মহিমান্বিত মহররম ও আশুরা: মুমিনদের করণীয় বর্জনীয়
একুশে জার্নাল ডটকম
আগস্ট ২৯ ২০২০, ১৮:৫৯
মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দিন আহমদ:
সময় তার নিজের গতিতে বয়ে যায় । সব কিছু শুরু হয় এবং শেষ হয়ে যায় । রাত থেকে দিন এভাবে শেষ হয় সপ্তাহ, মাস ও বছর । সময় ও কালের প্রবাহ কখনও থামে না । আপন গতিতে চলে সম্মুখপানে অবিরাম । প্রতিটি বস্তর আগমন ঘটে নতুন হয়ে, প্রস্থান ঘটে পুরানো হয়ে ।
নশ্বর এই পৃথিবীতে এটা একটি চরম সত্য ও বাস্তব বিষয়।জাগতিক এই নিয়মেই আমাদের সকলের জীবন থেকে চলে গেল আরো একটি বছর । মিশে গেল সময়ের আবর্তে । শুরু হল একটি নতুন বছর। অর্থাৎ আরবী বা হিজরী বর্ষের ১৪৪২ তম বছরের যাত্রা শুরু ।
মহাররম মাসের গুরুত্ব :
হিজরী বর্ষের প্রথম মাস হল মহররম। মহররম শব্দটি হচ্ছে আরবী। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সম্মানিত । বাস্তব বিচারেও এ মাস প্রতিটি মুমিন বান্দাদের দৃষ্টিতে সম্মানিত।
আবহমান কাল থেকেই মহররম মাস এক বিশেষ মর্যাদা ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ পাক তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাঈলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।(সহীহ বুখারী ১/৪৮১)
অনেকের ধারণা, কারবালা ট্রাজেডির কারণে নাকি শরিয়তে আশুরার এতো গুরুত্ব। এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ, কারবালার ঘটনার বহুকাল পূর্বে আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটেছে। তবে হ্যা; এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কারবালার ঘটনা একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। এতে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সহ আহলে বাইতের অনেক সদস্য শাহাদৎ বরণ করেছেন।
তারা কলিজার তপ্ত খুন দ্বারা অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অমর ইতিহাস রচনা করেছেন এবং প্রজ্বলিত করেছেন ইসলামি চেতনার অনির্বাণ মশাল। সমাজের সর্বক্ষেত্রে নববি আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ করাই ছিলো শোহাদায়ে কারবালার উদ্দেশ্য।
কিন্তু বর্তমান সময়ে মুসলমানদের অনেকেই তাদের এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে অনেক অনৈসলামিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।
বিশেষ করে শিয়ারা শোক মিছিল ও মাতম করার যে রীতিনীতি সমাজে চলমান এর কোনোটার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই ।
এমনিভাবে এ উপলক্ষে মাজার কিংবা মসজিদে যে হালুয়া রুটি বিতরণ করা হয় এরও কোনো ভিত্তি ইসলামে নেই । এসব হচ্ছে গর্হিত ও গুণাহের কাজ।
অথচ মুমিনের ইমান-আকিদা ও আমল ফলপ্রসু হওয়ার জন্য সুন্নতের অনুসরণ ও বিদআত বর্জন করাই হল মহররমের শাশ্বত আহ্বান।
তাইতো মহররম মাস ও আশুরার ফজলিত সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহে রয়েছে স্পষ্ট অসংখ্য বর্ণনা ।
কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম একটি মাস হল মাহে মহাররম।
আল্লাহ পাক বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।
এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং, এরমধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না।(সুরা তওবা: ৩৬)
বিদায় হজের সময় মিনায় প্রদত্ত খুতবায় রাসুলুল্লাহ (সা:) সম্মানিত মাসগুলোর বর্ণনা দিয়ে বলেন,
তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক-জিলকদ, জিলহজ ও মহাররম, অপরটি হলো রজব।
মহররম মাসের ফজলিত:
হযরত আবু হোরায়রা(রা:)হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ (সা:) বলেছেন,” মাহে রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা, আল্লাহর মাস মহররম । আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায রাতের ( তাহাজ্জুদ) নামায ।”(মুসলিম শরীফ – হাদীস: ২৫৫)
বিশেষ করে আশুরার রোযার গুরুত্ব ও ফজলিত: আশুরা বলতে কী বুঝায়? এর উত্তর হল মহররম মাসের দশম দিনকেই আশুরার দিন বলা হয়।
আর মহররমের দশম দিবস(আশুরা)অতি পূণ্যময় ও মহিমান্বিত দিন। এ দিন রোজা রাখার ফজিলত ও তাকিদ অন্যদিনের চেয়ে বেশি।এটা ছিল মহানবী (সা:) এর সুন্নত বা বিশেষ আমল ।
তাছাড়া বহু হাদীসে এই দিনের ফজলিত বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলল্লাহ(সা:) আশুরার ( মহররম মাসের দশম ) দিনে স্বয়ং রোযা রেখেছেন এবং ঐ দিনে রোযা রাখতে আদেশ করেছেন । ( বুখারী – হাদীস :২০০৪, মুসলিম – হাদীস: ১১৩০)
আয়েশা ( রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ(সা:) প্রথমে আশুরার দিনে সাওম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমযানের সাওম ফরয করা হলো তখন যার ইচ্ছা ( আশূরার ) সাওম পালন করত আর যার ইচ্ছা করত না ।( বুখারী হাদীস: ১৮৭৫ )
হযরত ইবনে আব্বাস(রা:)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলল্লাহ (সা:) কে আশূরার দিনের রোযার উপর অন্য কোন দিনের রোযাকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখি নাই এবং এ মাস তথা রামাযান মাসের উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখি নাই। ( বুখারী হাদীস” ১৮৮০)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা (রহ,)——- হুমায়দ ইবনে আবদুর রহমান (রহ,) থেকে বর্ণিত, যে বছর হযরত মু’আবিয়া (রা:) হজ্জ করেন সে বছর আশূরার দিনে ( মসজিদে নববীর ) মিম্বরে তিনি (রাবী) তাকে বলতে শুনেছেন যে, হে মদীনাবাসীগণ ! তোমাদের আলিমগণ কোথায়? আমি রাসূলল্লাহ(সা:) কে বলতে শুনেছি যে, আজকে আশূরার দিন, আল্লাহ পাক সাওমে আশুরা তোমাদের উপর ফরয করেন
নি বটে, তবে আমি ( আজ সাওম পালন করছি । যার ইচ্ছা সে রোযা পালন করুক যার ইচ্ছা সে পালন না করুক । ( বুখারী হাদীস:১৮৭৭)
আশুরার রোযার ফলে গুণাহ মাফ হয় :
হযরত আবু কাতাদাহ (রা:) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল(সা:) কে আশুরার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তা বিগত এক বছরের (সগীরা) গুণাহ মোচন করে দেয় ।(মুসলিম শরীফ,হাদীস: ১১৬২)
কেন আশুরার রোযা ?
হযরত ইবনে আব্বাস(রা:)থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ(সা:)মদিনায় আগমন করে দেখতে
পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ আশুরার দিনে রোযা পালন করে । তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কি ব্যাপার ? ( তোমরা এ দিনে রোযা পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মুসা (আ:) সাওম বা রোযা পালন করেন ।
রাসূলল্লাহ(সা:) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সাওম পালন করেন এবং পালনের নির্দেশ দেন । ( বুখারী হাদীস: ১৮৭৮)
আশুরার রোযা কয়টি ?
হযরত ইবনে আব্বাস(রা:)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ (সা:) বলেছেন, আগামী বছর যদি বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব।”(অর্থাৎ নবম ও দশম দুদিন ব্যাপী রোযা রাখব।) ( মুসলিম শরীফ,হাদীস : ১১৩৪)
আশুরার দিনের রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’(মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)
অর্থাৎ আশুরার রোযা দুটি রাখা মুস্তাহাব । রাখার পদ্ধতি হল মহররমের নয় ও দশ তারিখ কিংবা দশ ও এগার তারিখ । যার প্রমাণ উপরোক্ত বর্ণিত হাদীস দ্বয় থেকে প্রমাণিত । তবে একটি তথা শুধু আশুরা বা দশম তারিখে রোযা রাখা মাকরূহে তানযিহী।
আশুরার তাযিয়া মিছিল ও মাতম: আশুরা তারিখে শী’আ ও রাফেযীরা মিছিলের যে মাতম করে থাকে, শরীআতের দৃষ্টিতে তা মারাত্মক গুণাহের কাজ ও হারাম।
যখন বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) সহ ও অন্যান্য নবীগণের মৃত্যুতে শোক দিবস পালনের অনুমতি মহান আল্লাহ পাক দেননি । তখন অন্য লোকের মৃত্যুতে শোক দিবস পালনের তো প্রশ্নই ওঠে না । হ্যা, তাদের রুহের সাওয়াব রিসানীর জন্য ব্যক্তিগতভাবে দু’আ কালাম পড়তে কোন অসুবিধা নেই ।(ফাতাওয়ায়ে মাহমূদিয়া ৫/৩৯০# আসসানুল ফাতাওয়া ১/৩৯০ # ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া ২/২৭৩)
সে হিশেবে মুমিনদের করণীয় ও বর্জনীয় আমল: মহররম মাসের করণীয় বিষয়গুলো যথা, তওবা- ইস্তেগফার, কুরআন তিলাওয়াত, নফল রোযা বিশেষ করে আশুরার দুুটি রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল কুরআন সুন্নাহের আলোকে পালন করা।
এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে থাকা যেমন; তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি এছাড়া বাকি যত কাজ প্রচলিত আছে আশুরা দিবসকে ঘিরে, সবই বর্জনযোগ্য কুসংস্কার।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক নেক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন—