মানবসেবায় এক উদ্যোক্তার গল্প

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ১৫ ২০২০, ১৬:০৪

মাহবুবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ: মার্চ মাস বাংলাদেশিদের জন্য স্বাধীনতার মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মাস শুধু নয় শতবর্ষ পূর্তির মাস। চারিদিকে চলছে মুজিব বর্ষ গণনার রাজকীয় আয়োজন।বিশ্বকে অবাক করে দেয়া শতকোটি টাকা ব্যয়ে মুজিব বর্ষ উৎযাপনের প্রস্তুতি। এদিকে কওমী অঙ্গনে শিক্ষাবর্ষের শেষাংশের প্রস্তুতি।বোর্ডগুলো ব্যস্ত কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আয়োজনে।মাদরাসায় মাদরাসায় চলছে খতমে কুরআন, খতমে দরসে হাদীস সহ নানা আয়োজন।

এমন সময় বিশ্বব্যাপি হানা দিলো চীন থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস নামক এক মহামারী। আস্তে আস্তে আক্রমনের পরিধি বাড়তেই থাকল। একপর্যায়ে মরণঘাতী করোনা আঘাত হানলো বাংলাদেশেও।এক অজানা আতঙ্কে বদলে গেল পরিচিত দেশটির নিত্য দিনের চিত্র। চারিদিকে কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, আইসোলেশন সহ নানা ধরনের উপাখ্যান। ঘরের কোণে ঝড়তে লাগলো শব্দহীন কান্নার অশ্রু। ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষের মত করে কেমন একটা আর্তনাদের চিত্র অঙ্কিত হতে লাগলো কোন অজানা ক্যানভাসে।

বিষয়টি নাড়া দিলো তরুণ আলেম আশিকুর রহমানের অন্তর। চিন্তায় বিভোর হয়ে নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিলো পরিস্থিতি মোকাবেলায়। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হচ্ছে। মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলের দ্বারে ঠেকেছে। মেধাবী এই তরুণ যেন আরো নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় পেল। আর বসে নয় কাজে সমাধান। শুরু হলো পথচলা: করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপ আমরা তরুণ উদ্যোক্তা আশিকুর রহমানের মুখেই শুনবো-

আমার এই ক্ষুদ্র জীবন থেকে যা শিখেছি, পৃথিবীতে অর্থের চেয়ে বেশি অভাব শুভ উদ্যোগের আর তার চেয়েও বেশি অভাব হিম্মত ও আস্থার জায়গাটার। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের সেবায় কোন কিছু করতে গিয়ে কাউকে কোনদিন আটকে যেতে দেখিনি।

আলহামদুলিল্লাহ আমার এ ক্ষুদ্র জীবনেও যখনই এমন কিছু করার নেক নিয়ত করেছি অর্থের অভাব কিংবা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

আমি ও আমার তিন নং ওয়ার্ডের তরুণ সহযোদ্ধারা যখন এই কাজে নেমেছিলাম আমাদের হাতে কিছুই ছিলনা। চোখে ছিল শুধু এই ওয়ার্ডের হাজারো খেটে খাওয়া অভুক্ত মানুষের দুর্দশার দৃশ্য আর বুকে ছিল তাদের জন্য কিছু করতে হবে এই অস্থিরতা। কিভাবে করবো,কোত্থেকে করবো তাও জানা ছিলনা।

প্রথমদিন আমি ছাত্র জীবন থেকেই আমার বহু ইতিবাচক কাজের সহকর্মী ও তিন নং ওয়ার্ড যুব সমাজের দক্ষ সংগঠক মাওলানা আরিফ বিল্লাহ ও বন্ধু মাহমুদুল হাসানকে সাথে নিয়ে বিষয়টি তুলে ধরি। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে কিছু একটা করতেই হবে। এরপর আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন মাদানী নগর মাদ্রাসার সম্মানিত মোহতামিম হাফেজ মাওলানা ফয়জুল্লাহ সাহেব সন্দীপি দা: বা: এর সাথে আমরা পরামর্শ করি। হযরত দোয়া ও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই মহৎ কাজে আমাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেন। এরপর ছোটভাই শাহাদাত,ইউসুফ ও মাদ্রাসা দারুত তাকওয়ার পরিচালক মাওলানা ইসমাইল ভাইকে সাথে নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের একটি তালিকা প্রদান করে কারফিউ চলাকালীন যে কোন মুহুর্তে জরুরী সেবা প্রদানের অনুমতি পত্র সংগ্রহ করি।
এবং ৩ নং ওয়ার্ডের প্রতিটি গ্রামের সচেতন তরুণদের একটি সভা আহ্বান করি।

সভায় প্রতিটি গ্রামে কাজ করার জন্য আমাদের যুব সমাজের ভাইদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবীগণ প্রস্তুত হয়ে যান। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ক্রমে আমরা স্বেচ্ছাসেবীগণের মাধ্যমে প্রথম দফায় ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে প্রতিটি গ্রামের অসহায় মানুষদের তালিকা তৈরি করার কাজে নেমে পড়ি।

দরিদ্রদের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেই প্রথমে ঐ মধ্যবিত্তদের খুঁজে বের করার যারা কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেননি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে আজ স্ত্রী-সন্তানকে অভুক্ত দেখে বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কাউকে বলবেন না।

দ্বিতীয় বৈঠকে তালিকা উপস্থাপনের পর আমরা খুঁজে পাই কমপক্ষে পাঁচশোরও বেশি এমন পরিবার যারা করোনার ভাইরাসের আক্রমণে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে দু’বেলা খাবারের সংকটে পড়ে গিয়েছে।

স্থানীয় জন-প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারী সহায়তার অলীক আশ্বাসে না থেকে প্রতিটি গ্রামের স্বেচ্ছাসেবীগণ নিজ নিজ পয়েন্টের মানুষদের প্রয়োজন পূরণে কাজে নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এবং মহল্লা ভিত্তিক ফান্ড গঠন করে সেখানেই তা খরচ করে ক্ষুধা মোচনের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

কোন গ্রামের অসহায় মানুষদের প্রয়োজন পূরণে সেখানকার স্বেচ্ছাসেবী গণের ফান্ড অপর্যাপ্ত হয়ে পড়লে কেন্দ্র থেকে যেন তৎক্ষণাৎ সহায়তা পৌঁছানো যায় সে জন্য একটা কেন্দ্রীয় ফান্ড গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে।

আল্লাহর উপর ভরসা করে উভয় রকম তহবিল সংগ্রহে আমরা কাজে নেমে পড়ি। অনেকেই ক্ষুদ্র সামর্থের মধ্যেও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্হানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শিল্পপতি ও কিছু বিত্তবানদের সাথে যোগাযোগ করে হতাশ হলেও নিরাশ হইনি আল্লাহর রহমতের। দোয়া ও প্রচেষ্টা চালাতে থাকি। এক পর্যায়ে কিভাবে কি করব ভেবে পাচ্ছিলামনা ঠিক তখনই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জনাব শিবলী সাদিক আমার বন্ধু ও সহপাঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পেরে আমাকে ফোন করেন। তার নিজ ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের ওয়ার্ডের দুই শতাধিক পরিবারের এক সপ্তাহের খাবারের যোগান দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

আলহামদুলিল্লাহ আমাদের যুব সমাজের ব্যবস্থাপনায় “শিবলি সাদিক ফাউন্ডেশন”-এর পক্ষ হতে দুঃসময়ের এই অনুদান ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার উপহার স্বরূপ পৌঁছে গিয়েছে তিন নং ওয়ার্ডের প্রতিটি গ্রামের অসহায় মানুষের কাছে।যার প্রতিটি প্যাকেজ সাজানো হয়েছে প্রদত্ত সূচি মতে..চাল ৫ কেজি,ডাল আধা কেজি,আলু ২ কেজি, পেঁয়াজ ১ কেজি,তেল ১ লিটার,আটা ২ কেজি,কাপড় কাচার সাবান ১ টা। খাদ্য সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত হয়ে বা করোনা সন্দেহে মৃত্যুবরণ করলে তাদের শরয়ী পদ্ধতিতে কাফন দাফনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে আমরা প্রস্তুত আছি। এছাড়াও যে কোন ধরনের সেবার জন্য সাধ্যমত ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত আছি।

সেইসাথে আমাদের পারিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠিত “শহীদ সৌরভ ফাউন্ডেশন”-এর পক্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে পঞ্চাশটি পরিবারের খাদ্য সামগ্রী প্যাকেজ পৌঁছে দিয়েছি। এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশা আল্লাহ!

সেইসাথে আগত রমজান উপলক্ষে বিশেষ অনুদানের প্রস্তুতি প্রায় শেষের পথে।যেন আমাদের এলাকায় কারো অনাহারে রমজানের একটি রাতও না কাটে, হোক সে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। সবকিছুর পরে মানুষ পরিচয়টাই হোক বড়।

একটি বিষয় না বললেই নয়, সরকারি বেসরকারি ত্রান সহায়তা যাই দেয়া হচ্ছে তা নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ।যেমন স্থানীয় কাউন্সিলর হিসাব করেন ভোটার তালিকা মতে। শিল্পপতি গোনেন তার শ্রমিক তালিকায় নাম আছে কিনা? দলনেতা খুঁজেন তার দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে কিনা? তাই আমরা নির্দিষ্ট কোন ধারায় না গিয়ে খুঁজি শুধু মানুষ কেউ না খেয়ে আছে কিনা? হোক সে যে কোন দলের, মতের কিবা ধর্মের।
গত ১১ এপ্রিল রাতের ঘটনাঃ আমি রোজা ছিলাম। হালকা ইফতার সেরে সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পরি।এরই মধ্যে আমার ছোটবেলার এক বন্ধু আলাউদ্দিন মেসেঞ্জারে জানালো এক বাড়িতে এক মহিলা একা দুদিন যাযৎ কিছুই খায়নি। কিছু একটা করা যায় কিনা। সাথে সাথে বন্ধু শাহাদাত কে সাথে নিয়ে বস্তা কাঁধে নেমে পরলাম। রাত তখন প্রায় এগারোটা, পুরো এলাকা যেন মৃত্যুপুরী। সন্ধ্যার পর থেকে কারফিউ চলছে। একটা রিকশা তো দুরের কথা মানুষের ছায়ারও দেখা মেলেনি।
বন্ধুর দেয়া ঠিকানা মতে পৌঁছে গেলাম এক নারী গার্মেন্ট শ্রমিকের ঘরে। এখানে সে ভাড়া থাকে।লকডাউনে আটকা পড়েছে। বেতন পায়নি, দুদিন যাবত বিভিন্ন ত্রানের লাইনে দাঁড়িয়েও কিছু জোটেনি। পাশেই স্থানীয় কাউন্সিলরের দোতলা বাড়ি। সরকারি ত্রানের অলীক ছড়াছড়ি থাকলেও পাশের বাড়ির দিকে হয়তো নজর পড়েনি। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকার। মহিলার হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দিতেই তিনি আনন্দাশ্রু চেপে রাখতে পারেননি।

সবশেষে বলবো,আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদ্দাম, মামুন, আলী ইমাম, জিহাদ,ছোটভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ, মাওলানা রাকিবুল হাসান, সালমান, আব্দুল্লাহ ও জোবায়ের সহ আরো যে সকল ছোট ভাইদের নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে আমরা আজ অসহায় ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি আল্লাহ তাদের সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

অবশেষে তিন নং ওয়ার্ড যুব সমাজের পক্ষ থেকে আবারো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জনাব শিবলী সাদেকের এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় মুরব্বি হযরত ফয়জুল্লাহ সন্দীপি দা:বা: এর। এই দুঃসময়ে যারা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের সকলের প্রতি রইল নারায়ণগঞ্জ তিন নং ওয়ার্ড যুব সমাজের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনা’ এই কথাটা সবার প্রিয় হলেও এই কথা গুলো অনুসরণ করার মত মানুষের বড্ড অভাব। এখনকার সমাজের বেশিরভাগ মানুষ সবাই নিজেই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।যেন কেয়ামতের ময়দানের ভয়াবহতা। সমাজের অন্য মানুষগুলো কি করে জীবনযাপন করছে তা নিয়ে কারো মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র সময় নেই।

তাই বলছি, আসুন সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসি পরিস্থিতির স্বীকারে নিরুপায় মানুষের সহায়তায়।