বিয়ের বন্ধনে। অতৃপ্ত আদম তৃপ্ত হলেন। দূর হলো সকল ঔদাসীন্যতা। শুরু হলো নর-নারীর বৈধ যুগল বাঁধনে তথা বিয়ের সূত্রে মানবজীবন।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “হে মানবগোষ্ঠী! তোমরা ভয় কর তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে আর তাঁর থেকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্ত্রীকে এবং তাদের দু’জন থেকে সৃষ্টি করেছেন অগনন নর-নারী।” (নিসা:১)
বিয়ে মূলত একজন সুস্থ মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন। উপরন্তু মানুষের স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা, মানসিক ভারসাম্য, চারিত্রিক উৎকর্ষতা ও পবিত্রতার অন্যতম উপায় বিয়ে। ফিতরাতের ধর্ম ইসলামও এর গুরুত্ব দিয়েছে অপরিসীম।
বিয়ের পরিচয়:
বাংলা বিয়ে শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো নিকাহ; যার আভিধানিক অর্থ হলো দলিত করা, বন্ধন, সংযুক্ত করা।
ইসলামী পরিভাষায় ইচ্ছাকৃতভাবে একজন পুরুষের একজন নারীর গুপ্তাঙ্গসহ সারাদেহ ভোগ করার বন্ধনকে বিয়ে বলে।
(রদ্দুল মহতার: ৪/৫৭-৬০; কিতাবুল ফিকাহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ: ৪/১)
বিয়ে সম্পাদিত হতে হবে দু’জন স্বাধীন, বিবেকবান প্রাপ্তবয়স্ক ও মুসলমান পুরুষ অথবা এ সকল গুণে গুণান্বিত একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষীর উপস্থিতিতে বর কিংবা কনে পক্ষের ইজাব তথা প্রস্তাব আর অপর পক্ষের কবুলের মাধ্যমে। এই প্রস্তাব ও কবুল সাক্ষীগণ শ্রবণও করতে হবে। এর বিপরীতে কোন পদ্ধতিতে বিয়ে সম্পাদিত হলে তা বিশুদ্ধ হবে না।
(হিদায়া:২/২৮৫; রদ্দুল মুহতার:৪/৬৯, ৮৬-৯২)
ইসলামে বিয়ের রুকন তিনটি:
এক:
বিয়ে সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমূহ প্রতিবন্ধকতা হতে বর-কনে উভয়ে মুক্ত হওয়া। যেমন- বর-কনে পরস্পর মোহরিম হওয়া; ঔরশগত কারণে হোক অথবা দুগ্ধপানের কারণে হোক। বর কাফের কিন্তু কনে মুসলিম হওয়া, ইত্যাদি।
দুই:
ইজাব বা প্রস্তাবনা: এটি মেয়ের অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে পেশকৃত প্রস্তাবনামূলক বাক্য। যেমন- বরকে লক্ষ্য করে বলা যেতে পারে “আমি অমুককে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম” অথবা এ ধরনের অন্য কোন কথা।
তিন:
কবুল বা গ্রহণ: এটি বর বা বরের প্রতিনিধির পক্ষ থেকে সম্মতিসূচক বাক্য। যেমন- বর বলতে পারেন “আমি গ্রহণ করলাম” অথবা এ ধরনের অন্য কোন কথা।
বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্তগুলো নিম্নরূপ:
(১) ইশারা করে দেখিয়ে দেয়া কিংবা নামোল্লেখ করে সনাক্ত করা অথবা গুণাবলী উল্লেখ অথবা অন্য কোন মাধ্যমে বর-কনে উভয়কে সুনির্দিষ্ট করে নেয়া।
(২) বর-কনে প্রত্যেকে একে অপরের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া। এর দলীল হচ্ছে-নবী সাঃ বাণী “স্বামীহারা নারী (বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা) কে তার সিদ্ধান্ত জানা ছাড়া (অর্থাৎ সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে চাওয়া হবে এবং তাকে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে) বিয়ে দেয়া যাবে না এবং কুমারী মেয়েকে তার সম্মতি ছাড়া (কথার মাধ্যমে অথবা চুপ থাকার মাধ্যমে) বিয়ে দেয়া যাবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কেমন করে তার সম্মতি জানব (যেহেতু সে লজ্জা করবে)। তিনি বললেন, চুপ করে থাকাটাই তার সম্মতি।”
(বুখারী- ৪৭৪১)
(৩) বিয়ের আকদ (চুক্তি) করানোর দায়িত্ব মেয়ের অভিভাবককে পালন করতে হবে। যেহেতু আল্লাহ তাআ’লা বিয়ে দেয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি নির্দেশনা জারী করেছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন: “আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী-পুরুষদের বিবাহ দাও।” (নুর, ২৪:৩২)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যে নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল।”
(হাদিসটি তিরমিযি (১০২১) ও অন্যান্য গ্রন্থকার কর্তৃক সংকলিত এবং হাদিসটি সহীহ)
(৪) বিয়ের আকদের সময় সাক্ষী রাখতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “অভিভাবক ও দু’জন সাক্ষী ছাড়া কোন বিবাহ নেই।”
[তাবারানী কর্তৃক সংকলিত, সহীহ জামে (৭৫৫৮)]
বিয়ের প্রচারণা নিশ্চিত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলেন; “তোমরা বিয়ের বিষয়টি ঘোষণা কর।”
(মুসনাদে আহমাদ হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলা হয়েছে ১০৭২)
বিয়ের অভিভাবক হওয়ার জন্য শর্তঃ
১. সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
৩. দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হওয়া।
৪.অভিভাবককে কনের ধর্মের অনুসারী হওয়া। সুতরাং কোন অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম নর-নারীর অভিভাবক হতে পারবে না। অনুরূপভাবে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম নর-নারীর অভিভাবক হতে পারবে না। তবে অমুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম নারীর অভিভাবক হতে পারবে, যদিও তাদের উভয়ের ধর্ম ভিন্ন হোক না কেন। কিন্তু মুরতাদ ব্যক্তি কারো অভিভাবক হতে পারবে না।
৫. আদেল বা ন্যায়বান হওয়া। অর্থাৎ ফাসেক না হওয়া। কিছু কিছু আলেম এ শর্তটি আরোপ করেছেন। অন্যেরা বাহ্যিক আদালতকে (দ্বীনদারিকে) যথেষ্ট ধরেছেন। আবার কারো কারো মতে, যাকে তিনি বিয়ে দিচ্ছেন তার কল্যাণ বিবেচনা করার মতো যোগ্যতা থাকলেই চলবে।
৬.পুরুষ হওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী- “এক মহিলা আরেক মহিলাকে বিয়ে দিতে পারবে না। অথবা মহিলা নিজে নিজেকে বিয়ে দিতে পারবে না। ব্যভিচারিনী নিজে নিজেকে বিয়ে দেয়।” (ইবনে মাজাহ- ১৭৮২;)
৭. বুদ্ধিমত্তার পরিপক্কতা থাকা। এটি হচ্ছে বিয়ের ক্ষেত্রে সমতা (কুফু) ও অন্যান্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করতে পারার যোগ্যতা।
ইসলামী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণ অভিভাবকদের একটি ক্রমধারা নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং নিকটবর্তী অভিভাবক থাকতে দূরবর্তী অভিভাবকের অভিভাবকত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। নিকটবর্তী অভিভাবক না থাকলে অথবা তার মধ্যে শর্তের ঘাটতি থাকলে দূরবর্তী অভিভাবক গ্রহণযোগ্য হবে।
নারীর অভিভাবক হচ্ছে- তাঁর পিতা। এরপর পিতা যাকে দায়িত্ব দিয়ে যান সে ব্যক্তি। এরপর পিতামহ, যতই উপরের দিকের হোক। এরপর তাঁর সন্তান। এরপর তাঁর সন্তানের সন্তানেরা, যতই অধস্তন হোক। এরপর তাঁর সহোদর ভাই। এরপর তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই। এরপর এ দুই শ্রেণীর ভাইয়ের সন্তানেরা। এরপর তাঁর সহোদর শ্রেণীর চাচা। এরপর বৈমাত্রেয় শ্রেণীর চাচা। এরপর এ দুই শ্রেণীর চাচার সন্তানেরা। এরপর মীরাছের ক্ষেত্রে যারা ‘আসাবা’ হয় সে শ্রেণীর আত্মীয়গণ। এরপর নিকটাত্মীয় থেকে ক্রমান্বয়ে দূরের আত্মীয়। যার কোন অভিভাবক নেই মুসলিম শাসক অথবা শাসকের প্রতিনিধি (যেমন বিচারক) তার অভিভাবক।
ইসলামে বিয়ের ফজিলত:
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও চিকিৎসা যেভাবে মানব জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন, শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেভাবে যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে; একজন যৌবনদীপ্ত মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য বিয়ের অপরিহার্যতাও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফজিলত ও মর্যাদা তুলনাহীন।
কুরআনে আল্লাহ বলেন- “আপনার পূর্বে প্রেরণ করেছি অনেক রাসূল এবং তাদের দিয়েছি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি।”
(রাদ:৩৮)
আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন- নবী সা. ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি পূত-পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়, সে যেন বিয়ে করে স্বাধীন নারীকে।
(ইবনে মাজাহ:১৩৫)
অন্য এক বর্ণনায় আনাস রা. বলেন, নবী সা. ইরশাদ করেছেন- কোন ব্যক্তি যখন বিয়ে করল তখন সে যেন দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করে ফেলল। এখন সে যেন বাকি অর্ধাংশের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে।” (মিশকাত:২/২৬৮)
আবু আইয়ুব আনসারী রা. এর বর্ণনায় এসেছে নবী সা. বলেছেন- “নবী-রসূলগণের চারটি সুন্নাত রয়েছে। সেগুলো হলো
১. লজ্জাবোধ,
২. সুগন্ধি ব্যবহার,
৩. মিসওয়াক করা,
৪. বিয়ে করা।”
(তিরমিযী:১/১২৮)
মানুষ মানবিক প্রাকৃতিক চাহিদার কারণেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অথচ ইসলাম বলেছে বিয়ে আর্থিক সচ্ছলতার কার্যকর উপায়। কখনো বলেছে, পবিত্রতার কার্যকর মাধ্যম। আবার কখনো বলেছে দ্বীনের অর্ধেক। কখনোবা আখ্যায়িত করেছে আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যম হিসেবে। এত ফজিলত ও মর্যাদার কথা অন্য কোন ইবাদত সম্পর্কে বলা হয়নি। কারণও আছে। কেননা সকল ইবাদত বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণরূপে আদায়ের জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক শুদ্ধতা, পবিত্রতা এবং স্থিতিশীলতা। যার অনেকটাই নির্ভর করে বিয়ের উপর।
বিয়ে করা কখন সুন্নাত?
যদি মোহর, ভরণ-পোষণ প্রদান এবং বৈবাহিক অধিকার পূরণ করতে সক্ষম হয় এবং যৌন উত্তেজনা খুব বেশি বিজয়ী না হয়, তবে বিয়ে করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এমতাবস্থায় বিয়ে না করে বসে থাকা গুনাহ। যদি হারাম থেকে বাচঁতে বা সুন্নাতের অনুসরণ বা সন্তান লাভের উদ্দেশ্য হয়, তবে সাওয়াবও পাবে। আর যদি শুধুমাত্র স্বাদ গ্রহণ অথবা যৌন উত্তেজনা মিটানোর উদ্দেশ্য হয় তবে সাওয়াব পাবে না। যদিও এতে বিয়ে হয়ে যাবে।
(বাহারে শরীয়াত, কিতাবুন নিকাহ, ৭ম খন্ড, ৫৫৯ পৃষ্ঠা)
লোকের জন্য কখনো বিয়ে করা ফরয আবার কখনো বিয়ে করা হারামও হয়:
বিয়ে কখনো ফরয, কখনো ওয়াজিব, কখনো মাকরুহ, আবার অনেক সময় হারামও হয়ে থাকে। যদি নিশ্চিত হয় যে, বিয়ে না করার কারণে যেনায় লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে বিয়ে করা ফরয। এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে না করলে গুনাহগার হবে। যদি মোহর ও ভরণপোষণ প্রদানে সামর্থ্য থাকে এবং অতিরিক্ত যৌন উত্তেজনার কারণে যেনা, কুদৃষ্টি বা হস্তমৈথুনে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে এই পরিস্থিতিতে বিয়ে করা ওয়াজিব। যদি এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে না করে তবে গুনাহগার হবে। আর যদি এই আশংকা হয় যে, বিয়ে করার পর ভরণপোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদী পূর্ণ করতে পারবে না, তবে এই পরিস্থিতিতে বিয়ে করা মাকরুহ। আর যদি এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, বিয়ে করার পর ভরণপোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পূরণ করতে পারবে না, তবে বিয়ে করা হারাম এবং জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ।
(এমন পরিস্থিতিতে যৌন উত্তেজনা দমন করার জন্য রোযা রাখার অভ্যাস গড়বে।)
(বাহারে শরীয়াত কিতাবুন নিকাহ, ৭ম খন্ড,- ৫৫৯)
কোন বয়সে বিবাহ করা উত্তম?
বিবাহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন বয়সের কথা ইসলাম বলেনি। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
ﻳَﺎﻣَﻌْﺸَﺮَ ﺍﻟﺸَّﺒَﺎﺏِ ﻣَﻦِ ﺍﺳْﺘَﻄَﺎﻉَ ﻣِﻨْﻜُﻢُ ﺍﻟْﺒَﺎﺀَﺓَ ﻓَﻠْﻴَﺘَﺰَﻭَّﺝْ، ﻓَﺈِﻧَّﻪُﺃَﻏَﺾُّ ﻟِﻠْﺒَﺼَﺮِ ﻭَﺃَﺣْﺼَﻦُ ﻟِﻠْﻔَﺮْﺝِ ﻭَﻣَﻦْ ﻟَﻢْ ﻳَﺴْﺘَﻄِﻊْ ﻓَﻌَﻠَﻴْﻪِﺑِﺎﻟﺼَّﻮْﻡِ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻟَﻪُ ﻭِﺟَﺎﺀٌ
হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিবাহ করা উচিত। কেননা বিবাহ হলো দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা পালন করে। কেননা রোজা হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।
(বুখারী ৫০৬৫; মুসলিম ১৪০০)
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, কোন ব্যক্তি সামর্থ্যবান হলেই বিয়ে করে নেয়া উচিত। আর যেহেতু ব্যক্তি হিসেবে শক্তি সামর্থ্য ভিন্ন হয়ে থাকে; অনেকে অল্প বয়সেই সামর্থ্যবান হয়ে যায়, অনেকের একটু সময় লাগে, তাই যৌক্তিকতার দাবী হলো যে, এর জন্য বয়স ঠিক না করা। এজন্য ইসলামে বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়নি।
তবে হ্যাঁ, ছেলে-মেয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে দেরি করা ঠিক নয়। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
من وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَلْيُحْسِنِ اسْمَهُ وَأَدَبَهُ فَإِذَا بَلَغَ فَلْيُزَوِّجْهُ فَإِنْ بَلَغَ وَلَمْ يُزَوِّجْهُ فَأَصَابَ إِثْمًا فَإِنَّمَا إثمه على أَبِيه
তোমাদের মাঝে যার কোন (পুত্র বা কন্যা) সন্তান জন্ম হয়, সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়; যখন সে বালেগ অর্থাৎ সাবালক/সাবালিকা হয়, তখন যেন তার বিয়ে দেয়; যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিয়ে না দেয়, তাহলে সে কোন পাপ করলে উক্ত পাপের দায়ভার তার পিতার উপর বর্তাবে। (বায়হাকি-৮১৪৫)
আর ছেলে-মেয়ের বয়সের মাঝে বেশি পার্থক্য থাকা উচিত নয়; বরং বয়সের পার্থক্য কম থাকা উত্তম। এটা বুঝা যায় হযরত ফাতিমা রাযি. এর বিয়ের দিকে তাকালে। তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব আবু বকর রাযি. এবং উমর রাযি. ও দিয়েছিলেন। যাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা ছিলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। কিন্তু রাসূল সাঃ তাঁদের কাছে কম বয়সী ফাতিমা রাযি.-কে বিবাহ দেননি। দিয়েছেন কাছাকাছি বয়স্ক হযরত আলী রাযি. এর সাথে।
(মওসূআ’তু হায়াতুস সাহাবিয়্যাত ৬২১)
দু’টি হাদীসের প্রায়োগিক ব্যাখ্যা:
দু’টো হাদিস আছে বিবাহ সম্পর্কিত; হাদীস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি এই দু’টি হাদীস পড়লে মনে করবে যে, হাদিসদ্বয় সম্ভবত সাংঘর্ষিক।
এক: “হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে তার উচিত বিয়ে করা”।
দুই: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক মহিলাকে এক গরীব লোকের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন।”
প্রথম হাদিস বলছে: পুরুষের বিয়ের জন্য আর্থিকভাবে প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক; যাতে করে স্ত্রীর খরচ চালাতে পারে।
আর দ্বিতীয় হাদিস বলছে; তিনি এক গরীব লোককে বিয়ে করিয়েছেন, যে কোন সম্পদের মালিক নয়।
প্রথম হাদীসটি ইমাম বুখারী (৫০৬৬) ও ইমাম মুসলিম (১৪০০) ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কিছু যুবক ছিলাম, যাদের কিছুই ছিল না। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্য রাখ তাদের উচিত বিয়ে করে ফেলা। কেননা বিয়ে দৃষ্টি অবনতকারী ও লজ্জাস্থানকে হেফাযতকারী। আর যার সামর্থ্য নেই তার উচিত রোযা রাখা। কেননা রোযা যৌন উত্তেজনা প্রশমনকারী।”
দ্বিতীয় হাদিসটি হচ্ছে; সাহল বিন সা‘দ রাঃ হতে বর্ণিত আছে যে, একদা এক মহিলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললো: হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার নিজেকে আপনার জন্য উপহার দিতে এসেছি (পরোক্ষ ভাষায় বিয়ের প্রস্তাব)। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে মাথা নিচু করলেন। মহিলাটি যখন দেখল যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ফয়সালা দিচ্ছেন না, তখন সে বসে পড়লো। এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের একজন বললেন, যদি আপনার কোন প্রয়োজন না থাকে, তবে এ মহিলাটির সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিন। তিনি বললেন, তোমার কাছে কি কিছু আছে? সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম, কিছুই নেই। তিনি বললেন: তুমি তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাও এবং দেখ কিছু পাও কিনা? এরপর লোকটি চলে গেল এবং ফিরে এসে বললো: আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কিছুই পেলাম না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: দেখ, একটি লোহার আংটি হলেও পাও কিনা! তারপর সে চলে গেল এবং ফিরে এসে বললো: আল্লাহর কসম, একটি লোহার আংটিও পেলাম না। কিন্তু এই যে আমার লুঙ্গি আছে। সাহল রাঃ বলেন, তার কোন চাদর ছিল না। অথচ লোকটি বললো: এটাই আমার পরনের লুঙ্গি; এর অর্ধেক দিতে পারি। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার লুঙ্গি দিয়ে সে কি করবে? তুমি পরিধান করলে তার গায়ে কোন কিছু থাকবে না। আর সে পরিধান করলে তোমার গায়ে কোন কিছু থাকবে না। তখন লোকটি বসে পড়লো এবং অনেকক্ষণ সে বসেছিল। তারপর উঠে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফিরে যেতে দেখে ডেকে আনলেন। যখন সে ফিরে আসল, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কতটুকু কুরআন মুখস্থ আছে? সে বলল, অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি এ সকল সূরা মুখস্থ তিলাওয়াত করতে পার? সে বলল: হ্যাঁ! তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যাও তুমি যে পরিমাণ কুরআন মুখস্থ করেছ এর বিনিময়ে এই মহিলার সাথে তোমার বিবাহ দিলাম।
(বুখারী – ৫০৩০; মুসলিম – ১৪২৫)
এ হাদিসদ্বয় সাংঘর্ষিক নয়। বরং প্রত্যেকটি হাদিসই এর যথোপযুক্তস্থানে উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাঃ এর হাদীসে সাধারণভাবে সকল যুবক ও বিয়েতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান উদ্ধৃত হয়েছে; এ কথা বর্ণনা করার জন্য যে, বিয়ের জন্য খরচের সামর্থ্য থাকা ও যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়; যাতে করে স্বামী তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও বাসস্থানের ফরয দায়িত্ব পালন করতে পারে।
الباءة (সামর্থ্য)
এর মানে হচ্ছে বিয়ের খরচাদি। তাই শরিয়তপ্রণেতা এ মূল বিধানটি বর্ণনা করতে চাইলেন। সেটা হলো যে, বিয়েটা শুধু নিছক একটি আকদ (চুক্তি) ও বৈধভাবে যৌন চাহিদাপূরণ নয়। বরং বিয়ে একটি দায়িত্ব-কর্তব্য ও নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব।
“এবং হাদীসটি এই প্রমাণও বহন করে যে, যে ব্যক্তি বিয়ে করতে অপারগ তার জন্য রোযা রাখায় মশগুল থাকার বিধান রয়েছে। কেননা রোযা যৌন উত্তেজনাকে দুর্বল করে এবং শয়তানের চলাচলকে সংকোচিত করে। তাই রোযা হচ্ছে- চরিত্র ঠিক রাখা ও দৃষ্টিকে অবনত রাখার মাধ্যম।”
[মাজমু ফাতাওয়া বিন বায (৩/৩২৯)]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্য রাখ তাদের উচিত বিয়ে করে ফেলা।” এ দলিলও রয়েছে যে, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে ও বিয়ের খরচাদি বহন করার ক্ষমতা আছে তার জন্যে অবিলম্বে বিয়ে করাটাই শরিয়তের বিধান।
“বিয়ের খরচাদি বহন ও স্ত্রীর অধিকার আদায়ে সক্ষম যুবকের অবিলম্বে বিয়ে করাই রাসূলের সুন্নত।”
[ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ-দায়িমা (৬/১৮)]
পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় হাদীসটি বিশেষ একটি ঘটনাকেন্দ্রিক এবং দরিদ্র এক ব্যক্তির বিয়ে করা ও চরিত্র রক্ষা করা সংক্রান্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ঐ নারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, যে নারী নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উপহার হিসেবে পেশ করেছিলেন। এ হাদিসে দলিল রয়েছে যে, দরিদ্রতা সত্তাগতভাবে বিবাহকে বাধা দেয় না; যদি পাত্র দ্বীনদার হয় এবং নিজ প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাসী হয় এবং পাত্রীও সেরকম হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন: “তোমাদের মধ্যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর, তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য তাদেরও। তারা যদি দরিদ্র হয় তাহলে আল্লাহ্ই নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ্ মহা দানশীল, মহাজ্ঞানী।” (নূর : ৩২)
সুতরাং আল্লাহ্র উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল, চরিত্র রক্ষার আকাঙ্ক্ষা, আল্লাহ্র অনুগ্রহ প্রত্যাশা থাকলে আশা করা যায় এমন দম্পতিকে আল্লাহ্ সাহায্য করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে রিযিক দিবেন। যেমনটি তিরিমিযিতে (১৬৫৫) আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহ্র দায়িত্বে:
এক- আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদকারী,
দুই- এমন মুকাতাব দাস (মালিককে নিজের মূল্য পরিশোধ করে স্বাধীন হতে ইচ্ছুক) যে পরিশোধ করতে ইচ্ছুক।
তিন- এমন বিবাহকারী, যে চরিত্র রক্ষা করতে ইচ্ছুক।”
ইমাম বুখারী এ হাদীসটির শিরোনাম দিয়েছেন এই বলে: “অভাবীর কাছে বিয়ে দেওয়া”। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “তারা যদি দরিদ্র হয় আল্লাহ্ই নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দিবেন”। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন: “তিনি যে শিরোনাম দিয়েছেন সেটার পক্ষে কারণ হিসেবে আল্লাহ্র বাণী: “তারা যদি দরিদ্র হয় আল্লাহ্ই নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দিবেন” কে পেশ করেছেন। এর সারকথা হচ্ছে- বর্তমানে কারো দরিদ্র অবস্থা তার কাছে বিয়ে দেয়ার পথে বাধা নয়; যেহেতু ভবিষ্যতে তার সম্পদ অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
আলী বিন আবু তালহা, ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেন: “আল্লাহ্ তাদেরকে বিয়ে দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি স্বাধীন ও দাস সবাইকে বিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে স্বাবলম্বী করে দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেছেন: “তারা যদি দরিদ্র হয় আল্লাহ্ই নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দিবেন।”
ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “তোমরা বিয়ে করার মাধ্যমে স্বাবলম্বন সন্ধান কর”।[তাফসিরে ইবনে কাছির (৬/৫১)]
শাইখ বিন বায রহঃ বলেন:
এই আয়াতে আল্লাহ্ পাক যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদেরকে এবং সৎ ও যোগ্য দাস-দাসীদের কাছে বিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, এটি গরীবদের সচ্ছলতার মাধ্যম, যাতে করে পাত্রী ও পাত্রীর অভিভাবকগণ নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, দারিদ্র বিয়ের পথে বাধা হওয়া অনুচিত। বরং বিয়ে রিযিক হাছিল ও স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম।”
[‘ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা’ (৩/২১৩)]
এ কারণে সামর্থ্যবানকে বিয়ে করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার অর্থ এ নয় যে, সামর্থ্যহীনকে বিয়ে করতে বারণ করা; বিশেষত কেউ যদি নিজের ব্যাপারে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশংকা করে।
অনুরূপভাবে সামর্থ্যহীনকে যৌন উত্তেজনা দমিয়ে রাখা ও শান্ত করার জন্য রোযা রাখার দিক-নির্দেশনা দেওয়ার মধ্যেও বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। হতে পারে সে এমন কাউকে পাবে, যিনি তাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন। হতে পারে সে এমন কোন পাত্রীকে পাবে, যে পাত্রী তার দ্বীনদারি ও সৎ হওয়ার কারণে তার আর্থিক অবস্থাকে মেনে নেবে। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, এক প্রথা থেকে অপর প্রথাতে পার্থক্য হয়। পক্ষান্তরে, ইবনে মাসউদ রাঃ এর হাদিসে যা উদ্ধৃত হয়েছে সেটা হচ্ছে- সাধারণ একটা শিষ্টাচার এবং সামর্থ্যহীনকে রোযা রাখার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করার পরামর্শ। আর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার কোন উপায় পায় তাতে কোন অসুবিধা নেই। বরং তাকে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করা হবে। ঠিক এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আর যার সামর্থ্য নেই” তার ক্ষেত্রে তিনি এ কথা বলেননি যে, ‘তার উচিত বিয়ে না করা’। বরং তিনি বলেছেন: “তার উচিত রোযা রাখা”; যাতে করে সে গুনাহতে লিপ্ত না হয়। আর যদি কিছু কষ্ট-ক্লেশ করে হলেও সে বিয়ে করতে পারে নিঃসন্দেহে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ রোযাকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে একেবারে অপারগতার ক্ষেত্রে। যদি কিছু কষ্ট করে হলেও বিয়ে করতে পারে তাহলে সেটাই ভালো।
ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব:
দুনিয়াতে মানব জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিয়ে ব্যতিত মানব জীবনের সুস্থ, সুন্দর এবং বৈধ সন্তান প্রজননের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। আর এদিকে বিয়ে নিয়ে একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখে। মানুষ চায় তার বিয়েটা আনন্দময় হোক, স্মরণীয় হোক। আর তাই যুবক-যুবতী তারা বিয়ের বয়সে পৌছানোর পরেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে, আর স্বপ্ন দেখতে থাকে নতুন আগামীর। আজকে আমরা শরীয়াহ এর আলোকে বিয়ের বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।
নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে সম্পর্কে বলেন;
“বিয়ে করা আমার সুন্নাত। আর যে আমার সুন্নাতকে মোহব্বাত করলো, সে যেন আমাকে মোহাব্বাত করলো। আর যে আমাকে মোহাব্বাত করবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে”।
একবার কিছু লোক এসে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্মানিত বিবি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ এর কাছে এসে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিয়মিত আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ তখন উনার নিয়মিত আমল সম্পর্কে তাদেরকে বললেন; যা শুনে ঐ লোকগুলো বললো, আরে তার সাথে কি আমাদের তুলনা হয়, তিনি আল্লাহর নবী। উনার আগের এবং পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ।
তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, আমি জীবনে বিয়েই করবো না; সারা জীবন ঈবাদাত করে কাটিয়ে দেব। আরেকজন বললেন, আমি সারা জীবন দিনে রোজা রাখাবো; কখনও রোজা ছেড়ে দেব না। আরেকজন বললেন, আমি সারা রাত্রী ইবাদত করে কাটিয়ে দেব, রাতে কখনো ঘুমাবো না।
নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই যুবকদের কথাগুলো যখন জানতে পারলেন, তখন উনি বললেন, আমি আল্লাহর নবী এবং তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি। আমি রোজা রাখি আবার পানাহারও করি, রাত্রী জাগরন করি আবার বিশ্রামও নেই। আমি বিবাহ করেছি; ইহাই আমার সুন্নাহ। আর যে আমার সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়। বিবাহ না করে একা একা জীবন চালানোর অনুমতি ইসলামে নেই। এছাড়া বিবাহের মাধ্যমে শারীরিক বহু রোগ থেকে বাঁচা যায়, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি মায়া-মহব্বতের সৃষ্টি হয়।
আর যারা বিবাহ ব্যতিত জীবন অতিবাহিত করে, তারা নানা ধরনের হতাশায় ভুগে। তারা জীবনের শুরুতে এটা বুঝতে না পারলেও জীবনের শেষ দিকে এসে বিবাহের প্রয়জনীয়তা অনুভুব করতে বাধ্য হয়। একটি সুন্দর জীবনের জন্য বিবাহের কোন বিকল্প নেই তা মেনে নিচ্ছে।
বিবাহের একটি সময় আছে, সেই সময়েই সকলকে এই গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। আশাকরি আমরা যারা বিবাহের উপযুক্ত, তারা সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবো। বিয়েকে কেন্দ্র করেই সারা দুনিয়ার আসলে সকল কাজ সংগঠিত হচ্ছে। সকল কর্মকান্ডের পিছনে নীরবে ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে এই বিয়ে। হ্যাঁ; তারপরও কিছু মানুষ আছে যারা এই বিয়ে না করেই জীবন কাটাচ্ছে। এই সংখ্যা আসলে খুবই কম। বিয়ে না করে যেসব মানুষ অবৈধভাবে সন্তান জন্মদান করছে, তাদের ঐ সন্তান এবং অন্যান্য সন্তানের মধ্যে মুলত একটি নীরব পার্থক্য বিরাজমান রয়েছে; যা পরবর্তীতে সন্তানের ব্যক্তিজীবনের কোন একদিন তার কর্মকান্ড দ্বারা প্রকাশ পায়।
বিয়ে করার উপকারিতা:
বিয়ে নামক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাজে থাকার ফলে মানব সমাজে লোকেরা অবৈধ জৈবিক চাহিদা মেটানো থেকে বিরত থাকে। একইভাবে নারী পুরুষ উভয়ের জৈবিক চাহিদার পূরণের পাশাপাশি একে অপরের প্রতি অনুপম ভালোবাসা তৈরি হয়। এই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় মানব সমাজের যত উন্নয়ন। এই ভালোবাসা থেকে যখন তাদের উভয়ের মধ্য থেকে সন্তান আসে, তখন তাদের মধ্যেকার ভালোবাসা আরো প্রগাঢ় হয়। নিজ সন্তানের কল্যানের জন্য তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠে। সন্তানের কল্যাণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে যত প্রয়োজনীয় উপকরন, সুন্দর এক মানব সভ্যতা। সু-স্বাস্থের জন্য হাসপাতাল, সু শিক্ষার জন্য-স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ইত্যাদি। আবার তাদের নিত্য চাহিদা মেটানোর জন্য গড়ে উঠে হাট, বাজার, রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা ইত্যাদি। মানসিক বিকাশের জন্য গড়ে উঠে পার্ক, খেলার মাঠসহ যত প্রয়োজনীয় উপকরন। পরবর্তী জীবনে তারা নিজ মেধা ও বুদ্ধি দ্বারা গড়ে তুলে নতুন নতুন মানবকল্যানের উপকরণ। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ে এবং এর সাথে জড়িত সকল কাজকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই মানব সভ্যতা। এছাড়া নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন এবং অবৈধ জৈবিক চাহিদা মেটানো থেকে বাঁচতে বিয়ের কোন বিকল্প নেই।
বিয়ে মানুষকে সুপথে চলতে বাধ্য করে। একজন বিবাহিত মানুষের দায়িত্ব থাকে অনেক। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি প্রচুর দায়িত্ব বা কর্তব্য রয়েছে। এই দায়িত্ব আদায় থেকে একে অপরের প্রতি মায়া, মমতাবোধ তৈরী হয়; যা সমাজের সকল জায়গায় প্রভাব ফেলে।
বিয়ে না করার অপকারিতা:
দুনিয়াতে যদি বিয়ে নামক সুন্দর পদ্ধতি না থাকতো তাহলে একদিন এই দুনিয়া মানবশূন্য হয়ে যেত। অবৈধভাবে জৈবিক চাহিদা মেটানোর ফলে যে মানব সমাজ দুনিয়ায় আসে তারা না পায় মা-বাবার ভালোবাসা, না পায় সভ্য জীবনের কোন সংস্পর্শ বা সঠিক দিকনির্দেশনা। ফলে তারা একদিন সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের যত বড় বড় অপকর্ম আছে তা তাদের দ্বারাই বেশি সংগঠিত হয়। খুন, ছিনতাই, হাইজ্যাক, অপহরন, চোরাকারবারী, লুটতরাজ, ডাকাতিসহ দুনিয়াতে যত বড় বড় অপকর্ম আছে তা এসব পরিবারের ভালোবাসা, নিয়ম-নীতি না পাওয়া মানুষগুলোর দ্বারাই বেশি সংগঠিত হয়। সুতরাং বিবাহের দ্বারা জন্মগ্রহণকারী সন্তানের ভেতরে যতটুকু সুন্দর আচরণ প্রদর্শিত হয় ততটুকু অবৈধ পন্থায় জন্মগ্রহণকারী সন্তানের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না।
তাই ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে সুন্নাহর আলোকে সময় মতো বিবাহ করার কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ্ আমাদেরকে শরীয়াতের মেজায বুঝে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।