মাতৃত্ব – বনশ্রী বড়ুয়া

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ০৯ ২০২০, ১১:১১

পেটের ভিতর টনটন করছে।ব্যাথাটা একটু বেড়েছে।তারপরও ভীষণ ভাল লাগছে আমার।বাবুটা নড়ছে খুব।যেন এখনই সে আমার কোলে এসে বসবে।আমি ছড়া কাটবো আর ও শুনবে।অবশ্য আমারও ইচ্ছে করছে ওকে ছুঁয়ে দেই।গালে একটা টুপুস করে চুমু এঁকে দেই।
আমার কনসিভের সাত মাস চলছে।আর মাত্র ক’মাস,তারপর ও আসবে পৃথিবীর আলোয়। মায়ের আদর খাবে, বাবার বুকে জড়িয়ে থাকবে…
কিন্তু আমি ওকে কোনদিন কাছে পাবো না,ছুঁতে পারবো না।

এটা আমার পঞ্চম ইস্যু। এর আগে আমার তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছিল।প্রথমবার যখন কনসিভ করি, ঋতু আমার গর্ভে আসে।ওর বাবার সেকি আনন্দ!
ঘর ভর্তি করে ফেলেছিল খেলনাতে।সারাক্ষণ আমি কি খাবো, কি না খাবো এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।প্রথম দিকে খুব বমি হত,কিছুই খেতে পারতাম না।নাফিসের সেকি দুঃশ্চিন্তা! আমার চে ওর অস্থিরতা ছিল বেশি।আমাদের একমাত্র স্বজন ওর ডাক্তার বন্ধু আদিত্য। আদিত্য ‘দাকে ফোন করে খুব জ্বালাতো নাফিস।আমি কেন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছি।বাচ্চাটা ভাল আছে কিনা…এসব নিয়ে সারাক্ষণ আদিত্য’দাকে ফোন করে বিরক্ত করতো।ঋতু,আমাদের প্রথম মেয়ে। ঋতু এসে আমাদের জীবনটা আলোয় ভরিয়ে দিল।নাফিস যেন প্রাণ ফিরে পেল।আমরা নতুন করে বাঁচতে শুরু করি ঋতুকে নিয়ে।

নাফিস আর আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম।আমাদের বিয়েটা কেউ মেনে নেয়নি।আমার জন্যে নাফিসকে ত্যাজ্যপুত্র করেছে ওর পরিবার।আমার পরিবারও মেনে নেয় নি।
কি প্রচন্ড আবেগ আর ভালবাসাবাসি থাকলে পরিবার, ধর্ম সবকিছুকে ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে যাওয়া যায় নতুন একটা ঘরের সন্ধানে,সেটা যারা ভালবাসেনি তারা কখনোই বুজতে পারবে না।অবশ্য ওদের ছাড়াই আমরা ভাল ছিলাম।খুব ভাল ছিলাম।
ঋতুর জন্মের পর ভালবাসা যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল।আমাদের কেউ না থাকা সংসারে ঋতু এলো আলো হয়ে।দুঃসময়ে আমাদের একমাত্র বন্ধু ছিল আদিত্য’ দা।ঋতুর বাবার বন্ধু।
আমাকে গ্রেজুয়েশন করার জন্যে খুব চাপ দিত আদিত্য দা।কিন্তু নাফিস রাজি হত না। আমিও রাজি ছিলাম না।যেন সংসারটায় আমার কাছে সব।এরপর ঋতু এলো, ওকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম গ্রেজুয়েশন করার কথা মাথায় আসে নি।সেটায় আমার জন্য কাল হয়ে এলো জীবনে।

ঋতুর চতুর্থ জন্মদিন ছিল।নাফিস, আমি আর ঋতু
মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম নেভাল একাডেমির ওদিকে।সন্ধ্যে পর্যন্ত আমরা ওখানেই ছিলাম।এত সুখ আমার জীবনে ছিল আমার জানা ছিল না।নাফিসের মত মানুষ খুব কমই আছে।পৃথিবীর সব সুখ আমাকে ঢেলে দিয়েছে।না,টাকার সুখ নয় ওর ভালবাসা দিয়ে ও আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে।

বাসায় ফিরছিলাম।রাস্তায় গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।ঋতুকে আমার কোলে দিয়ে নাফিস
গাড়ি খুঁজছিল।হঠাৎ পেছন দিক থেকে একটা ট্রলী এসে নাফিসের উপর চলে যায়।আমার সব ভালবাসাকে আমার চোখের সামনে গুড়িয়ে দিল ট্রলীটা।এরপর আর কিছুই মনে ছিলনা আমার।নিজেকে আবিস্কার করলাম হাসপাতালের বেডে।
ঋতু কোথায়,নাফিস কোথায় কিছুই জানি না।সামনে দাঁড়িয়ে আদিত্য দা।আমার কৌতুহলী চোখ ওদের খুঁজছিল।মনে পড়ল নাফিসের এক্সিডেন্টের কথা।
নাফিসের কথা জিজ্ঞেস করতেই আদিত্য দা বলল নাফিস ভাল আছে।ঋতুকে আমার কোলে এনে দিল।আমি নাফিসকে দেখার জন্যে ছটফট করছিলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হতেই আদিত্য দা আমার মাথার কাছে এসে বসলো,আস্তে আস্তে খুলে বলল পুরো ঘটনা।

নাফিস শুয়ে আছে বিছানায়।এক্সিডেন্টে ওর পা দু’টো কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। হাতও অবশ হয়ে গেছে।সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে।অসহায় মুখটা দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।আট বছর হয়ে গেল বিছানায় পড়ে আছে।আমার সাথে তেমন কথা বলে না।ঘৃণা আর রাগের মিশ্রণ ওর দৃষ্টিতে।
আমার পেটের বাচ্চাটার দিকে নাফিস ফিরেও তাকায় না।আমি সামনে আসলেই মুখ ফিরিয়ে রাখে।চোখ গড়িয়ে পানি বালিশ অবধি পৌঁছে যায়।বালিশ চেইঞ্জ করতে গিয়ে ওরা ভেজা বালিশ আমাকে বলে দেয়, ওর কষ্টের পরিসীমা।

আমি জানি নাফিস আমাকে এভাবে দেখতে চায়নি। কিন্তু আমি নিরুপায়।অসৎ উপায়ে মেয়েটাকে বড় করতে চাইনি।নাফিসের চিকিৎসায় ওর অফিস থেকে পাওয়া সব টাকায় শেষ হয়ে গেছে।মেয়েটাকে আর নাফিসকে দু’মুটো অন্ন দিতে আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি।
একটা চাকুরী আশায় কতজনের কাছে গেছি।কিছুই হয়নি।গ্রেজুয়েশন করার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি।বিপদের মুহুর্তে আদিত্য দা ছিলেন ছায়ার মতন।আমাকে একটা চাকুরীও দিয়েছিলেন হাসপাতালে কিন্তু ওই টাকায় তিনটে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।ঋতুর স্কুল,ঘর ভাড়া,নাফিসের ওষুধের টাকা আর ভাত যোগাড় হত না ওই চাকুরীর টাকায়।অসহায়ের মত ছটফট করছিলাম।

বিপদের মূহুর্তে আদিত্য দা আবারও দেবতার মত হাজির হলেন।তিনিই আমাকে গর্ভ ভাড়া দেয়ার কথা বললেন।প্রথমে শুনেই কেঁদে ফেলেছিলাম।সবাই আমাকে নিয়ে কি ভাববে সেটা ভেবেই আদিত্য দা’কে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করলাম।চূড়ান্ত অপমান করে ফিরে এলাম ঘরে।সারারাত কান্না করলাম।কিন্তু আমার কাছে রাজি না হয়ে অন্য কোন উপায়ও ছিল না।হাত একদম খালি।সামনেই ঋতুর পরিক্ষা…মেয়েটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিল।ঠিক মতন খাবার দিতে পারছিলাম না।ওর কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম চাকুরীর পাশাপাশি আমি এই কাজটা করবো।কে কি বলেছে সেটা চিন্তা করলে আমার মেয়েটা না খেয়ে খেয়ে মারা যাবে।

সকাল হতেই আদিত্য দা’র কাছে গেলাম।উনি আমাকে এক নিঃসন্তান দম্পতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।আদিত্য দা ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আমাকে তেমন কিছু সুবিধায় পড়তে হয়নি।আমার গর্ভে ওই দম্পতির ভ্রুণ!! ভাবতেই প্রথমে কান্না পেয়েছিল।
টাকা পয়সার ব্যাপারে আদিত্য ‘ দা যা বলেছেন, তার চে বেশি দিতে রাজি হলেন তারা।এছাড়াও আমার খাবার থেকে শুরু করে সকল সুবিধা নিশ্চিত করেলেন ওরা।বাসা পরিবর্তন করে চলে এলাম পরিচিত মুখদের ছেড়ে।ওদের ইচ্ছেতেই চাকুরীটা ছেড়ে দিতে হল।বাচ্চার ব্যাপারে কোন রিস্ক নিতে চায় না।বাচ্চার সুস্থতার জন্যে ওরা সব করতে রাজি।
ওটা ছিল আমার দ্বিতীয় ইস্যু।এরপর তৃতীয়…চতুর্থ… পঞ্চম…

চাহিদার তুলনায় অনেক বেশী টাকায় পেয়েছিলাম আমি। মেয়েটাকে একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।নাফিসের হাতের থেরাপি চলছে রুটিন মাফিক।আগের চে অনেক ভাল আছে ও।একটা বুঠিক শপ দেয়ার জন্যে আদিত্য দা সহযোগিতা করছে।ওটা হয়ে গেলে আর আমাকে এসব করতে হবে না।।সব ঠিক ঠাক চলছিল।কিন্তু আমি ক্রমাগত ঋতু আর নাফিসের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিলাম।

ওরা আমার সাথে তেমন কথা বলে না।ঋতু নাফিসের সাথেই থাকে সারাক্ষণ।বাবা মেয়েতে সে কি হাসাহাসি। আমাকে দেখলেই ওদের মুখের হাসি ম্লান
হয়ে যায়।আমাকে এড়িয়ে যায় ঋতু।এমনকি নাফিসও।আমি বুঝতে পারি ওদের কষ্ট। আমাকে এভাবে দেখতে ওদের লাগে না।কিন্তু আমি নিরুপায়।
আরও কিছু টাকা আমাকে যোগাড় করতে হবে।দোকানের জন্যে আরও কিছু টাকা লাগবে।

আমি দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছি।অবশ্য একা নই,আমার শরীরের ভেতরে ছোট্ট একটা শরীর বড় হচ্ছে।আমি দিন রাত ওর সাথে কথা বলি,কত গল্প শোনায় ওকে।ও আমাকে কত কি বলে…আমাদের গল্পগুলো কোনদিন বাস্তব হবে না জেনেও আমি ওকে বলি, কিভাবে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবো,কিভাবে তেল মাখাবো,…ওর ন্যাপকিন চেইঞ্জের সময় আমি ওর পেটে খুব করে আদর খাবো।ও মনে হয় সব শুনতে পায়…নড়া চড়া করে খুব।
কয়েকদিন পরেই ও পৃথিবীর আলো দেখবে।খুব ভাল লাগছে।ছানাটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে।ওর বাবা-মা দেখতে খুব সুন্দর। তাদের মতই হবে হয়ত।ওর মা বারবার ফোন করে কেমন আছি সেটা জানতে।ওরা আমার সব কিছুর যত্ন নেয়।

বাচ্চাগুলো যখন আসে, আমি ওদের মুখ দেখি না,খুব দেখতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে নরম তুলতুলে শরীরটা এবার ছুঁয়ে দেই।কিন্তু না, মায়া বাড়ালে চলবে না।ওরা চলে যাবার সময় আমাকে বারবার অনুরোধ করে বাচ্চাটার মুখ দেখার জন্য।কিন্তু আমি দেখি না।ওকে দেখলে আমার জড়িয়ে ধরতে মন চাইবে,আদর করতে মন চাইবে,,,চুমু খেতে মন চাইবে…..হয়ত ওকে ছাড়তেই মন চাইবে না।
কিন্তু আমি ওর কেউ নই।আমি তো ওর মা নই।
টাকার বিনিময়ে ওকে আমি আশ্রয় দিয়েছি দশমাস দশদিন।দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করেও আমি মা হতে পারি নি….গর্ভে ধারণ করলেই মা হওয়া যায় না….
আমার ঋতুর ছোট বেলার মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে…হ্যাঁ আমিও মা.. আমার ঋতুর মা।
আমার পাঁচ পাঁচটা ঋতুর মা আমি….