যুদ্ধপীড়িত ইয়েমেন কেমন আছে?
একুশে জার্নাল ডটকম
মে ১৭ ২০২০, ২৩:৫৬

মোঃ জাফর আলী
নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত ধাপে ধাপে সংগঠিত কয়েকদফা গৃহযুদ্ধ, ক্ষমতার চেয়ার নিয়ে রাজনৈতিক রেষারেষি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, চরম দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও অবরোধসহ চরম মানবিক বিপর্যয়ের ভুক্তভোগী যেন ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ।
আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের গরীব এ দেশটি প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশ।বাব এল মান্দেব প্রণালী হলো রেড সি এবং গালফ অব এডেনের সংযোগস্থল। যেটির পাশেই ইয়েমেনের অবস্থান। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ এই রুট দিয়েই হওয়ার কারণে দেশটির ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসময় প্রাচীন সভ্যতার অধিকারীও ছিল এদেশ। কিন্তু এক হাজারেরও বেশি সময় ধরে এটি অবহেলিত দেশ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এ দেশের অর্ধেকেরও বেশি স্থানই বসবাসের অযোগ্য। ১৫১৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বারা শাসিত হয়েছে ইয়েমেন। শিয়া অধ্যুষিত উত্তর ইয়েমেন ও সুন্নি অধ্যুষিত দক্ষিণ ইয়েমেন ১৯৯০ সালে একত্রিত হওয়ার পর, ১৯৯৪ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বাঁধে। আবার ২০০৪ সালেও গৃহযুদ্ধ হয়। ৯০ দশকের শেষের দিকে খনিজ তেলের আবিষ্কার ইয়েমেনকে উন্নয়নের হাতছানি দেখিয়েছে, যার কারণে গৃহযুদ্ধ সহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কোন্দল, আরব-বসন্তের পূর্ব পর্যন্ত এর অর্থনীতিকে একেবারে ভঙ্গুর করতে পারেনি।
২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্তের আগুন যেন পুরো আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়া, বাহরাইন, সোমালিয়া, ইরাক, ইরান, জর্ডান, কুয়েত, ওমান সহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ এই আগুনের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বকেও এই আগুনে ঘি ঢালতে দেখা গিয়েছে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বেশ পরিবর্তন এসেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আবার এখন পর্যন্তও কোন কোন দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইয়েমেনেও এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে আজও তা চলমান।
২০১১ সালে বহুদিনের প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ কে তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হলে, নতুন হিসেবে প্রেসিডেন্ট হাদিকে দুর্নীতি, বেকারত্ব ও খাদ্য সঙ্কট, আল-কায়েদার হামলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, আব্দুল্লাহ সালেহ এর প্রতি সামরিক কর্মকর্তার আনুগত্যের মত বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হাদির দূর্বলতার সুযোগে শিয়া মতাবলম্বী হুথি বিদ্রোহীরা আন্দোলনের ডাক দিয়ে বেশ কিছু অঞ্চল নিজেদের অধিকারে নেয়। একপর্যায়ে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টাকালে প্রেসিডেন্ট হাদি পালিয়ে সৌদি আরবে চলে গেলে, পুনরায় সুন্নি প্রেসিডেন্ট হাদিকে ক্ষমতায় বসাতে, সৌদি আরব সহ আরও অন্যান্য আটটি সুন্নি দেশ একটি জোট গঠন করে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। পরে ২০১৫ সালে শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সহ বেশ কয়েকটি দেশ এ জোটকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে। এভাবে সোদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট প্রতিনিয়ত স্থল ও আকাশ পথে হামলা করে যাচ্ছে। আবার হুথিরাও তাদের অবস্থান থেকে সৌদি আরবে মর্টার ও মিসাইল ছুড়ছে। একবার সৌদি আরবের রিয়াদে ইয়েমেনের মিসাইল হামলার পর, ২০১৭ সালে সৌদি আরব ইয়েমেনের চারদিকে অবরোধ আরোপ করার ফলে, দেশটিতে কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ঘরের লড়াই এভাবে বাইরের কেউ তথা সৌদি জোটের বিরুদ্ধে করে ইয়েমেন যেন এখন প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি।
পার্সটুডে এর সংবাদ অনুযায়ী, অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,গত পাঁচ বছরে ইয়েমেন যুদ্ধে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যকার ৯ হাজার ৬৮২ জন পুরুষ, ২ হাজার ৪৬২ জন নারী ও ৩ হাজার ৯৩১ জন শিশু রয়েছে। এছাড়া সরাসরি আহত হয়েছে, ২৫ হাজার ৪০০ জন, যার মধ্যে ৪২০০ টি শিশু, ৩ হাজারেরও বেশি নারী এবং ১৮ হাজার ১০০ জনেরও বেশি পুরুষ রয়েছে। কয়েকটি গবেষণা মোতাবেক, সৌদি জোটের সরাসরি হামলা ছাড়াও ক্ষুধা ও বিভিন্ন রোগে মারা যাওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিহতের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। খাদ্য ও ওষুধ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বছরে প্রায় ৫০ হাজার শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। যুদ্ধপীড়িত ইয়েমেনে ২ কোটি ২ লাখ মানুষের জন্য ত্রাণ সাহায্যের প্রয়োজন। যুদ্ধের কারণে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে জীবন-যাপন করছে।
প্রতিহিংসার ভয়াল এ যুদ্ধের কারণেই ইয়েমেনের, ১৫ টি বিমানবন্দর, ১৪ টি সমুদ্র বন্দর, ২ হাজার ৭০০ টি মহাসড়ক ও সেতু, ৪৪২ টি যোগাযোগ কেন্দ্র, ১৮ শ ৩২ টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ৪লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টি আবাসিক ভবন, ৯৫৩ টি মসজিদ, ৩৪৪ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল, ৯১৪টি স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৭৮ টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র, ৩৫৫ টি কারখানা, ৭৭৪ টি খাদ্য বিক্রয় কেন্দ্র এবং ৩৭০ টি তেলের পাম্প কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্থ বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীর করোণা সংকটের প্রভাবটাও কিন্তু ইয়েমেনে অনেকটা পড়েছে। ইতিমধ্যে শতাধিক লোক কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় সৌদি জোট ৯ এপ্রিল এ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেও, করোণা সংকটের মধ্যেই ইয়েমেনে অন্তত ২৬২ বার স্থল ও বিমান হামলা চালিয়েছে। যুদ্ধপীড়িত ও দারিদ্র্যপীড়িত ইয়েমেন যখন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিরুদ্ধে লড়াই করছে ঠিক তখনই মে মাসের শুরুতেই সে দেশের খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি পণ্যবাহী ১১ টি ট্রাকে হামলা চালিয়েছে প্রতিপক্ষ এ জোটটি। এই সংকটের মধ্যেই আবার সৌদি আরব, ইয়েমেনের হাসপাতালে হামলা ও যুদ্ধবিমান থেকে বিভিন্ন স্থানে ভাইরাস সংক্রমিত মাস্ক ফেলার মত ঘৃণিত কাজও করেছে।
সারা বিশ্বের উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলো যেখানে করোণা সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে পড়েছে, এমন মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেও ইয়েমেনে এতবার হামলা যেন মরার উপর খাড়ার ঘা দেয়ার মত। একাজগুলো স্পষ্টভাবে যুদ্ধ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত । এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে পৃথিবীকে ইয়েমেনের বুকে বড় বড় লাশের পাহাড় দেখতে হবে। ইয়েমেনের এ সংকট নিরসনে, সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে,সর্বাগ্রে সৌদি জোট,হুথি ও তাদের মদদদাতা ইরানের নরম হওয়ার পাশাপাশি, দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বিবদমান পক্ষগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা, আপস-মীমাংসা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে একটি সুদৃঢ় শান্তির পথ তৈরি করতে হবে। যাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিঃশেষ হয়ে যায় ও মানবতা মুক্তি পায়। যাতে ইয়েমেনের মানুষ অন্তত না খেয়ে মরা থেকে রেহাই পায় এবং নূন্যতম মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে একটুখানি বাঁচার সুযোগ পায়।
শিক্ষার্থী: শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ,
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।