মানবিক ধর্ম ইসলাম
একুশে জার্নাল
এপ্রিল ১৫ ২০১৮, ১১:০৩
সাধারণভাবে এই মূলনীতি ঠিক আছে যে, মানুষের জন্য ধর্ম; ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এই মূলনীতির আলোকে বলা যায়— মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে যে ধর্ম পালিত হয়, যে ধর্মে মানবিক অনুভূতি উপেক্ষিত হয়; সে ধর্ম তার নিজের মঞ্জিলে পৌঁছাতে ব্যর্থ। তাহলে সেক্ষেত্রে লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষই প্রধান হয়ে যায়। ধর্মকে একটি সেতুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। নদী পারাপারের জন্য এর দরকার হয়। এখন নদী পার হওয়ার পর কেউ যদি আস্ত সেতুটাই কাঁধে করে নিয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়— সে সেতুর উদ্দেশ্য বুঝতেই ব্যর্থ হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এখন ধর্ম পালন করতে গেলে যদি জীবনের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ধর্মের উদ্দেশ্যই এতে ব্যর্থ হয়। জীবনের স্বাভাবিকতা যে ধর্ম ব্যাহত করার নির্দেশ দেয়, সে ধর্ম নিজের উদ্দেশ্যে বিফল।
মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়— এই মূলনীতির প্রতি লক্ষ রেখে যখন ইসলামের দিকে তাকাই, তখন দেখি— ইসলাম অন্যসব ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র। দেখি যে, ধর্ম এবং জীবন ইসলাম এই দুইয়ের উদ্দেশ্যের প্রতিই গভীরভাবে লক্ষ রেখেছে। এমনভাবে মানুষের ওপর ধর্ম আরোপ করেছে, যেন ধর্মের জীবন ও জীবনের ধর্ম, দুই-ই সফল হয়। ইসলামধর্মকে মানুষের উপযোগী করে মানুষ্যসমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা মনুষ্যসম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নবী প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন— তোমার কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে। [সূরা নাহল ৪৪]
নবীজী (সা.) আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। একজন মানুষ হিসেবে কীভাবে ধর্ম পালন করতে হয়, ধারণ করতে, যাপন করতে হয়— নবীজী তেইশ বছরের নবুওয়াতি জীবনে হাতেকলমে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন এবং সশরীরে আমল করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। এজন্যই উম্মুল-মুমিনীন আয়েশা (রা.) নবীজীর জীবনাচার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে এক বাক্যে বলেছিলেন— হুয়াল-কুরআন!
পূর্বেকার লোকদের ধারণা ছিল মানুষ নবী হতে পারে না। তারা বলত— ‘আমাদের পালনকর্তা ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা প্রেরণ করতেন, অতএব, আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্য করলাম।’ [হা মীম সিজদাহ ১৩]
‘এ কেমন রাসূল যে, আহার করে এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করে? তাঁর কাছে কেন কোনো ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তাঁর সাথে সতর্ককারী হয়ে থাকত?’ [সূরা আল-ফুরকান ৭]
‘এ তো তোমাদের মতো একজন মানুষ বৈ নয়; তোমরা যা খাও, সেও তাই খায় এবং তোমরা যা পান কর, সেও তাই পান করে।’ [সূলা আল-মু’মিনূন ৩৩]
এর বিপরীতে তাদের এসব ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখান করে সকল যুগের সকল নবী অকপটে বলেছেন— ‘আমরা তোমাদের মতোই মানুষ, কিন্তু আল্লাহ বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর ইচ্ছা, অনুগ্রহ করেন।’ [সূরা ইবরাহীম ১১]
মানুষ নবী হতে পারে না— পূর্বেকার যুগের মানুষের এই ধারণার মূলে ছিল ধর্ম এবং জীবন, এই দুইয়ের পারষ্পরিক সম্পর্ক বোঝার ব্যর্থতা। তারা মনে করত জীবনের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। ধর্ম স্রেফ স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের একটা পন্থা মাত্র। জীবনের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। স্রষ্টার সঙ্গে সাধারণ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য কেবল সময়মত নির্দিষ্ট কিছু ক্রিয়াকর্ম আর রসম-রেওয়াজ পালন করাই যথেষ্ট। আর গভীর সম্পর্কের জন্য জীবনের যাবতীয় উপকরণ ছেড়ে দিয়ে বৈরাগ্য গ্রহণ করে সবসময় উপাসনায় লিপ্ত হওয়া জরুরি। এজন্য যারা স্রষ্টার সঙ্গে গভীর সম্পর্কের আশা করত, তারা জীবনের সকল উপকরণ ছেড়ে দিয়ে বৈরাগ্য গ্রহণ করত; আর যারা জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করত, তারা সবসময় লাগামহীন ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকত আর সময়ে সমান্য ধর্মীয় রসম-রেওয়াজ পালন করত।
ইসলাম এই প্রান্তিক ধারণা প্রত্যাখান করেছে। ইসলাম শিখিয়েছে, ধর্ম জীবনেরই অংশ। বরং ধর্মের সঙ্গে রয়েছে জীবনের গভীরতম সম্পর্ক। ধর্ম ও জীবন অবিচ্ছেদ্য। দৈনন্দিন কাজে ধর্ম পালন করতে হবে। ধর্ম পালনের জন্য জীবনের সকল উপকরণ ত্যাগ করা আর জীবন উপভোগের জন্য প্রাত্যহিক বিষয়াদি থেকে ধর্ম বিযুক্ত করা— অপ্রাকৃতিক, অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। ইসলাম এমন একটি ধর্ম, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর উপস্থিতি আছে, জীবনের সকল পর্যায়ে এর দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই হিসেবে ইসলাম ধর্মমাত্র নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম যখন স্রেফ ধর্ম নয়, জীবনব্যবস্থা; সুতরাং মানুষের জীবনব্যস্থা একজন মানুষই কেবল পারে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিতে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা মানুষকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ইসলামধর্মীয় জীবনব্যবস্থার রূপরেখা নবী (সা.) তেইশ বছরের নবীজীবনে হাতেকলমে শিখিয়ে গেছেন; এবং সেই রূপরেখা কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মাহর সামনে রেখে গেছেন।
ইসলাম একদিকে বলছে, লা রুহবানিয়্যাতা ফিল-ইসলাম — ইসলামে বৈরাগ্য নেই; অন্যদিকে বলছে, ইন্নাদ-দীনা ইনদাল্লিহিল ইসলাম — ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবনব্যবস্থা। এভাবেই ইসলাম ধর্মহীন জীবন ও জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণমুক্ত ধর্মীয় বৈরাগ্যবাদের ধারণা প্রত্যাখান করে মধ্যমপন্থার নির্দেশ করেছে। ধর্মের জন্যও জীবনের উপকরণ ত্যাগ করার প্রয়োজন হবে না এবং জীবনের প্রাত্যহিক কাজ থেকেও ধর্ম বিযুক্ত করবে না; বরং জীবনজুড়ে ধর্ম থাকবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্ম লালন করবে। এতে জীবন এবং ধর্ম, দুই-ই রক্ষিত হবে। এর মধ্য দিয়ে যারা ধর্মকে স্রেফ পরকাল সংশ্লিষ্ট বিষয় মনে করেন, সেই ধারণাও প্রত্যাখাত হয়।
নবী (সা.) পৃথিবীর সবচে ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার সুন্নাহ হলো— আমি নামায-রোযা করি, খাবার খাই, বিয়ে করি, তালাক দিই। যে আমার সুন্নাহ থেকে সরে গেল, সে আমার জাতিভুক্ত নয়।’ [দারিমী]
অর্থাৎ, অতিধার্মিক হওয়ার জন্য খাওয়া-দাওয়া ও বিবাহ-শাদি ছেড়ে দিয়ে বৈরাগ্যবাদের শিক্ষা নবীজী দেন নি। বরং তিনি খাওয়া-দাওয়া ও বিবাহ-শাদি করা, তথা জীবনের সকল উপকরণ গ্রহণের পাশাপাশি ইবাদাতের নির্দেশ দিয়েছেন। অথবা বলা যায়, নামায-রোযার পাশপাশি নবীজী (সা.) খাওয়া-দাওয়া ও বিবাহশাদি তথা মানবিক প্রয়োজনীয় বিষয়াদিকেও ইবাদাত বলে গণ্য করেছেন। এই হলো ইসলাম। জীবনের ধর্ম ইসলাম। মানবিক ধর্ম ইসলাম। এভাবেই ইসলাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ বিধান আরোপ করে, ধর্মের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক মানবজীবনের গতিধারা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়।
প্রশ্ন হতে পারে যে— দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করলে জীবন নাশ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে তো জীবনের জন্য ধর্ম, এই মূলনীতি ঠিক থাকে না; বরং ধর্মের জন্য জীবন হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে ইসলামও অপরাপর ধর্মের মতো জীবনের দাবি প্রত্যাখান করে। জবাবে বলা যায়— ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম যেহেতু জীবনেরই অংশ এবং ধর্ম ও জীবন অবিভাজ্য, কাজেই ধর্ম তথা ইসলামের জন্য জীবন দেওয়া জীবনের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ফলে ধর্মের জন্য জীবন দেওয়া, জীবনের জন্য জীবন দেওয়ারই নামান্তর। যেমন: মানুষের জন্য দেশ, দেশের জন্য মানুষ নয়। এখন দেশের জন্য জীবন দিলে মানুষের জন্যই জীবন দেওয়া হয়। কারণ দেশের অক্ষুণ্নতার সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-মরণের সম্পর্ক জড়িত।
-আবুল কাসেম আদিল
লেখক,রাজনৈতিক বিশ্লেষক।