মান সামাতা নাজা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২২ ২০২০, ১২:৩৯

হুসাইন আহমদ বাহুবলী

কওমী পাঠ্যসূচিতে একটি বিস্ময়কর কিতাবের নাম রওজাতুল আদব। সাহিত্যের বাগান। শাব্দিক অর্থটা এমন করেই আমাদেরকে বলা হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে এই কিতাবটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিতাবটিকে শুধু সাহিত্যের বাগানে সীমাবদ্ধ করতে আমার প্রচন্ড আপত্তি সৃষ্টি হয়। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কিতাবটিতে যে মানবতা, আধ্যাত্মিকতা, সামাজিকতা শিক্ষা দেয়া হয়েছে আরবী সাহিত্য শেখানোর নাম করে, তা সরাসরি আধ্যাত্মিকতার কিতাবেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই আমার এনালাইসিসে কিতাবটিকে আধ্যাত্বিকতার বাগান বললেও অত্যুক্তি হবে না।

যতদূর মনে পড়ছে কিতাবের একটি অধ্যায় আছে, الباب الخامس في النوادر والامثال

এখানে এমন কিছু উদাহরণ-উপমা, নীতিবাক্য-প্রবাদবাক্য উপস্থাপন করা হয়েছে যার বাস্তবতা কুরআন-হাদিসের চাইতেও ঘনিষ্ঠ মনে হবে আপনার কাছে।

ভুল বুঝবেন না কেউ। কোরআন-হাদিসের মর্মবাণী অনেক রহস্যেঘেরা থাকার কারণে তা উদ্ধার করাটা সকলের জন্য সহজসাধ্য হয় না। যে কারণে স্থূল দৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সাথে অমিল দেখা যায়।

কিন্তু নীতিবাক্যগুলো রহস্যময় হয় না বিধায় সেগুলোর বাস্তবতা অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। তন্মধ্যে থেকে একটি নীতিবাক্য হচ্ছে “মান সামাতা নাজা”।

তারুণ্যের প্রথম দিকে যেকোনো বৈঠকে কথা বলে ফেলার ঝোঁক ছিল। এজন্য মাঝেমধ্যে আফসোস করতে হতো। একটা সময় নীরবতা ঘীরে ধরল। এই ধরেন বিগত এক মাস ধরে ফেসবুকে কিছু লিখছি না। অথচ বিতর্কের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। “বিতর্ক কাম্য নয়” বলে স্ট্যাটাস দিয়ে অনেকেই, কি নিয়ে বিতর্ক তা ওয়াজাহাত করে দিয়েছেন। হাদীসে আছে,

من قال لاخيه اسكت فقد لغى

নিরবতার স্থানে কেউ যদি “নীরব থাকো” বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে, সেও নীরবতা ভঙ্গকারী।

বিতর্কিত বিষয়গুলো দেখিনি অথবা সেগুলো নিয়ে ভাবিনি এমন নয়। সবগুলি বিতর্ক দেখেছি, ভেবেছি।

কিন্তু কিছু বলিনি। কারন আমি উপলব্ধি করেছি এই বিতর্কের ধারা যদিও সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মধ্যকার অসহিষ্ণুতা থেকে। কিন্তু এর বাজারজাত আমাদের কেউ করেনি। করেছে ঘাপটি মেরে থাকা আমাদের বন্ধুরূপী শত্রুরা। অথবা এই শত্রুদের ফাঁদে পা ফেলে দেয়া আমাদের অঙ্গনের অতি উৎসাহী তরুণেরা।

ফেসবুক জগতে এটা অত্যন্ত সহজ। কওমী, দেওবন্দী, হক্কানী নামে এমন কিছু আইডি আছে যা আমাদের আদর্শ মতবাদের বিরুদ্ধবাদীরা পরিচালনা করে, শুধুমাত্র আমাদেরকে উস্কানি দিয়ে ভার্চুয়াল জগতে নাকানি-চুবানি দেয়ার জন্য।

গ্রামে একটা কথা শুনতাম “ঘরের কথা বাহির করে চান্ডালে”। এই চান্ডালদের আঁকা নকশায় আমরা যখন জোর কদমে এগিয়ে চলি তখন তারা ব্রাইটনেস স্লো করা ডিসপ্লের সামনে মজা করেই বগল বাজায়।

এর শুরুটা অনেক আগে থেকে। এখন হয়তো হাটহাজারী, ওলিপুরী, আজহারী প্রসঙ্গ আমাদেরকে ব্যস্ত করে রাখছে। আজ কিছুটা হলেও আক্ষেপ- হাহুতাশ শোনা যাচ্ছে অনলাইনের কল্যানে।

কিন্তু একসময় অনলাইন ছিলনা। অফলাইনে অনধিকার চর্চার বিশাল হাট বসত। সবাই জানত, দাদার বর্তমানে বাবা চাচার দ্বন্দ্বে ভাইদের বক্তব্য একান্তই বেমানান। কিন্তু আমরা তখন লাগাম ধরিনি, আমার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জঘন্য মানসে।

দল, দরস বা জনতার মঞ্চে পছন্দনীয় জায়গাটা ধরে রাখতে হলে লাগাম ছেড়ে দেয়ার বিকল্প ছিল না ভেবেই আমরা এমনটা করেছি। জমিয়ত পাকিস্তানী, খেলাফত ইরানী ট্যাগ তখন চলছিল অফলাইনে।

কারো ব্যক্তিত্বে আঘাত করে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার বিকৃত মানসিকতা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। জাতির কল্যাণে অবদান রাখা বহু বিদগ্ধ আলেমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে আমরা উৎসাহ যুগিয়েছি সাধ্যমত। আগুন দিয়েছে প্রতিবেশীর ঘরে।

সেই আগুন আস্তে আস্তে আমাদেরকে ভস্ম করছে।

আশার বাণী হচ্ছে, সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখনো যদি আমরা নীরবতা পালন করতে পারি, বিতর্কিত বিষয়ে আমার কাছে যেটা হক মনে হবে নীরবে সেটাই মেনে নিই। ভিন্নমত পোষণকারী বড়দের বিরুদ্ধে বিষোদগার থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখি।

প্রতিপক্ষ আমাদের কোনো দুর্বলতা আঁচও করতে পারবেনা। আমরাই থাকবো আপন মহিমায় উজ্জ্বল। মান সামাতা নাজা (যে নীরব থাকে সে মুক্তি পায়)