তবে এ এভাবে দিবস পালন না করে যেকোন সময় মিরাজের ঘটনা বা মে’রাজের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা অবশ্য দোষণীয় নয়।
কোন রাতে নবী সাঃ ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল?
অথচ যে রাতে নবী সাঃ এর ইসরা ও মে’রাজ সংঘটিত হয়েছিল সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদীস না থাকায় আলেমগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন।
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: মিরাজের সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেছেন, নবুওয়তের আগে। কিন্তু এটা একটি অপ্রচলিত মত। তবে যদি উদ্দেশ্য হয় যে, এটা দ্বারা স্বপ্ন মারফত মে’রাজ তবে সেটা ভিন্ন কথা।
অধিকাংশ আলেমগণের মতে মে’রাজ সংগঠিত হয়েছিল নবুওয়াতের পরে। তবে নবুওয়াতের পরে কখন? সেই সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেছেন: হিজরতের এক বছর আগে। ইবনে সা’দ প্রমুখ এ মতের পক্ষে; ইমাম নববী রহ.ও এই মতের পক্ষে। তবে ইবনে হাজাম এর পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলেন: এটাই সর্ব সম্মত মত। এই মতের আলোকে বলতে হয় মে’রাজ সংগঠিত হয়েছিল রবিউল আওয়াল মাসে।
কিন্তু তার কথা অগ্রহণযোগ্য। কারণ, এটা সর্বসম্মত মত নয়। বরং এক্ষেত্রে উলামাদের প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশটির অধিক মত পাওয়া যায়।
ইবনুল জাওযী রহঃ বলেন, হিজরতের আট মাস আগে মে’রাজ হয়েছিল। এ মতানুসারে সেটা ছিল রজব মাসে।
কেউ বলেন: হিজরতের ছয় মাস আগে। এ মত অনুযায়ী সেটা ছিল রামাযানে। এর পক্ষে মত দেন আবুর রাবী বিন সালেম রহঃ।
আরেকটি মত হল যে, হিজরতের এগার মাস আগে। এ পক্ষে দৃঢ়তার সাথে মত ব্যক্ত করেন, ইবরাহীম আল হারবী রহঃ। তিনি বলেন: হিজরতের এক বছর আগে রবিউস সানীতে মি’রাজ সংঘটিত হয়।
কারো মতে, হিজরতের এক বছর তিন মাস আগে। ইবনে ফারিস এ মত পোষণ করেন।
এভাবে আরও অনেক মতামত পাওয়া যায়। কোন কোন মতে রবিউল আউয়াল মাসে, কোন মতে শাওয়াল মাসে, কোন মতে রামাযান মাসে, কোন মতে রজব মাসে।
আর তাই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “ইবনে রজব বলেন: রজব মাসে বড় বড় ঘটনা ঘটেছে মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু কোনটির পক্ষেই সহীহ দলীল নেই। বর্ণিত হয়েছে, নবী সাঃ রজবের প্রথম রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, সাতাইশ বা পঁচিশ তারিখে নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন অথচ এসব ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না।” (লাতাইফুল মাআ’রেফ, ১৬৮ পৃষ্ঠা)
আবু শামাহ রহঃ বলেন: গল্পকারেরা বলে থাকেন যে, ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল রজব মাসে। কিন্তু “ইলমে জারহ ওয়াত্ তা’দীল” সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতে এটা ডাহা মিথ্যা প্রচারণা বৈ অন্য কিছু নয়। (আল বায়িস: ১৭১)
শবে মিরাজ পালন করার বিধান:
উম্মাহের সালফে সালেহীন উলামাগণ এ মর্মে একমত যে, ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত দিন ছাড়া অন্য কোন দিবস উদযাপন করা বা আনন্দ-উৎসব পালন করা পরিষ্কার বিদআ’ত। কারণ, রসূল সাঃ বলেন
من أحدث في ديننا ما ليس منه فهو رد
“যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের অর্ন্তভুক্ত নয় এমন নতুন জিনিষ দ্বীনের নাম দিয়ে চালু করল তা পরিত্যাজ্য। (বুখারী, অধ্যায়: সন্ধি-চুক্তি।)
আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে:
من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد
“যে ব্যক্তি এমন আমল করল যার ব্যাপারে আমার নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম, অধ্যায়: বিচার-ফয়সালা)
সুতরাং মি’রাজ দিবস অথবা শবে মে’রাজ পালন করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআ’তের অর্ন্তভূক্ত বলে বিবেচিত হবে। সাহাবী, তাবেঈ বা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সালফে সালেহীনগণ এসব দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিলেন না তাই তারা এমন উদ্ভট রেওয়াজ পালন করেন নি। অথচ সকল ভালো কাজে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী।
ইবনুল কাইয়ূম জাওযিয়া রহ. বলেন:
“ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলমান পাওয়া যাবে না যে শবে মে’রাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেঈনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।
নি:সন্দেহে ইসরা ও মিরাজ নবী সাঃ এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এজন্য মি’রাজের স্থান-কালকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করার বৈধতা শরীয়ত প্রদান করেনি। এমনকি যে হেরা পর্বতে ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছিল এবং নবুওয়তের আগে সেখানে তিনি নিয়মিত যেতেন নবুওয়াত লাভের পর মক্কায় অবস্থানকালে তিনি কিংবা তাঁর কোন সাহাবী সেখানে কোনদিন যান ই-নি। তারা ওহী নাজিলের দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করেন নি বা সেই স্থান বা দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছুই করেননি। কেননা ইসলামে দিবস কিংবা স্থানের কোন মর্যাদা নেই বরং কর্মের মাধ্যমেই মর্যাদা লাভ করার কথা বলা হয়েছে।
বস্তুত যারা এ জাতীয় দিন বা সময়ে বিশেষ কিছু এবাদত করতে চায় ইসলামের নাম দিয়ে তারা মূলত ঐ আহলে কিতাবদের মতো, যারা ঈসা আঃ এর জন্ম দিবস (Chisthomas) বা তাদের দীক্ষাদান অনুষ্ঠান (Baptism) পালন ইত্যাদি পালন করে।
উমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ দেখলেন, কিছু লোক একটা জায়গায় নামায পড়ার জন্য তাড়াহুড়ো করতেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? তারা বলল, এখানে আল্লাহর রসূল সাঃ নামায পড়েছিলেন। প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, তোমরা কি তোমাদের নবীদের স্মৃতিসম্বলিত স্থানগুলোকে সাজদার স্থান বানাতে চাও? তোমাদের পূর্ববর্তী যুগের লোকেরা এসব অহেতুক কাজ করতে গিয়েই ধ্বংস হয়েছে। এখানে এসে যদি তোমাদের কারো নামাযের সময় হয় তবে সে যেন নামায পড়ে অন্যথায় সামনে অগ্রসর হয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ২য় খণ্ড, ৩৭৬, ৩৭৭)
ইবনুল হাজ্জ রহঃ বলেন:
“রজব মাসে যে সকল বিদআ’ত আবিষ্কৃত হয়েছে সগুলোর মধ্যে সাতাইশ তারিখের লাইলাতুল মি’রাজের রাত অন্যতম।”(আল মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২৯৪পৃষ্ঠা)
পরিশেষে বলব, যেহেতু রজব মাসে নফল নামায, রোযা রাখা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট ইত্যাদি সাজানো, সেগুলোকে আলোকসজ্জা করা কিংবা ছাব্বিশ তারিখের দিবাগত রাত তথা সাতাইশে রজবকে শবে মি’রাজ নির্ধারণ করে তাতে রাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে কোন গ্রহনযোগ্য প্রমাণ নেই। তাই আমাদের কর্তব্য হবে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। অন্যথায় আমরা বিদআ’ত করার অপরাধে আল্লাহ তাআ’লার দরবারে গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হব। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে কিছু নফল রোযা রাখে তবে সে এ মাসেও ঐ ধারাবাহিকতা অনুযায়ী রোযা রাখতে পারে, শেষ রাতে উঠে যদি নফল নামাযের অভ্যাস থাকে তবে এ মাসের রাতগুলিতেও নামায পড়তে পারে।
আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাওহীদ ও সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন এবং শিরক ও বিদআ’ত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।