মালয়েশিয়ায় প্রতিবাদী রায়হান গ্রেফতার: ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী
একুশে জার্নাল ডটকম
জুলাই ২৫ ২০২০, ১৯:৫৫
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট:
মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে আল জাজিরায় কথা বলায় গ্রেফতার রায়হান কবির। সে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার নিজ এলাকায়ও সবার কাছে সৎ ও প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত। যেকোনো বিপদ-আপদে মজলুমের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেন। এমন নিরপরাধ তরুণ শুধু সত্য বলার কারণে গ্রেপ্তার হওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
আজ শনিবার সকালে বন্দরের শাহি মসজিদ নুরবাগ এলাকাবাসীর কাছে রায়হানকে নিয়ে তাদের সুধারণা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে তাঁরা রায়হানের গ্রেফতারে ব্যাপক ক্ষুব্ধ। তাঁরা রায়হানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশের মানুষ ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রায়হানদের প্রতিবেশী শাকিলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রায়হান খুবই ভালো ছেলে। সে আমাদের এলাকার গর্ব। টেলিভিশনে মালয়েশিয়ায় ওর গ্রেফতারের খবর দেখার পর থেকে খুবই খারাপ লাগছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভালো–মন্দ সবকিছুতে রায়হান এগিয়ে আসত। কেউ পড়াশোনা করতে পারছে না, তাকে নিজের বই দিয়ে, অর্থ দিয়ে সাহায্য করত। এলাকায় মাদক ও যেকোনো ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করত।’
আরেক প্রতিবেশী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমি মৃত অবস্থায় ছিলাম, আমাকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে রায়হান। শুধু আমি একা নই, আমার মতো অনেকের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। তাহলে ওর কেন এত বিপদ হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, ওর মুক্তির ব্যবস্থা করেন। আমাদের ছেলেকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দিন।
রায়হানের বাবা শাহ্ আলম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটী বিসিক শিল্প নগরীতে একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার স্যাম্পলম্যান। সংসারে রায়হান ছাড়াও আরেকটি মেয়ে রয়েছে। রায়হান ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মালয়েশিয়ায় পড়তে যান। তাঁর বোন নারায়ণগঞ্জ কলেজে স্নাতক পড়ছেন।
রায়হানের বোন মেহেরুন নেসা বলেন, তাঁর ভাই সব সময় তাঁকে বলতেন মানুষের পাশে থাকতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ভাইয়ের কথা শুনে তিনিও এভাবে চলতে চেষ্টা করছেন।
শাহ্ আলম জানান, মালয়েশিয়ায় স্নাতক পাস করে ঈদুল ফিতরের আগে একটি কোম্পানিতে চাকরি হয় তাঁর ছেলের। কিন্তু চাকরির টাকা সেখানেই কষ্টে থাকা মানুষের জন্য খরচ করতেন রায়হান।
ছেলের সম্পর্কে বলতে গিয়ে শাহ্ আলম বলেন, এলাকায় আগে তাঁর একটি মুদিদোকান ছিল। ওই দোকানে তিনি সিগারেট বিক্রি করতেন। একদিন তাঁর ছেলে রায়হান এসে বললেন, সিগারেট বিক্রি করলে এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে। ছেলের প্রতিবাদের পর থেকে তিনি সিগারেট বিক্রি করা বন্ধ করে দেন। সর্বশেষ দুদিন আগে ছেলের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়েছিল।
শাহ্ আলম বলেন, রায়হান ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। এলাকার লোকজনের বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর ছেলে তো কোনো অন্যায় করেনি। প্রবাসী ও দেশের মানুষের স্বার্থে লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারের কাছে আবেদন, তারা তাঁর ছেলের পাশে দাঁড়াক। তাকে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করুক।
রায়হানের মা রাশিদা বেগম বলেন, লকডাউনে বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তাঁর খারাপ অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি রায়হান। তাই সে আল জাজিরা টেলিভিশনে কথা বলেছে। রায়হান সব সময় মানুষের ভালো চেয়েছে। কখনো খারাপ চায়নি। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে লকডাউনে বন্দী থেকেও মানুষের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। সবার কাছে আমার ছেলের সুনাম শুনতে পাবেন।’
নুরবাগ এলাকার পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি জাবেদ হোসেন বলেন, রায়হান খুব ভালো ছেলে। কোনো নেশা বা আড্ডায় নেই। ও ছোটবেলা থেকেই এলাকার সবার জন্য কাঁদে। সবার বিপদে–আপদে পাশে থেকেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত এমন একটি নিরপরাধ ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে ছাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া।
রায়হানের বিষয়ে যোগাযোগ করলে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি (রায়হানের গ্রেফতার) আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।’
৩ জুলাই আল জাজিরার ইংরেজি অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ‘লকআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি লকডাউন চলাকালে দেশটির সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণ উঠে আসে। প্রতিবেদনে তরুণ রায়হান কবির বাংলাদেশিদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। আল জাজিরার প্রতিবেদন দেখে রায়হানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে গ্রেফতার করে মালয়েশিয়ান পুলিশ।